Mahatma Gandhi

বিধানদাতা ও ‘প্রিয়তমা সরলা’

১৯০১ সালের ক্ষণিক সাক্ষাৎ বাদ দিলে, বইয়ের দুই প্রধান কুশীলবের আসল সম্পর্ক শুরু ১৯১৯-এ।

Advertisement
অপরাজিতা দাশগুপ্ত
শেষ আপডেট: ০৩ অক্টোবর ২০২০ ০৬:১৭

লস্ট লেটারস অ্যান্ড ফেমিনিস্ট হিস্ট্রি: দ্য পলিটিক্যাল ফ্রেন্ডশিপ অব মোহনদাস কে গাঁধী অ্যান্ড সরলা দেবী চৌধুরাণী
জেরাল্ডিন ফোর্বস
৫৯৫.০০

ওরিয়েন্ট ব্ল্যাকসোয়ান, ২০২০

Advertisement

ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ক্রান্তিদূত মহাত্মা গাঁধীর জীবনের অন্যতম ‘অর্জন’ হল, মেয়েদের অন্দরমহলের বাইরে— জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের পরিসরে নিয়ে আসা। প্রত্যাশিত ভাবেই সেই পরিব্যাপ্ত জীবনের নানা পর্যায়ে বহু নারীর সঙ্গে তাঁর ভাব বিনিময়, সম্পর্ক ও রসায়ন নিয়ে আলোচনা প্রচুর। তার মধ্যে ঠাকুর পরিবারের কন্যা সরলা দেবী চৌধুরাণীর সঙ্গে গাঁধীর সম্পর্কের স্বরূপ নিয়ে বিশ্লেষণধর্মী আলোচনা কম, জল্পনা ও গুঞ্জন বেশি; এমনকি, তাকে কেন্দ্র করে চলেছে গাঁধীর ব্যক্তিজীবনের গহনে ‘লুকানো’ সম্ভাব্য ‘রসালো’ গল্পের অন্বেষণ। জেরাল্ডিন ফোর্বসের বইটি তাই এক বিরল ব্যতিক্রম, যেখানে তথ্যনিষ্ঠ বিশ্লেষণের মাধ্যমে গাঁধী এবং সরলার মধ্যে নিবিড় সম্পর্কের স্বরূপটি ফুটে উঠেছে। ভারতীয় মানবীবিদ্যাচর্চার অন্যতম পথিকৃৎ জেরাল্ডিন লিঙ্গ-নির্মাণের পরিপ্রেক্ষিত থেকে ভারত-ইতিহাস চর্চা করছেন ৫০ বছর। এই ব্যতিক্রমী গবেষণা তাই তাঁর কাছে প্রত্যাশিত।

১৯০১ সালের ক্ষণিক সাক্ষাৎ বাদ দিলে, বইয়ের দুই প্রধান কুশীলবের আসল সম্পর্ক শুরু ১৯১৯-এ। এক টালমাটাল সময়ে লাহৌরে এলেন গাঁধী, আতিথ্য গ্রহণ করলেন সরলা আর তাঁর স্বামী রামভুজ দত্তচৌধুরীদের গৃহে। উত্তাল পঞ্জাবের পথে পথে পাশাপাশি হাঁটলেন দু’জনে, আর মুকুলিত হল গাঁধী ও সরলার ঘনিষ্ঠতা। স্বাজাত্যবোধের আন্তরিকতা, স্বাধীনতা ও ন্যায়বিচারের আকাঙ্ক্ষা— এ সব কিছুই নিশ্চয় কাজ করেছিল এই রসায়নের অনুঘটক হিসেবে।

ঠিক একশো বছর আগে, ১৯২০-র মার্চ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ছিল এই সম্পর্ক-রেখার শীর্ষবিন্দু। সেই সময়ে গাঁধী নাগাড়ে চিঠি লিখেছিলেন সরলাকে, প্রায় প্রতি দিন, কখনও একই দিনে একাধিক। বইয়ের পাঁচটি পরিচ্ছেদের দু’টি গাঁধীর চিঠিগুলি নিয়ে। একটি গাঁধীর জীবন সম্পর্কে, অন্যটি সরলার। তাঁদের জীবন ও কর্মকাণ্ডের পরতে পরতে চিঠিগুলি একটি বিবর্তনশীল প্রেক্ষিতে প্রোথিত। তাঁর হিসেবে গাঁধীর লেখা চিঠির সংখ্যা হওয়া উচিত প্রায় ২০০। আর সরলার— যিনি চিঠির অত জবাব দেন না বলে প্রায়ই ভর্ৎসনা করেছেন গাঁধী— তরফ থেকে খুব সম্ভবত লেখা হয়েছিল সত্তর থেকে আশিটি চিঠি। কিন্তু হায়, সেই পত্ররাজি থেকে পাওয়া গিয়েছে মোটে পাঁচটি। দ্বিপাক্ষিক পত্রপ্রবাহের অনেকগুলিই হারিয়ে গিয়েছে ডাকবিভাগের কল্যাণে, নতুবা এই সম্পর্কের জটিল মনস্তত্ত্বকে আর একটু সহজে বোঝা যেত।

