book review

যে জলহাওয়ায় তৈরি হন তিনি

রচনাটির সঙ্গে এ বইয়ে ছাপা হয়েছে তাঁর মহানগর ছবির বুকলেটের প্রচ্ছদ, তলায় লেখা: ‘ফিমেল প্রোটাগনিস্ট’।

Advertisement
শিলাদিত্য সেন
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৬ মে ২০২৩ ০৯:১১
দ্বন্দ্ব: মহানগর ছবিতে মাধবী মুখোপাধ্যায় ও অনিল চট্টোপাধ্যায়

দ্বন্দ্ব: মহানগর ছবিতে মাধবী মুখোপাধ্যায় ও অনিল চট্টোপাধ্যায় — ফাইল চিত্র।

যে জলহাওয়ায় বেড়ে উঠেছিলেন, সেখানে কোনও কুসংস্কার কখনও ছায়া ফেলতে পারেনি— এ ভাবে নিজের শৈশবের অনুষঙ্গ নিয়ে আসেন সত্যজিৎ, ‘নারী’ শীর্ষক একটি রচনায়। সেখানে তাঁর মা সুপ্রভা রায়ের কথা আছে। খুব ছোটবেলায় বাবাকে হারানোর পর যখন মামাবাড়ি চলে আসেন, দেখতেন, প্রতি দিন মা বাসে চড়ে বিধবা মহিলাদের স্কুলে পড়াতে যেতেন, কলকাতার দক্ষিণ থেকে সুদূর উত্তরে। লিখছেন: “এভিডেন্সেস অব এমানসিপেশন ওয়্যার অল অ্যারাউন্ড মি, বাট আই ওয়াজ় টু ইয়ং টু আন্ডারস্ট্যান্ড।”

রচনাটির সঙ্গে এ বইয়ে ছাপা হয়েছে তাঁর মহানগর ছবির বুকলেটের প্রচ্ছদ, তলায় লেখা: ‘ফিমেল প্রোটাগনিস্ট’। প্রোটাগনিস্টের অভিনয়ে ছিলেন মাধবী, এ তো সর্বজনবিদিত, তা নিয়ে সত্যজিৎ তাঁর মত জানিয়েছেন আর একটি লেখায়: ‘মাধবী চক্রবর্তী’। মৃণাল সেনের বাইশে শ্রাবণ দেখে তাঁকে ছবিতে নিয়েছিলেন সত্যজিৎ, লিখছেন, তাকে অল্পই বলতে হত, বাকিটা সে নিজেই করে নিত। অনেকগুলি ভূমিকা ছিল চরিত্রটির, স্বামীর কাছে সে স্ত্রী, শ্বশুর-শাশুড়ির কাছে বৌমা, ছেলের কাছে মা, ননদের কাছে বৌদি। একই সঙ্গে আবার ‘সেলসউওম্যান’, সহকর্মীদের সঙ্গে সম্পর্কের পাশাপাশি আবার বসের সঙ্গে দ্বন্দ্ব। পরিচালকের মতে: ‘আ ভেরি ডিমান্ডিং, কমপ্লিকেটেড, কমপ্লেক্স রোল’।

Advertisement

শুধু মহানগর নিয়েই আরও একটি লেখা আছে এ বইতে সত্যজিতের, তাতে তিনি কাহিনিকার নরেন্দ্রনাথ মিত্রের বিরল সংবেদনশীল মন ও সততার কথা বিশেষ ভাবে উল্লেখ করেছেন: ‘আ স্টোরি দ্যাট কোয়েশ্চেনড ট্র্যাডিশনাল মিডল-ক্লাস ভ্যালুজ়’। নরেন্দ্রনাথের এই আধুনিকতাই তাঁর সঙ্গে শৈল্পিক মিথস্ক্রিয়ায় মাততে প্রাণিত করেছিল সত্যজিৎকে। মধ্যবিত্ত মূল্যবোধে মোড়া এক গৃহবধূ, তার পারিবারিকতা, কর্মস্থল— সব জায়গাতেই যে স্থূল অনড় ধ্যানধারণাগুলি চেপে বসেছিল, সত্যজিতের সপ্রশ্ন ছবি যেন নাড়িয়ে দিয়েছিল সে-সব। মেয়েটির সঙ্গে স্বামীর বা তার পরিবারের, পেশার, সমাজের যে দ্বন্দ্ব তা প্রকাশ্যে এনে ফেলেছিল এই ছবি। বড় শহরের নিষ্ঠুর মুখচ্ছবি, মেয়েদের কাজের জগতের নানা অসঙ্গতি, অলিখিত পারিবারিক বিধিনিষেধ বা পিছুটান এই প্রথম ভারতীয় ছবিতে এত বড় হয়ে দেখা দিল। মধ্যবিত্ত চাকরিরত ভারতীয় মেয়েদের সম্পর্কে এক নতুন বোধ বা ভাবনার জন্ম দিল ছবিটি।

