book review

ভারতীয় ধর্মের সর্বজনীন রূপ

বইটি পাঠ করলে অর্থ সহজবোধ্য হওয়া ছাড়াও ব্রাহ্মধর্ম যে ভারতীয় আধ্যাত্মিক ইতিহাস ও ঐতিহ্যের একটি নিরাকার ও সর্বজনীন রূপ, এই যোগসূত্রটি সহজেই ধরা পড়েছে।

Advertisement
শর্মিলা রায় পোমো
শেষ আপডেট: ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২২ ০৭:১৬
প্রতীকী ছবি।

প্রতীকী ছবি।

“আমার ধর্মকে কথায় বলতে গেলে ফুরিয়ে যায় তাই বলি নে। গানের সুরে তার রূপ দেখি, তার মধ্যে গভীর দুঃখ গভীর আনন্দ এক হয়ে মিলে গেছে...।” এই কথাগুলি বলেছে রবীন্দ্রনাথের যোগাযোগ উপন্যাসের বিপ্রদাস। সঙ্গীত যে মানবচেতনায় নিরাময়ের ও শুশ্রূষার মুহূর্ত তৈরি করে, সেই সত্যটি ব্রাহ্ম ধর্মের আদিযুগ থেকেই প্রচারক ও আচার্যরা অনুধাবন করেছিলেন। রামমোহন স্বয়ং শাস্ত্রীয় সঙ্গীত শিক্ষা করে গান রচনা করেন ও সর্বপ্রথম আধ্যাত্মিক সাধনায় সঙ্গীতের স্থান সম্পর্কে নিরাকার ধর্মাচরণের অনুরাগীদের সচেতন করেন। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের সঙ্গীত রচনার পশ্চাতে ছিল আত্মিক জীবনের এক দুঃখের অভিজ্ঞতার সঙ্গে আধ্যাত্মিক সাধনার স্পৃহা।

রবীন্দ্রনাথ ১৮৯৫ সালের ৫ অক্টোবর একটি চিঠিতে (ছিন্নপত্র, ১৪৭) লিখছেন, “আমরা বাইরের শাস্ত্র থেকে যে ধর্ম্ম পাই সে কখনোই আমার ধর্ম্ম হয়ে ওঠে না। তার সঙ্গে কেবলমাত্র একটা অভ্যাসের যোগ জন্মে। ধর্ম্মকে নিজের মধ্যে উদ্ভূত করে তোলাই মানুষের চিরজীবনের সাধনা। চরম বেদনায় তাকে জন্মদান করতে হয়, নাড়ির শোণিত দিয়ে তাকে প্রাণদান করতে হয়...।” যে জ্ঞান জীবনকে ধারণ করে, পুষ্ট করে— যা দেবেন্দ্রনাথের ভাষায় ‘সহজ জ্ঞান ও আত্মপ্রত্যয়’— রামমোহনের কাল থেকে আমাদের এক গভীর তাৎপর্যময় দার্শনিক উত্তরাধিকার। স্বয়ং রামমোহন ব্রহ্মজ্ঞান বিষয়ক সঙ্গীতকে ব্রহ্মসঙ্গীত আখ্যা দেন। আত্মজিজ্ঞাসা ও আত্মবিশ্লেষণ আজও প্রচারক ও আচার্যদের ধর্মপালনের মূলমন্ত্র।

Advertisement

এই সহজতা মানবজীবনে এক স্বস্থতা ও দার্শনিক বোধ আনে, এই পরম সত্যটি এই বইটিতে নির্বাচিত অধিকাংশ উপাসনার ভিত্তি। সতীশচন্দ্র চক্রবর্তী বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় রচিত নিরাকার ঈশ্বরসাধনার জয়গানগুলি এক অভূতপূর্ব সংগ্রহে নথিবদ্ধ করেছেন। এই সার্বিক মনোভাব আজকের যুগের রাষ্ট্রীয় অস্থিরতা, ধর্মান্ধতা ও পরমত সম্পর্কে অসহিষ্ণুতার প্রেক্ষাপটে একটি গভীর তাৎপর্য বহন করে।

ব্রাহ্মধর্ম: দর্শন, চর্চা পালন

শ্রীলা চট্টোপাধ্যায়, অমিতাভ রক্ষিত

৪০০.০০

নালক পাবলিকেশন

ব্রাহ্মধর্মের সূচনাকাল থেকেই রামমোহন সামাজিক ও নৈতিক কুসংস্কার দূর করার প্রতি দৃষ্টি দেন। সমাজে শিক্ষার প্রসার, নারীপ্রগতি, দরিদ্রদের সাহায্য ইত্যাদি মানবিক কর্তব্য সাধন করেছেন ব্রাহ্মসমাজের সদস্যরা। এই ধারা আজও বিদ্যমান। এই বইটিতে বেদ ও উপনিষদের মন্ত্রের মূল সংস্কৃতের সঙ্গে বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ ও ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। ফলে, বইটি পাঠ করলে অর্থ সহজবোধ্য হওয়া ছাড়াও ব্রাহ্মধর্ম যে ভারতীয় আধ্যাত্মিক ইতিহাস ও ঐতিহ্যের একটি নিরাকার ও সর্বজনীন রূপ, এই যোগসূত্রটি সহজেই ধরা পড়েছে। যুগের প্রয়োজনে সংস্কৃত, বাংলা ও ইংরেজি ভাষা ব্যবহার অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। শ্লোক সংগ্রহ থেকে বিভিন্ন ধর্মের দার্শনিক নির্যাসগুলি এই গ্রন্থে যুক্ত করা হয়েছে।

আজকের অতিগতিশীল ও কর্মমুখর জীবনযাপনের মধ্যে থেকে এবং বর্তমান কালের অতিমারির অনিশ্চয়তার মধ্যে এই বইটি বিশেষ একটি ভূমিকা রচনা করল। সামাজিক অনুষ্ঠানাদিকে এক বিশেষ আধ্যাত্মিক তাৎপর্য দান এই বইটির লক্ষ্য। এই কাজে সংগ্রহ ও সঙ্কলনের বিশেষ প্রয়োজন। সেই কর্তব্য গভীর নিষ্ঠা ও ভালবাসার সঙ্গে সম্পন্ন করেছেন শ্রীলা চট্টোপাধ্যায় ও অমিতাভ রক্ষিত। তাঁদের গভীর কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করি। প্রকাশনার কায়িক রূপটি সুন্দর করে নির্মিত হয়েছে ‘নালক’ সংস্থার সম্বুদ্ধ সান্যালের বিচক্ষণ পরিচালনায়। তাঁকে সাধুবাদ জানাই। আশা করি, অনুসন্ধিৎসু পাঠক বইটি পড়বেন উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা নিয়ে।

আরও পড়ুন
Advertisement