সন্দেহ নেই, অনেক চিঠিতেই গাঁধী নির্ভুল চিহ্ন রেখে দিয়েছেন তাঁর আকর্ষণের। যখন সরলা তাঁর থেকে দূরে, তখন তীব্র ভাবে অভাব বোধ করেছেন তাঁর, চিঠির শেষে নিয়ম করে ‘ভালবাসা’ জানাতেও ভোলেননি। বলেছেন, নিশ্চয়ই জন্মান্তরের সম্বন্ধ ছিল, নয়তো এতখানি টান আসে কী করে? সম্বোধনেও গাঁধী প্রহেলিকাময়, ‘আমার প্রিয় সরলা দেবী’ বলে বেশ প্রথাসিদ্ধ ভঙ্গিতে যে পত্রপ্রবাহের শুরু, অচিরেই সেই সম্বোধন বদলে গিয়েছে ‘আমার প্রিয়তমা সরলা’, ‘মাই ডিয়ারেস্ট গার্ল’ বা ‘আমার প্রিয় বোন’ সম্বোধনে। পঞ্জাবের অগ্রণী আর্য সমাজী নেতার স্ত্রী, বহুগুণান্বিতা সরলা যখন খদ্দরের পরিধেয় বরণ করলেন, তখন গাঁধীর মুগ্ধতা অনুগামীদের সন্তুষ্ট করেনি। ১৯২০ সালে সবরমতী আশ্রম ভ্রমণকালে গাঁধী যে সরলার জন্য বিশেষ সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের ব্যবস্থা করছেন, তাঁর প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে পড়ছেন, তা কস্তুরবা-সহ আশ্রমিকদের অনেকেরই বিরাগের কারণ হয়েছিল। রাজমোহন গাঁধীও লিখেছেন, সরলার প্রতি গাঁধী এতটাই আকৃষ্ট ছিলেন যে, আধ্যাত্মিক বিবাহের পরিকল্পনাও তাঁর মাথায় আসে। হারম্যান ক্যালেনবাখের কাছে লেখা চিঠিতে গাঁধী সরলাকে উল্লেখ করেছেন ‘মাই স্পিরিচুয়াল ওয়াইফ’ বলে, পরে স্ত্রী, পুত্র এবং অনুগামীদের তিরস্কারে এই চমকপ্রদ পরিকল্পনা থেকে সরে আসতে বাধ্যই হন। সহকর্মী রাজাগোপালাচারীর মতো অনুগামীরা সরলাকে ‘সুযোগসন্ধানী’ তকমা দিয়ে গাঁধীকে পরামর্শ দেন সব সম্পর্ক ছিন্ন করার। সরলমতি পুরুষকে উন্মার্গগামী করে তোলায় নারীর ‘অনিবার্য’ ভূমিকার চেনা ছকটি এখানে নির্ভুল ভাবে চোখে পড়ে।

কিন্তু জেরাল্ডিন গাঁধীর সঙ্গে সঙ্গে সরলার অবস্থানটিকেও যথাযথ মর্যাদা দিয়ে ব্যাখ্যা করেছেন; স্পষ্টই জানিয়েছেন, তিনি এই দুই ব্যক্তিত্বের রাজনৈতিক বন্ধুত্বেরই বিশ্লেষণ করতে আগ্রহী, এই সম্পর্কের সম্ভাব্য শারীরিক রসায়নের পিচ্ছিল জমি কর্ষণ করতে নয়। তাঁর মতে, সম্পর্কটি ছিল ‘আ বন্ডিং বিটুইন আ পাওয়ারফুল ম্যান অ্যান্ড আ স্ট্রং উওম্যান’, যদিও এর মধ্যে নিহিত ছিল এক অসাম্যও, অন্তত গাঁধীর মানসে। জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের শক্তিস্বরূপিণী ‘মাতাজি’ হয়ে ওঠার ক্ষমতা যে সরলার আছে, তা গাঁধী মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেছিলেন। দেশ ও জাতির জন্য এই মহতী কর্মযজ্ঞে ধীরে ধীরে নিজের ইচ্ছানুযায়ী গড়েপিটে খাঁটি সোনায় পরিণত করবেন সরলাকে, এমনই আশা ছিল তাঁর। তাই প্রতিটি চিঠির শেষে তিনি স্বাক্ষর করেন ‘তোমার বিধানদাতা’ (‘ইয়োর ল’-গিভার’) হিসেবে। কোনও চিঠিতে এই অমোঘ উচ্চারণ থেকে একচুল বিচ্যুতি ঘটেনি।