অনেক পরে আশির দশকের শেষে অ্যান্ড্রু রবিনসন যখন সত্যজিৎ সম্পর্কিত দি ইনার আই গ্রন্থিত করলেন, তখন তাঁকে সত্যজিৎ জানান, তিনি প্রথমে মহানগর ছবিটির ইংরেজি নাম ‘দ্য বিগ সিটি’ রাখতে চাননি, চেয়েছিলেন ‘আ উওম্যান’স প্লেস’, মেয়েদের অবস্থান বোঝাতে। ১৯৬৩-তে মুক্তিপ্রাপ্ত মহানগর-এর ষাট পূর্তি এ বছর, আর গত বছরই আশি পূর্ণ করলেন মাধবী।

সম্প্রতি পেরোনো জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে সত্যজিৎ রায়ের এ রকম আরও নানাবিধ রচনা, ছড়ানো-ছিটানো, দুই মলাটের মধ্যে সঙ্কলিত করে সত্যজিৎ রায় সোসাইটি-র সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে পেঙ্গুইন বুকস তাদের ‘দ্য পেঙ্গুইন রে লাইব্রেরি’ থেকে প্রকাশ করেছে আলোচ্য বইটি। ছবি তৈরি ও ছোটদের জন্য লেখালিখির পাশাপাশি ফিল্ম সোসাইটির পত্রপত্রিকা, সংবাদপত্র, সাময়িকপত্র, ফেস্টিভ্যাল কর্তৃপক্ষের অনুরোধে মাঝেমাঝেই সেখানে লিখতে হত সত্যজিৎকে। এমনকি প্রিয় মানুষজনের ফিল্ম, ফোটোগ্রাফি, পেন্টিং, অনুবাদ, গানের রেকর্ডের উপরেও লিখতে হত। এই যে বিভিন্ন ধরনের টুকরো টুকরো কথা কিংবা গদ্য, তাতে তাঁর শিল্পচিন্তার বৈচিত্রটাই ধরা পড়ে। গ্রন্থটির নির্মাণে সন্দীপ রায়ের সযত্ন সম্পাদনায় সহযোগী ছিলেন ঋদ্ধি গোস্বামী, দেবাশিস মুখোপাধ্যায়, প্রচ্ছদসজ্জা অলঙ্করণে পিনাকী দে, প্রচ্ছদের ছবিটি প্রয়াত নিমাই ঘোষের তোলা।

বইটির বড় সম্পদ, সিনেমা নিয়ে সত্যজিতের এক গুচ্ছ রচনা, বিভাগটির নাম: ‘আ ডিরেক্টর’স পার্সপেক্টিভ’। পঞ্চাশ, ষাট, সত্তর, আশি... মোটামুটি চার দশক ধরে বিভিন্ন সময়ে তাঁর লেখালিখি। এর পিছনে তাঁর অভিপ্রায়ের কথা তাঁকে উদ্ধৃত করেই মুখবন্ধে জানিয়েছেন সম্পাদক: “পারহ্যাপস অ্যাট দ্য ব্যাক অব মাই মাইন্ড দেয়ার আর স্টিল রেমন্যান্টস অব দ্য জ়িল টু স্প্রেড দ্য ফিল্ম কালচার...।” যে খেদটা তাঁর উল্লিখিত রচনাদির প্রায় প্রতিটিতেই ঘুরেফিরে আসে তা হল, বাংলা বা ভারতীয় ছবিতে এক দিকে যেমন স্বাদেশিকতা কিংবা শিকড়ের অভাব, অন্য দিকে তেমনই তা চলচ্চিত্রীয় ভাষার দিক থেকে অপুষ্ট, রুগ্‌ণ। স্বাধীনতা-পূর্ব বাংলা সবাক ছবিতে গুণী কলাকুশলীরা ক্যামেরা সাউন্ড এডিটিং ইত্যাদি কারিগরি দিকগুলিতে চমৎকার পারিপাট্য এনে ফেলা সত্ত্বেও বাঙালি জীবনের স্বাভাবিক চেহারাটা ধরা পড়ত না, প্রকৃত বাস্তবের বদলে বিলিতি পালিশ দেওয়া বাস্তবটাই চোখে পড়ত বেশি। তৎকালীন পরিচালকদের বিশিষ্টতার কথা উল্লেখ করেও সত্যজিৎ ১৯৫২-য় প্রকাশিত দ্য ক্যালকাটা মিউনিসিপ্যাল গেজেট-এ লিখতে বাধ্য হচ্ছেন: “আওয়ার ডিরেক্টরস হ্যাভ নট ইয়েট লার্নড দ্য ল্যাঙ্গুয়েজ অব সিনেমা।”

