book review

শুধু কাব্যে নয়, স্বাস্থ্যেও উপেক্ষিতা

সোমা মুখোপাধ্যায় উনিশ শতকের বঙ্গনারীর যে ইতিহাস তুলে ধরেছেন তাতে স্পষ্ট, পুরুষতন্ত্র তখন নারীকে সন্তান বানানোর যন্ত্র করে তুলেছিল, কিন্তু সন্তানজন্মের সময় মা বা শিশুর সুরক্ষার কোনও ব্যবস্থা করেনি।

Advertisement
শ্যামল চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ১৫ অক্টোবর ২০২২ ০৬:২৭

“স্ত্রী একজোড়া চটি জুতা বই তো না। এক জোড়া গিয়াছে আর এক জোড়া তার চেয়েও ভালো আনিয়া দিব।” স্ত্রীবিয়োগের পরে ডাক্তার যাদবচন্দ্র ধর শোকাতুর হলে তাঁর কাকা বলছেন এ কথা। উনিশ শতকের বঙ্গনারীর সূতিকাগারের কথা লিখছেন কৈলাসবাসিনী দেবী, বদ্ধ মাটির ঘরে “জল উঠিতেছে, তার উপর দর্মা মাদুর কম্বল পাড়া একটি বালিশ... খাওয়া ঝাল ও চিড়া ভাজা।” পুতুল খেলার বয়সে বিয়ে হওয়া সারদাসুন্দরীর শ্বশুরবাড়িতে ঢের দাসদাসী থাকলেও বড় বড় ঘর মুছে নাকাল হত বালিকাবধূ। সারদাসুন্দরী কেশবচন্দ্র সেনের মা। স্থিরসৌদামিনী দেবী জানাচ্ছেন, তাঁর মা “দু’বেলাই একশত লোকের রান্না একক অক্লান্তিতে রাঁধিতেন... মার প্রায় বৎসরান্ত সন্তান হইত।” রাসসুন্দরী দেবী সে কালের বাঙালি মেয়েদের শারীরিক-মানসিক যন্ত্রণার কথা লিখে গিয়েছেন। প্রসন্ননারায়ণ দেবের পুত্ৰবধূ ‘শাশুড়ি কর্তৃক তেরো বৎসর কাল অত্যাচারিত হইয়া’ আত্মহত্যা করেন, “বারো বৎসরের পুত্ৰবধূ সন্দেশ চুরি করিয়া খাইয়াছিল বলিয়া জটিলা শাশুড়ি খুন্তি পুড়াইয়া গাত্রের নানাস্থানে দাগাইয়া দেন,” লিখেছিল বামাবোধিনী পত্রিকা।

সোমা মুখোপাধ্যায় উনিশ শতকের বঙ্গনারীর যে ইতিহাস তুলে ধরেছেন তাতে স্পষ্ট, পুরুষতন্ত্র তখন নারীকে সন্তান বানানোর যন্ত্র করে তুলেছিল, কিন্তু সন্তানজন্মের সময় মা বা শিশুর সুরক্ষার কোনও ব্যবস্থা করেনি। তথাকথিত উদারমনস্ক ব্রাহ্মদের পত্রিকাতেও ভণ্ডামির শেষ ছিল না, লেখা হয়েছিল, “যে সকল কার্য আবশ্যক তাহা যত্নপূর্বক সম্পাদন করা গৃহিণীর কর্তব্য”! লেখক দেখিয়েছেন, খ্রিস্টান মিশনারিরা এ দেশে এসে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে অদক্ষ ধাত্রীদের হাতে প্রসব বন্ধ করে প্রশিক্ষিত ধাত্রী ও হাসপাতালে প্রসবের কথা প্রচার শুরু করেন। প্রস্তাব মানা হয়নি, কারণ ভারতীয় প্রথায় হাত দিতে তখন ইংরেজরা নারাজ। মেডিক্যাল কলেজ প্রতিষ্ঠার পরে হাসপাতালে প্রসব, প্রশিক্ষিত ধাত্রী নিয়োগের দাবি উঠল, আধুনিকের সঙ্গে সনাতনের গোল বাধল আঁতুড়ঘর কেন্দ্র করে। যদুনাথ মুখোপাধ্যায়ের ধাত্রী শিক্ষার সহজ পাঠ ও বামনদাস মুখোপাধ্যায়ের প্রসূতি পরিচর্যা বই দু’টি নিয়ে আলোচনা করেছেন লেখক।

Advertisement

অচেনা অন্তঃপুর: উনিশ শতকে বঙ্গনারীর স্বাস্থ্যকথা

সোমা মুখোপাধ্যায়

৩০০.০০

তবুও প্রয়াস

লেখক মেয়েদের অপুষ্টি রক্তাল্পতা ম্যালেরিয়া উদরাময় ও প্রসবের সমস্যার উল্লেখ করেছেন। প্রসবের জটিলতায় মৃত্যু, পচা ডোবায় স্নান করে আক্রান্ত হওয়ার উল্লেখ রয়েছে। নারীস্বাস্থ্যের পরিধি অবশ্য বহুবিস্তৃত, প্রসব বা গর্ভপাত-পরবর্তী প্রদাহ, অতিরিক্ত রক্তস্রাব, শ্বেতস্রাব, জরায়ু ও সন্নিহিত প্রত্যঙ্গের জটিল সংক্রমণ, বহু জটিলতায় আক্রান্ত হতেন উনিশ শতকের নারীরা। ‘পোয়াতি’-র স্বাস্থ্য নিয়ে মাথা ঘামানো হয়নি। প্রসবজনিত জটিলতায় মা ও শিশুর মৃত্যুহার ছিল লাগামছাড়া, নারীর মৃত্যু হত যখন তখন, বাড়ির পুরুষদের হেলদোল ছিল না। এ কাল যখন শুরু হল বইতে পুণ্যলতা চক্রবর্তী বলেছেন প্রাসাদোপম বাড়ির আঁতুড়ঘর তৈরি হয় গোয়ালে, ধনী পরিবারের এক বধূর পর পর তিনটি সন্তান মারা গিয়েছিল।

বইটিতে সে কালের বহু নারীর আত্মকথা, বই, পত্রিকা ও সাময়িকপত্রের উদ্ধৃতি, সুলুকসন্ধান দিয়েছেন লেখক। আছে পুণেতে জ্ঞানদানন্দিনী ও সত্যেন্দ্রনাথের বাড়ি বেড়াতে গিয়ে স্বর্ণকুমারী দেবীর আকস্মিক প্রসবের কথা। কবিপত্নী মৃণালিনীর কী অসুস্থতা ছিল, কী চিকিৎসা হয়েছিল, সে সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট তথ্য মেলে না। চোদ্দোটি জীবিত সন্তানের জনক দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের গর্ভভাবনার সঙ্গে চরক-সুশ্রুতের লেখার সাদৃশ্য খুঁজে পেয়েছেন লেখক, যা কিছুটা কষ্টকল্পিত মনে হয়।

আরও পড়ুন
Advertisement