Book

ক্ষমতার লোভে ধর্ম নিয়ে ছলনা

ইতিহাস হয়তো মনের খোঁজ রাখে না, কিন্তু উপন্যাস রাখে।

Advertisement
অমিয় দেব
শেষ আপডেট: ১৪ মার্চ ২০২০ ০০:১০
স্মারক: মালদহের পান্ডুয়ার একলাখি সমাধিভবন। এখানেই সমাহিত রয়েছেন যদু বা জালালুদ্দিন।

স্মারক: মালদহের পান্ডুয়ার একলাখি সমাধিভবন। এখানেই সমাহিত রয়েছেন যদু বা জালালুদ্দিন।

এই উপন্যাসের প্রথম পাঠ, ‘ধর্ম ও সিংহাসন’, ২০১৪-র শারদীয় ‘আজকাল’-এ বেরিয়েছিল। তাকে অবলম্বন করে এক নাটকও মঞ্চস্থ হচ্ছে কিছু দিন। তারই নাম থেকে এ-বইয়ের নাম ‘ধর্মায়ুধ’। ধর্ম যে সিংহাসনেরও অস্ত্র হতে পারে তারই এক উদাহরণ আছে এই ঐতিহাসিক উপন্যাসে। বাংলার সুলতানি আমলের গল্প। ১২০৪-র গল্প আমরা জানি: সেই যে ‘দৌড়! দৌড়! দিলেন দৌড়/ গৌড় থেকে বঙ্গ/ লক্ষ্মণসেন রাজা, তাঁর/ রাজ্য হলো ভঙ্গ।’ এর পরের সাড়ে পাঁচশো বছরে এক বারই এক হিন্দু রাজা গৌড়ের সিংহাসনে বসেছিলেন। পঞ্চদশ শতকের গোড়ার দিকে। নাম গণেশদেব। রাজ্যের এক অতি ক্ষমতাশালী ভূস্বামী ও অমাত্য। তখন ইলিয়াস শাহি বংশের রাজত্ব চলছে। ইলিয়াস-পুত্র সিকান্দার শাহের উত্তরাধিকার নিয়ে যখন প্রশ্ন উঠেছিল— বড় রানি চাইছিলেন তাঁর সতেরো পুত্রের জ্যেষ্ঠকে আর বৃদ্ধ সিকান্দার মনে-মনে ছোট রানির পুত্র গিয়াসউদ্দিনকে— তখন গণেশদেব গিয়াসউদ্দিনকে আপন মন্ত্রণাদাতা তীক্ষ্ণবুদ্ধি নরসিংহ নাড়িয়ালের কাছে পাঠিয়ে, কার্যকর পরামর্শ ও সাহায্য জুগিয়েছিলেন। সেই মতো, গিয়াসউদ্দিন ধীরে ধীরে দক্ষিণ ও পূর্ব বঙ্গের বিস্তীর্ণ অঞ্চল দখল করেন, স্বনামে মুদ্রাও উৎকীর্ণ করেন, এবং অবশেষে গৌড়ের সেনাবাহিনীর সঙ্গে মোকাবিলার উদ্দেশ্যে সসৈন্য এগিয়ে যান। আর যে-কাতর ও স্নেহার্দ্র চিঠি পুত্রকে পাঠিয়েছিলেন সিকান্দার তা তাঁর কাছে শেষপর্যন্ত পৌঁছয় যখন মৃত পিতার মস্তক কোলে নিয়ে তিনি যুদ্ধক্ষেত্রে বসে আছেন।

উপন্যাসে এই পিতা-পুত্রের গল্প তার পাশাপাশি চলা অন্য পিতা-পুত্রের গল্পের পটভূমি মাত্র। কারণ সিকান্দারের পরে গৌড়ের রাজা হয়েছিলেন গিয়াসউদ্দিন আজম শাহ। তিনি রাজত্ব করেছিলেন পূর্ণ সময়। আর তার পর রাজা হন তাঁর পুত্র সৈফুদ্দিন হামজা শাহ। তাঁর রাজত্বের তিন বছরের মাথায় তাঁর ক্রীতদাস শিহাবুদ্দিন তাঁকে হত্যা করে রাজা হলেন। (‘‘এই হত্যার পেছনে যে গণেশদেবের হাত ছিল না, এ কথা রাজসভার কেউই বিশ্বাস করেনি।’’) শিহাবুদ্দিন রাজা নামেই, সর্বেসর্বা গণেশদেবই। দু’বছর পরে তাঁর বিরুদ্ধতা করতেই গণেশদেব তাঁকে হত্যা করলেন। রাজা করলেন তাঁর বালক পুত্র ফিরোজকে। কয়েক মাস পরেই ফিরোজকে সরিয়ে রাজা হলেন তিনি নিজেই। পরে ফিরোজকেও হত্যা করলেন। আর এই সবেতেই তাঁর পরামর্শদাতা নরসিংহ নাড়িয়াল যিনি হলেন তাঁর প্রধানমন্ত্রী ।