আসলে কবিতা নাটক গল্প উপন্যাস চিত্র ভাস্কর্য সঙ্গীত নৃত্য অভিনয়— এই সব সাবেক শিল্পরূপের সঙ্গে আমাদের পরিচয় অনেক দিনের, তুলনায় ফিল্মের সঙ্গে পরিচয়টা নতুন, গত শতকের প্রথমার্ধে। তা ছাড়া আধুনিকতার সংজ্ঞা, তা সে পশ্চিমি অভিঘাতেই হোক বা দেশি অভিঘাতে, তাকেও আমরা ওই সব সাবেক শিল্পের প্রকরণে সাজিয়ে নিতে পেরেছি ঢেলে। কিন্তু ফিল্মের মতো অপরিচিত, আপাদমস্তক যন্ত্রনির্ভর মাধ্যমটির ক্ষেত্রে তা আমরা পেরে উঠিনি। আমাদের শিল্পভাবনার আধুনিকতায় ফিল্মের প্রকরণ অনাত্মীয় রয়ে গেছে গোড়া থেকেই। ক্রমে-ক্রমে ফিল্মের যন্ত্রনির্ভরতার সঙ্গে এক ধরনের আত্মীয়তা তৈরি হয়েছে আমাদের, কিন্তু যন্ত্রকে নিঃশেষে ব্যবহার করে কী ভাবে পৌঁছনো যেতে পারে শিল্পের বিমূর্ততায়, সে শিক্ষা সম্পূর্ণ হয়নি আজও। আঙ্গিক তৈরি হয় শিল্পীর শিল্পভাবনার নিজস্বতায়, মননসঞ্জাত বীক্ষায়, শুধুমাত্র ফিল্ম বানানোর কারিগরি কৌশলের উপর নির্ভর করে নয়। ফলে ফিল্মের আধুনিক ভাষার জন্ম দিতে পারেন একমাত্র সেই শিল্পীই, যাঁর শিল্পরূপের অভিব্যক্তি ছুঁয়ে থাকে সৃষ্টির তাত্ত্বিকতা থেকে প্রায়োগিকতা অবধি দুই প্রান্ত... যেমন সত্যজিৎ রায়।

তিনি তাই যে শিল্পভাবনা থেকে ছবি বানাতেন, সে ভাবনার কথাই লিখে গিয়েছেন অবিরত, আজীবন। এ-বইয়ের প্রথমেই যে লেখাটি, নিজের সম্পর্কে, ‘আ সেল্ফ-পোর্ট্রেট’, অপ্রকাশিত অগ্রন্থিত ছিল এত দিন, সেখানেও লিখছেন, ছবির জন্য যখনই গল্প বাছেন তখন সেটির বিষয়বস্তুর পাশাপাশি সমান গুরুত্ব পায় তার ‘অ্যাবস্ট্রাক্ট ফিল্মিক কোয়ালিটিজ়’।

বইটি সত্যজিতের শিল্পভাবনা বোঝার জন্যে যতটা জরুরি, ততটাই জরুরি শিল্পসন্ধানী সত্যজিৎকে জানার জন্যেও। সে ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ আর তাঁর শান্তিনিকেতন কী ভাবে ছেয়ে ছিলেন তাঁর মনে, তেমন একটি লেখার কথা বলে এই বইবৃত্তান্তটি এ বার থামানো যাক।

শান্তিনিকেতনের কাছে ততটাই ঋণী তিনি, যতটা ইউরোপ ও আমেরিকার সিনেমার কাছে, এ কথা যখন লিখছেন সত্যজিৎ, তখন তাঁর দিনান্তবেলা। ১৯৯১-এর ১ অগস্ট দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকায় বেরিয়েছিল লেখাটি, নাম দিয়েছিলেন ‘হোম অ্যান্ড দ্য ওয়ার্ল্ড’, হয়তো রবীন্দ্রনাথের উপন্যাস অবলম্বনে নিজের ঘরে-বাইরে ছবির কথা মনে রেখে, হয়তো বা দেশজ শিকড়কে কী ভাবে সিনেমা পৌঁছে দিতে পারে বিশ্ববোধে— মনে রেখেও। স্বাভাবিক ভাবেই এ-লেখায় রবীন্দ্রনাথ আছেন অনেকখানি জুড়ে, আছে তাঁকে বালকবেলায় উপহার-দেওয়া কবির সেই পদ্যখানির উল্লেখ: “দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া/ ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া/ একটি ধানের শিষের উপরে/ একটি শিশিরবিন্দু।” এটি বার বার ঘুরেফিরে আসত তাঁর মনে, পথের পাঁচালী-র নির্মাণপর্বে, গ্রামীণ জীবনের প্রত্যন্ত আবিষ্কারে... লিখেছেন সত্যজিৎ।

আর নিজেকে চেনানোর জন্যে সবচেয়ে প্রয়োজনীয় মন্তব্যটি আছে সত্যজিতের এই লেখায়: “শান্তিনিকেতন মেড মি দ্য কমবাইন্ড প্রোডাক্ট অব ইস্ট অ্যান্ড ওয়েস্ট দ্যাট আই অ্যাম।”

আরও পড়ুন
Advertisement