Book Review

সংস্কৃতির নিবিড় চলাচল

গত কয়েক দশকে মানববিদ্যাচর্চার কাঠামোর আঙ্গিকে যে প্রায় বৈপ্লবিক কিছু পরিবর্তন হয়েছে, তার ভিতর থেকেই যুক্তি তুলে এনেছেন সম্পাদকেরা।

Advertisement
সুমিত চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ২৬ অক্টোবর ২০২৪ ০৫:১১
প্রাচীন: প্য়ালাডিয়ান শৈলীর স্থাপত্য-নমুনা। মদন মিত্র লেন, উত্তর কলকাতা।

প্রাচীন: প্য়ালাডিয়ান শৈলীর স্থাপত্য-নমুনা। মদন মিত্র লেন, উত্তর কলকাতা। ছবি সৌজন্য: অমিতাভ পুরকায়স্থ।

‘বেঙ্গল’ ও ‘ইটালি’ এই দুই ভূখণ্ডকে এক সূত্রে বেঁধে নেওয়ার চেষ্টা করে এই বইয়ের শিরোনাম। দু’টি ভিন্ন ভূখণ্ড— একটা অঙ্গরাজ্য আর একটা দেশকে এক সঙ্গে নিয়ে চিন্তা করার প্রচেষ্টায় চমক রয়েছে নিঃসন্দেহে। চমক ভাঙলে পাঠকের মনে কিছু প্রশ্ন স্বাভাবিক ভাবেই উঠে আসে। এই ধরনের চিন্তার ঐতিহাসিক যুক্তি কী? বিদ্যায়তনিক পরিসরে এই ধরনের কাজের মান্যতা আছে কি? আপাতদৃষ্টিতে দু’টি প্রায় সম্পর্কহীন ভূখণ্ডকে নিয়ে দেড়শো বছরের কালপর্বের একটা সম্পর্কের দলিল প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা ও প্রয়োজনীয়তা নিয়ে বহু প্রশ্ন ভিড় করে আসবে মনে। এই প্রশ্নের উত্তর যে দিতে হবে, সে কথা বিলক্ষণ জানেন দুই সম্পাদক। বইয়ের মুখবন্ধে তাই সবিস্তার আলোচনা করেছেন তাঁদের প্রকল্পের তাত্ত্বিক যুক্তি বিষয়ে।

Advertisement

গত কয়েক দশকে মানববিদ্যাচর্চার কাঠামোর আঙ্গিকে যে প্রায় বৈপ্লবিক কিছু পরিবর্তন হয়েছে, তার ভিতর থেকেই যুক্তি তুলে এনেছেন সম্পাদকেরা। ‘স্পেস’ বা পরিসর সংক্রান্ত যুক্তির নব্য মান্যতাকে হাতিয়ার করে আধুনিকতার চলতি ছককে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন শুরুতেই। মডার্নিটির ‘নেশন’ সংক্রান্ত চিন্তার কাঠামো থেকে যে হালের বিদ্যায়তনিক চর্চা অনেকটাই বেরিয়ে এসেছে গোলকায়ন ও নব্য-উদারবাদের যুক্তি আশ্রয় করে, সে কথাই দাগিয়ে দিতে চাইছেন তাঁরা। ‘ইন্টারন্যাশনাল’, ‘ট্রান্সন্যাশনাল’ বা ‘কসমোপলিটান’— এই তাত্ত্বিক লব্জকে হাতিয়ার করে ‘সুপ্রা-লোকাল’-এর যুক্তিকে এগিয়ে দিতে চেয়েছেন এই সন্দর্ভে। ইতিহাসের যে যুক্তিকে তাঁরা আশ্রয় করতে চাইছেন তা কোনও বিমূর্ত তাত্ত্বিক মান্যের প্রতি বাধ্য না থেকে বরং ধরতে চাইছে ‘কমন সেন্স’কে, বা আঞ্চলিক নৈতিকতার ধারণাকে, কিংবা ব্যক্তিগত বা লোকায়ত কাঠামোতে প্রোথিত ডিসকোর্সের অভ্যাসকে। সে কারণেই তাঁদের কাছে ‘নেশন’ এর ধারণার থেকে অনেক বেশি গুরুত্ব পেয়েছে ‘কালচার’ বা সংস্কৃতির ধারণা। ‘কালচার’ বলতে তাঁরা ঠিক কী বুঝিয়েছেন তাও স্পষ্ট করে দেন ওঁরা: “বাই ‘কালচার’ উই মিন টু রেফার টু রিজনাল হেরিটেজেস ইন দ্য প্লুরাল, দ্যাট ইজ়, আ ডাইভার্স সেট অব ভ্যালুজ় অ্যান্ড মিনিংস দ্যাট ভেরিয়াসলি কম্বাইন টু প্রোভাইড আ কনটেক্সট ফর দি এক্সপ্রেশন অব আ কমিউনিটি অ্যান্ড ইটস ইনার কম্পোনেন্টস।”