Advertisement

উপন্যাসের শুরুতে আছে এক প্রায়শ্চিত্তের বিশদ প্রস্তুতি। তৈরি হচ্ছে ষোলোটি স্বর্ণাবৃত ধেনুর আকার। তাদের ভিতর দিয়ে অতিক্রান্ত হয়ে তাঁর গোবধ পাপক্ষালন করতে হবে রাজা গণেশদেবের জ্যেষ্ঠপুত্র রাজকুমার যদুসেনকে যাঁর ইসলামে ধর্মান্তরণ হয়েছিল। আর ওই [পরিকল্পিত] ধর্মান্তরণের সহায়তাতেই তো গণেশদেব জৌনপুরের সুলতান ইব্রাহিম শর্কির সঙ্গে সন্ধি করে গৌড়ের সিংহাসন ধরে রাখতে পেরেছিলেন। সন্ধির ফলে, রাজকুমার যদুসেন জালালুদ্দিন মুহম্মদ শাহ-এ রূপান্তরিত হয়ে গৌড় শাসন করছিলেন; কিন্তু দু’বছর পরেই গণেশদেব এসে পুত্রকে নামিয়ে দ্বিতীয় বার সিংহাসনে বসেন। আর এ বার এক উপাধিও তিনি ধারণ করেন, ‘দনুজমর্দনদেব’। এবং তৎকর্তৃক উৎকীর্ণ মুদ্রায় ওই উপাধির উল্টো পিঠে যোগ করেন ‘শ্রী চণ্ডীচরণপরায়ণ’ কথাটি। বাকি রইল, পূর্বপরিকল্পনা অনু্যায়ী, প্রায়শ্চিত্ত করে জালালুদ্দিন মুহম্মদ শাহ থেকে রাজকুমারের পুনরায় যদুসেনে রূপান্তর। প্রায়শ্চিত্তের বিধি স্থির করে দিয়েছেন সভাপণ্ডিত অনুগ্রহ মিশ্র।

ধর্মায়ুধ
অভিজিৎ সেন
২২০.০০
সুপ্রকাশ

এখানেই এই পিতা-পুত্রের সম্পর্কে জটিলতার সূত্রপাত। তাঁর ধর্মান্তরণের সময় তাঁর সঙ্গে ধর্মান্তরিত না হয়ে, তাঁর অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী যে তাঁকে ত্যাগ করে পিত্রালয় চলে গিয়েছিলেন, সেই বেদনা পুত্র সয়েছেন। পিতাকে অমান্য করেননি। কিন্তু এই দু’বছরের রাজত্বে তাঁর চোখ খুলে গিয়েছে। নানান দূর দেশের সঙ্গে তাঁর, ও তাঁর মাধ্যমে গৌড়ের, সসম্মান সম্পর্ক হয়েছে। এবং ইসলামের আপেক্ষিক আধুনিকতাও উপলব্ধি করেছেন। তাঁর মিশরদেশীয় উপপত্নী মারি মাগদালিকে তিনি প্রায়শ্চিত্তের আগেই ইসলামি প্রথায় বিয়ে করবেন, এই শর্তেই রাজি হলেন ওই উদ্ভট ধেনুপরিক্রমায়। তিনি পিতাকে ভক্তি করেন। আর তাঁর আবাল্য শিক্ষাগুরু নরসিংহ নাড়িয়ালের কাছে যখন শুনলেন গণেশদেব মধুমেহে ভুগছেন, তখন আর দ্বিধা করলেন না।

বছর দুই পরে যখন গণেশদেব প্রায় মরণাপন্ন তখন তা গোপন রাখা হল, এবং তাঁর ইচ্ছায় তাঁকে তাঁর আপন ভূমে নিয়ে যাওয়া হল। কিন্তু কয়েক দিনের মধ্যেই তাঁর মৃত্যুর গুজব শোনা গেল। পরে তা ঘোষণাও হল। সেই সঙ্গে এও ঘোষণা হল যে গৌড়ের সিংহাসনে তাঁর স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন তাঁর দ্বিতীয় পুত্র মহেন্দ্রদেব। এরই এক ফাঁকে যদুসেন-জালালুদ্দিন গোপনে রাজধানী ছেড়ে পশ্চিমাভিমুখে নিষ্ক্রান্ত হলেন। নরসিংহ নাড়িয়াল মহেন্দ্রদেবের নামেও তাঁর পিতার মতোই ‘শ্রী চণ্ডীচরণপরায়ণ’-সহ মুদ্রা উৎকীর্ণ করালেন। কিন্তু ইতিহাস তৃতীয় মুদ্রার অপেক্ষায় রইল। আর সত্যিই তা আবির্ভূতও হল— দু’চার মাসের মধ্যেই সসৈন্য জালালুদ্দিন এসে ছাউনি ফেললেন। আর গৌড় তাঁকেই রাজা হিসেবে গ্রহণ করল। এবং যে-নতুন মুদ্রা উৎকীর্ণ হল তাতে লেখা রইল: ‘জালালুদ্দুনিয়া ওয়াদ্দিন আবুল মুজাফফর মুহম্মদ শাহ আস-সুলতান’। তাঁর যদুত্বের কোনও চিহ্নই রইল না। পান্ডুয়ার একলাখি প্রাসাদে তিনি শুয়ে আছেন তাঁর স্ত্রী ও পুত্রের সঙ্গে।

