book review

Book Review: গোষ্পদে ধরা বাংলার চিন্তাজগৎ

২০ থেকে ২৬ পর্যন্ত অন্ত্যটীকায় অনুক্রমের কিছু প্রমাদের কারণে এই ব্যাপারটি স্পষ্ট নয়।

Advertisement
অপরাজিতা দাশগুপ্ত
শেষ আপডেট: ০২ জুলাই ২০২২ ০৮:০৬

ভূদেব মুখোপাধ্যায় থেকে অনিতা অগ্নিহোত্রী, অর্থাৎ উনিশ শতকের ক্রান্তিকাল থেকে হাল আমল পর্যন্ত প্রায় সওয়াশো বছরের সমাজ, সংস্কৃতি, মানসিকতাকে অনুবাদকর্মের মাধ্যমে ধরার প্রয়াস যে বইতে, সেই সঙ্কলনের সৃষ্টির ভাবনার উৎস কী ছিল? মূল অনুবাদক এবং সম্পাদক কল্পনা বর্ধন ভূমিকায় চমৎকার ভাবে নিজেই জানিয়েছেন সেই সলতে পাকানোর পর্বটির হদিস। প্রারম্ভিক বাচনে পড়ি, এই অনুবাদকর্মের পিছনে কল্পনার যে সুপ্ত আকাঙ্ক্ষা কাজ করেছে, তা হল তাঁর পুত্র এবং তাঁর বন্ধুগোষ্ঠী— যারা মা-বাবার সঙ্গে শৈশবে এক মহাদেশ থেকে অন্য মহাদেশে অন্য ভাষার চৌহদ্দিতে প্রোথিত, এবং ফলত বাংলা ভাষা চর্চার স্বাভাবিক পরিমণ্ডল থেকে বঞ্চিত হয়েছে— তাঁদের হাতে অনুবাদের মাধ্যমে বাঙালি সমাজ, সত্তা ও মননের কিছু অংশ পৌঁছে দেওয়ার বাসনা, প্রাক্‌কথনে আশিস নন্দী যাকে অভিহিত করেছেন কল্পনার ‘নিষ্পাপ ব্যক্তিগত কারণ’ বলে। এই আকাঙ্ক্ষা পূরণে এ বই ষোলো আনার উপর আঠারো আনা সফল।

Advertisement

অনুবাদকর্মে কল্পনা বহু কাল ধরেই সিদ্ধহস্ত। সঙ্কলনের ছেচল্লিশটি প্রবন্ধের মধ্যে সাঁইত্রিশটিই তাঁর নিজের অনুবাদ। নির্বাচনের ব্যাখ্যা সম্পাদকীয় ভূমিকায় রয়েছে। প্রথম এবং সহজবোধ্য কারণ হল, এই প্রবন্ধগুলি কল্পনার নিজের পছন্দের, আর এগুলি অনুবাদ করা তত দুঃসাধ্যও নয়। এ ছাড়াও তিনটি বিষয়ের প্রতি তিনি মনোযোগ দিয়েছেন— ঐতিহাসিক গভীরতা, বিষয়বৈচিত্র, এবং বিষয়বস্তুর অভিনবত্ব ও নতুন চিন্তাভাবনা। লেখকেরা যে ধরনের যুক্তিবিন্যাস প্রকাশ করতে চেয়েছেন এবং লেখকদের বিভিন্ন গদ্যভঙ্গি যে ভাবে ব্যক্ত হয়েছে, সেগুলিকে তিনি পাঠকের কাছে সাজিয়ে দিতে চেয়েছেন।

দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় কল্পনা দেখেছেন, বাংলা কবিতা বা গল্প-উপন্যাসের তুলনায় নন-ফিকশন বা ভাবনামূলক গদ্যের অনুবাদের দৃষ্টান্ত তুলনামূলক ভাবে কম। সেই অভাব মেটানোর জন্যই এই প্রয়াস। কল্পনার নিজের বিভাজনে সঙ্কলিত রচনাগুলি মূলত চার ধরনের— ‘ন্যারেটিভ’ বা আখ্যানধর্মী, ‘ডেসক্রিপটিভ’ বা বর্ণনামূলক, ‘এক্সপোজ়িটরি’ বা বিশ্লেষণধর্মী এবং ‘পারসুয়েসিভ’ বা প্রবৃত্তিজনক। এই বিভাজন যে সব সময়েই নিশ্ছিদ্র খোপে সন্নিবদ্ধ, তা নয়। সরলা দেবী, আবুল মনসুর আহমেদ, গৌরকিশোর ঘোষ, করুণা বন্দ্যোপাধ্যায়, হায়াৎ মামুদ এবং অনিতা অগ্নিহোত্রীর প্রবন্ধগুলি যেমন আখ্যানধর্মী, কিন্তু আবার প্রবৃত্তিজনকও বটে। সঙ্কলনে স্থান পাওয়া একত্রিশ জন লেখকের মধ্যে পাঁচ জন মহিলা— প্রিয়ম্বদা দেবী, সরলা দেবী চৌধুরানী, করুণা বন্দ্যোপাধ্যায়, সুকুমারী ভট্টাচার্য এবং অনিতা অগ্নিহোত্রী। ভূদেব মুখোপাধ্যায়ের সামাজিক প্রবন্ধ (যার আংশিক অনুবাদ এখানে রয়েছে) বা জগদীশচন্দ্র বসুর ভাগীরথীর উৎস সন্ধানে-র মতো অনেক রচনাই বহুখ্যাত। বইয়ে স্থান পেয়েছে রবীন্দ্রনাথের পাঁচটি রচনাও, যার মধ্যে ১৯১৬-র বক্তৃতা দ্য রিয়েলাইজ়েশন অব লাইফ-এর অনুবাদ অজিত চক্রবর্তী এবং সতীশ রায়ের সঙ্গে স্বয়ং তাঁর নিজের।

বোধ করি, কল্পনা ইচ্ছে করেই বিভিন্ন লেখকের এমন অনেক রচনা বেছেছেন, যাতে শুধু লেখকদের রচনাশৈলীই নয়, বাংলার ইতিহাস, সমাজ, সংস্কৃতি ও মানসজগৎ বিষয়ে পাঠকের কিঞ্চিৎ ধারণা তৈরি হয়। এই লক্ষ্যেই হয়তো গৌরকিশোর ঘোষের ‘এক নিরীশ্বরবাদীর গান্ধী যাত্রা’ প্রবন্ধ, অম্লান দত্তের রামমোহন বিষয়ক লেখা বা ‘মধ্যবিত্তের ভবিষ্যৎ’ প্রবন্ধ, বিদ্যাসাগর ও ডিরোজ়িয়ো সম্পর্কে অমিয় কুমার সামন্তের রচনা, যামিনী রায়কে নিয়ে গণেশ পাইন, বা অণ্ণা হজ়ারেকে নিয়ে অনিতা অগ্নিহোত্রীর লেখা এই সঙ্কলনের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। কল্পনার সাবলীল ঝরঝরে অনুবাদে মূল্যবান রচনার তালিকা এখানেই শেষ নয়। পাঠক স্বাদ নিতে পারবেন ব্রাহ্মণ্যবাদী ভাবধারা নিয়ে অশোক রুদ্রের চিন্তার, পরে হওয়ার দুঃখ নামে পুস্তকাকারে প্রকাশিত শঙ্খ ঘোষের ‘সমর সেন স্মৃতি বক্তৃতা’র অংশবিশেষের, শিশিরকুমার দাশের অলৌকিক সংলাপ-এর টুকরোর, কিংবা প্রণবেশ সেন স্মৃতি বক্তৃতা হিসেবে প্রদত্ত প্রণব বর্ধনের দুর্নীতি নিয়ে দুশ্চিন্তা ভাবনাপ্রবাহের। অনেক ক্ষেত্রে বাংলা ভাষার সঙ্গে অপরিচিত পাঠকের জন্য ঠিক কতটুকু অংশ পরিবেশন করবেন, সে নির্বাচন ও সঙ্কোচনও কল্পনা অধ্যবসায় সহকারে করেছেন। যেমন অশোক সেনের রাজনীতির পাঠক্রমে রবীন্দ্রনাথ (২০১৪) বইটির অংশবিশেষ— ‘স্বরাজের খোঁজে স্বদেশের কাজ’ পরিবেশিত হয়েছে সূচিমুখ সম্পাদনায়। একই ভাবে, বাদ গিয়েছে সুকুমারী ভট্টাচার্যের রচনা আপেক্ষিক মূল্যায়নে রামায়ণ ও মহাভারত-এ কর্ণ সংক্রান্ত অধ্যায়টির কিছু কঠিন ছত্র।