সঙ্কলনে যে সব প্রবন্ধ স্থান পেয়েছে তাদের মূল উদ্দেশ্য, প্রায় দু’শো বছর যাবৎ চলমান এক সাংস্কৃতিক লেনদেনের আখ্যান সামনে আনা। ইউরোপ ও এশিয়ার মধ্যে যে সতত চলমান এক সাংস্কৃতিক লেনদেনের ধারা অন্তর্নিহিত, যার একটা ‘লোকাল’ ও ‘গ্লোবাল’ নিরিখ উপনিবেশের বিবিধ বয়ান ব্যতিরেকে সর্বদাই প্রতীয়মান ছিল, এ কথাই চোখে আঙুল দিয়ে দেখানোর চেষ্টা করে সঙ্কলনটি। ইতিহাসচর্চার বৃহৎ মান্য ক্যানভাসের বাইরে যে অণু-ইতিহাসের সম্ভাবনা ক্রমাগত তৈরি হয়ে চলেছে গ্লোবালের সঙ্গে লোকালের, এই লেনদেন মারফত তাকেই চিহ্নিত করছে সঙ্কলনের প্রবন্ধগুলো, ইটালির সঙ্গে বাংলার চলাচলের প্রসঙ্গে। এই প্রসঙ্গেই মানববিদ্যাচর্চার ডিসকোর্সের অন্দরে সংস্কৃতির নতুনতর, ক্রমাগত চলমান ও মুহূর্তলব্ধ এক অর্থ উদ্ধার করতে চান সম্পাদকেরা: “‘কালচার’ দাস রেফারস টু ইটালি অ্যান্ড বেঙ্গল অ্যাজ় ট্রাভেলিং ইমেজেস, বোথ সেল্ফ-রিপ্রেজ়েন্টেড অ্যান্ড পারসিভড ফ্রম দি আউটসাইড, নট অ্যাজ় ফিক্সড ক্যাননস বাট রাদার অ্যাজ় মাল্টি-সাইডেড কমপ্লেক্সেস, ক্রিয়েটিং হিস্টরিক্যাল রিয়ালিটিজ় হুজ় স্পেসিফিক কনফিগারেশন ইজ় রিভিলড ইন দ্য মোমেন্ট অব এক্সচেঞ্জ।”

বেঙ্গল অ্যান্ড ইটালি: ট্রান্সকালচারাল এনকাউন্টারস ফ্রম দ্য মিড-নাইন্টিনথ টু দি আর্লি টোয়েন্টি-ফার্স্ট সেঞ্চুরি

সম্পা: পারমিতা চক্রবর্তী, মারিয়ো প্রেয়ার

৩৯.৯৯ পাউন্ড

রাটলেজ

এই স্বল্প পরিসরে সঙ্কলনের বিভিন্ন প্রবন্ধ ধরে আলোচনা সম্ভব নয়। তবু প্রেক্ষিত অনুযায়ী বিষয়ভিত্তিক যে ছকের নিরিখে এই সঙ্কলন সাজানো হয়েছে তার একটা পরিচয় দেওয়ার চেষ্টা করি। তিন ভাগে বিভক্ত আলোচনার পরিসর: প্রথম ভাগে সাহিত্য, সঙ্গীত ও নাটক নিয়ে তিনটি প্রবন্ধ। দ্বিতীয় ভাগের বিষয় স্থাপত্য, শিল্প ও চলচিত্র, এখানেও তিনটে প্রবন্ধ। শেষ ভাগে রয়েছে বাণিজ্য, ভ্রমণ ও রাজনীতি বিষয়ে আরও চারটি প্রবন্ধ। সুকান্ত চৌধুরী তাঁর প্রবন্ধে আলোচনা করেছেন, কী ভাবে উনিশ শতকের বাংলার চিন্তাজগতে ইটালীয় রেনেসাঁসের প্রভাব লক্ষ করা যায়। লুইসা প্রেয়ার তাঁর প্রবন্ধে আলোচনা করেছেন, কী ভাবে বিশ শতকের শুরুতে ইটালির সঙ্গীত পরিচালকেরা রবীন্দ্রনাথের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। মনোলীনা ভট্টাচার্য আলোচনা করেছেন উনিশ শতকের কলকাতার বসতবাড়িতে নিয়োক্লাসিক্যাল স্থাপত্যের প্রভাব নিয়ে। অন্য দিকে উনিশ শতকের মধ্যভাগ থেকে বিশ শতকের ত্রিশের দশক অবধি বঙ্গদেশের প্রেক্ষিতে ইটালির বিদেশনীতি কেমন ছিল, এই জটিল বিষয়ে প্রবন্ধ লিখেছেন মার্জিয়া কাসোলারি। মোটামুটি ওই একই সময় ইটালির সঙ্গে বাংলার বাণিজ্য ও ইটালীয় বণিকদের নিয়ে আলোচনা করেছেন আন্তোনেল্লা ভিয়োলা। ইটালিতে ভ্রমণ বিষয়ে উনিশ শতকের শেষ থেকে বিশ শতকের গোড়ার কয়েক বছর বাংলায় কী লেখা হচ্ছিল, তা নিয়ে লিখেছেন সংযুক্তা দাশগুপ্ত।

এমনই বেশ কিছু অভিনব ও সুলিখিত প্রবন্ধের সঙ্কলন এই বই। ইটালির সঙ্গে বাংলার যে এমন নিবিড় সাংস্কৃতিক চলাচল ছিল, এত বিচিত্র বিষয়কে ঘিরে ছিল একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ বা পারস্পরিক প্রভাব, এই তথ্য হাজির করার জন্যই পাঠকের ধন্যবাদ দাবি করতে পারেন গ্রন্থটির সম্পাদকদ্বয়।

আরও পড়ুন
Advertisement