এর অর্ধশতাব্দী আগে থেকেই পিতৃতান্ত্রিক সমাজমানসে প্রত্যাশা নিহিত ছিল, ‘ঘরের মেয়েরা’ তাঁদের স্বামীদের ‘যোগ্য’ হয়ে উঠবেন। গাঁধী আন্দোলনে মেয়েদের শামিল করলেন, তবে সেই অংশগ্রহণের পূর্বশর্তই ছিল পিতা বা স্বামীর সম্মতি। এমনকি, ‘প্রিয়তমা’ সরলার ক্ষেত্রেও প্রতি চিঠিতেই স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে, দেশগঠনের এই ব্রতে শামিল হওয়া স্বামী রামভুজের সম্মতিসাপেক্ষ, এবং শেষ পর্বে আত্মপ্রকাশের প্রক্রিয়াটির চূড়ান্ত নিয়ন্তা গাঁধী স্বয়ং। কিমাশ্চর্যম্, এর আগে যে প্রায় ত্রিশ বছর ধরে সরলা শুধু জাতীয়তাবাদী আন্দোলনেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেননি, ধীরে ধীরে হয়ে উঠেছিলেন নারী আন্দোলনের পথিকৃৎও, সেই ভূমিকা উপেক্ষিতই থেকেেছ গাঁধীর চিঠিতে।

সরলার পাঁচটি চিঠির একটিও এ বইয়ে সংযোজিত না হওয়ায়, তিনি কী ভেবেছিলেন জানা হয়ে ওঠে না, যদিও তাঁর মানসিকতার কিয়ৎ আভাস আমরা রামচন্দ্র গুহর গাঁধী-জীবনীতে পেয়েছি। তবে এ কথা জানা যে, একশো বছর আগে শীর্ষবিন্দু স্পর্শ করেও ক্ষীণ আঁচে সম্পর্কটি জ্বলতে থাকবে প্রায় ১৯৪৫-এ সরলার মৃত্যু অবধি, যে পঁচিশ বছরে ক্রমশ ভিন্ন হয়ে যাবে দু’জনের কক্ষপথ। ১৯২০-তে পায়ের যন্ত্রণা আর নার্ভাস ব্রেকডাউনের যুগপৎ আক্রমণে বিপর্যস্ত যে মানুষটি ‘প্রিয়তমা সরলা’কে চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘আই অ্যাম আ স্পেন্ট বুলেট’, সেই কথাকে নিজেই অপ্রমাণ করে তিনি নেতৃত্ব দেবেন একের পর এক সুবিশাল কর্মযজ্ঞের। আর সরলা? ১৯২৩-এ স্বামীর মৃত্যুর পর ক্ষণিক অবসর নিলেও, তিনিও অচিরেই ফিরে আসবেন ভারত স্ত্রী মহামণ্ডল এবং স্ত্রী শিক্ষা সদনের লক্ষ্যমাত্রা সামনে রেখে, আবার ফিরবেন পত্রিকা সম্পাদনার কাজে, সরব হবেন জাতপাতের বিভেদের বিরুদ্ধে, ডাক দেবেন মেয়েদের এক আলাদা কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার জন্য, এবং জীবনের শেষ দশ বছর নিজেকে সঁপে দেবেন আধ্যাত্মিকতায়। কিন্তু গাঁধী-নির্দেশিত পথে ‘সীতা, দময়ন্তী, দ্রৌপদীর মতো শুদ্ধ, দৃঢ়, আত্মনিয়ন্ত্রিত জননেত্রী’ হওয়া আর হবে না তাঁর। রাজনীতির আঙিনা থেকে স্বেচ্ছা-নির্বাসন নিয়ে নিজেই গড়ে নেবেন তাঁর পরবর্তী সমাজসেবামূলক কর্মপদ্ধতি, গাঁধী নামক ভাগ্যবিধাতার ভূমিকার তোয়াক্কা না করেই। গাঁধী ও সরলার কক্ষপথের এই আলাদা হয়ে যাওয়া আসলে বিংশ শতাব্দীর ভারতে জাতীয়তাবাদ আর নারীবাদের কক্ষপথের পৃথকীকরণেরই প্রতিরূপ।

গাঁধী এবং সরলা দেবী চৌধুরাণী, এই দুই প্রখর ব্যক্তিত্বের সম্পর্ককে তাই বুঝতে হবে নিছক আকর্ষণ আর প্রেম নয়, লক্ষ্যের তারতম্য আর সংঘাতের মাপকাঠিতেও, যেখানে অনন্য স্পর্ধায় রচিত হয় তাঁদের নিজস্ব সাবজেক্টিভিটি বা বিষয়ীভাব, যাকে পরিণত কলমে উপস্থাপিত করেছেন জেরাল্ডিন ফোর্বস। বইটি তাই শুধু গাঁধীচর্চার নয়, মানবীবিদ্যাচর্চারও এক অসামান্য নজির হয়ে থাকবে।

আরও পড়ুন
Advertisement