আইডিয়াজ়, থটস অ্যান্ড মেমরিজ়

বেঙ্গলি লিটারেরি এসেজ়: আ সিলেকশন ইন ট্রান্সলেশন

সম্পা: কল্পনা বর্ধন

৬০০.০০

অনুষ্টুপ

বিষয়বৈচিত্রের দাবি রাখে বেশ কয়েকটি রচনা। যেমন, ইতিহাসবিদ পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের একটি রচনা আসলে রাঘব বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস অপারেশন রাজারহাট-এর এক অন্য ধারার আলোচনা, যেটি পড়ে উপন্যাসটি পড়ার আগ্রহ জাগে। অন্য দিকে, কলকাতার বাজার ও নদী নিয়ে রাঘবের দু’টি লেখা সুকান্ত চৌধুরীর সম্পাদিত ক্যালকাটা: দ্য লিভিং সিটি থেকে পুনর্মুদ্রিত হলেও পড়তে ভাল লাগে। সত্যজিৎ রায় ও অপু ট্রিলজি নিয়ে করুণা বন্দ্যোপাধ্যায়ের চারটি লেখা, এবং পথের পাঁচালী ও নায়ক নিয়ে এক্ষণ ও দেশ পত্রিকায় পূর্বপ্রকাশিত সত্যজিতের নিজের লেখা দু’টি উপভোগ্য। একই রকম স্বাদু ‘উৎসব’ সম্পর্কে সরলা দেবী চৌধুরানীর লেখাটিও, যা থেকে ঠাকুর পরিবারের দুই ধারার অন্দরমহলেও উঁকি দেওয়া যায়। শান্তিনিকেতন থেকে আগত মেয়েদের কাছে ঠাকুরবাড়ির মেয়েদের ব্রাত্য হয়ে যাওয়ার এবং মামা রবীন্দ্রনাথের প্রতি সরলার অসন্তোষ ও অনুযোগের পার্শ্ব-ইতিহাসটি বিধৃত এখানে।

অনূদিত রচনাগুলির সূত্রনির্দেশ, অর্থাৎ অন্ত্যটীকায় খানিক অসঙ্গতি চোখে পড়ে। জীবনানন্দের ‘অন পোয়েট্রি’ রচনাটি যদি বুদ্ধদেব বসু ও ক্লিন্টন সিলির অনুবাদে অ্যান অ্যান্থলজি অব বেঙ্গলি রাইটিং নামক সঙ্কলনের অংশ বলে ধরে নেওয়া হয়, তবে বুদ্ধদেবের প্রবন্ধটি (‘রবীন্দ্রনাথের গদ্য গান’) প্রভাতচন্দ্র গুপ্ত সম্পাদিত গীতবিতান পঞ্চাশ সঙ্কলনে পূর্বপ্রকাশিত। কিন্তু ২০ থেকে ২৬ পর্যন্ত অন্ত্যটীকায় অনুক্রমের কিছু প্রমাদের কারণে এই ব্যাপারটি স্পষ্ট নয়। সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত ভাবে মনে হয়েছে, কিছু কিছু অন্তর্ভুক্তি হয়তো বইটিকে আরও ঋদ্ধ করতে পারত।

এ বইয়ে ঠাঁই পেয়েছে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ১৯৩৬ সালে প্রদত্ত ভাষণ মুসলিম সাহিত্য সমাজ। কিন্তু, যে হেতু ধ্রুপদী লেখকদের একাধিক করে রচনা বইটিতে স্থান পেয়েছে, সে জন্য মনে হয় ১৯১৭ সালে লেখা শরৎচন্দ্রের ‘নারীর মূল্য’ প্রবন্ধটির অংশবিশেষেরও স্থান সঙ্কুলান হলে ভাল লাগত। কল্পনা যদিও প্রথমেই ব্যাখ্যা করেছেন যে, দৈর্ঘ্য আর গুরুগাম্ভীর্যের কারণে বঙ্কিমচন্দ্রের প্রবন্ধ এই বইয়ে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি, তবু মনে হয় নিদেনপক্ষে কমলাকান্তের দপ্তর থেকে ‘বিড়াল’ বা ওই জাতীয় কোনও রূপকধর্মী প্রবন্ধ অল্প পাদটীকা সহযোগে পরিবেশন করা কি নিতান্তই অসম্ভব ছিল? তবু সব মিলিয়ে কল্পনা বর্ধনের এই প্রয়াস নিঃসন্দেহে সাধুবাদযোগ্য। এই বিদগ্ধ প্রকাশনার মাধ্যমে ‘অনুষ্টুপ’ আরও এক বার বাঙালির কৃতজ্ঞতাভাজন হল।

আরও পড়ুন
Advertisement