ইতিহাস হয়তো মনের খোঁজ রাখে না, কিন্তু উপন্যাস রাখে। জালালুদ্দিন শাহ হয়ে দু’বছর সগৌরব রাজত্বের পর তিনি যখন পুনরায় রাজকুমার: তাঁর মন তিনি মাঝে মাঝে মেলে ধরছেন স্বর্ণধেনু নির্মাণের দায়িত্বপ্রাপ্ত শ্রেষ্ঠী লক্ষ্মীপতির কাছে, বা গুরুদেব নরসিংহ নাড়িয়ালের কাছেও, যাঁর বর্তমান লক্ষ্য রাজা গণেশদেব হলেও ভবিষ্যৎ লক্ষ্য তিনিই। এমনকি পিতাও তাঁর পুনর্ধর্মান্তরণে অনীহা আঁচ করতে পারছেন। আসলে ধর্ম নিয়ে তাঁরা যে-জুয়ো খেলেছিলেন, নাড়িয়াল ও তিনি, তা যে এমন উল্টে যাবে তা তো তাঁরা ভাবেননি। ভেবেছিলেন তাঁরা যে ভাবে ঘুঁটি সাজাচ্ছেন তাতেই বাজিমাত হবে। কিন্তু ইসলাম-স্পৃষ্ট যদুর যে সত্যিকার বয়োপ্রাপ্তি হবে, সে স্বাধীন বিচারবুদ্ধির অধিকারী হয়ে উঠবে, তা কে ভেবেছিল! যদি পিতার উচ্চাকাঙ্ক্ষার যূপে সে বলি হতে না রাজি হয়?

এই উপন্যাসের তিন প্রধান চরিত্রের মধ্যে যিনি খানিক রহস্যময় তিনি নরসিংহ নাড়িয়াল। শোনা যায় তিনি বাংলার শেষ সুগতপন্থী তথা বৌদ্ধদের এক জন। বহুদর্শী। আগত সুদূর শ্রীহট্ট থেকে, যেখানে তাঁর গৃহের নাম ‘উপকারিকা’— তাঁর শান্তিপুরের বাসভবনেরও তা-ই— অর্থাৎ বৌদ্ধ সমাবেশস্থল। তিনি মুণ্ডিতমস্তক বলেই ‘নাড়িয়াল’। (আর কথিত আছে এই নাড়িয়ালই শান্তিপুরনিবাসী চৈতন্যখ্যাত অদ্বৈত প্রভুর পিতামহ।) কিন্তু গণেশদেবের রাজসভায় তাঁর দেদীপ্যমান শিখা কি কিঞ্চিৎ ব্রাহ্মণ্য আভাস দেয় না? অথচ তিনি ঠিক ব্রাহ্মণ্যের প্রবক্তাও নন। তাঁর অভীপ্সা বোধ করি এক আর্য ভাবী কাল যেখানে হিন্দু-বৌদ্ধ মিলেমিশে আছে। কিন্তু গণেশদেবকে দিয়ে তিনি যা করাতে চাইছিলেন, এবং ভেবেছিলেন যদুসেনকে দিয়েও যা করাতে পারবেন, তার উল্টো খাতেই তো বইছে ইতিহাস। এর মধ্যেই কি বাংলার অনেকটা ইসলামে ধর্মান্তরিত হয়ে যায়নি? আর তার প্রত্যক্ষ হোতা (মসজিদ-নির্মাতা সুলতানরা হয়তো পরোক্ষ) সেই সুফি-পির-ফকির-দরবেশরা যাঁরা বাংলার অভ্যন্তরে ছড়িয়ে পড়েছিলেন। রাজধানীতে যিনি ক্ষমতাদৃপ্ত সেই নাড়িয়ালের রাজনীতি অবশেষে ব্যর্থ হল। যখন জালালুদ্দিন নতুন করে সিংহাসনে বসলেন, তখন কি তিনি শান্তিপুরের পথে? না কি বানপ্রস্থে? উপন্যাস নীরব। জালালুদ্দিন-উৎকীর্ণ মুদ্রা পাঠেই উপন্যাসের ইতি।

ক্ষমতার গল্প অভিজিৎ সেন আগেও লিখেছেন। এ বারের গল্প সিংহাসন নাম্নী ক্ষমতার লোভে ধর্ম নিয়ে ছলনার। দূরদৃষ্টি থাকে না ক্ষমতার। যে-ইতিহাস বাংলায় ইসলামকে নিয়ে এসেছে সেই ইতিহাসই যে বৈষ্ণব ভক্তির বন্যা বইয়ে দেবে কিছু দিন পরেই, তা কি ক্ষমতা ভাবতেও পেরেছিল!

আরও পড়ুন
Advertisement