Book Review

শতবর্ষের ইতিহাস: প্রথম খসড়া

দেশপ্রেমিক ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন সাংবাদিক প্রফুল্লকুমার সরকার ও সুরেশচন্দ্র মজুমদার এই ঐতিহ্যবাহী খবরের কাগজ প্রতিষ্ঠা করেন।

Advertisement
সুগত বসু
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৯ অগস্ট ২০২৩ ০৯:২৭

“মহাত্মা আজ শাসনশক্তির রোষে পতিত— কারাগারে বন্দী।” ১৯২২ খ্রিস্টাব্দের ১৩ মার্চ, দোলপূর্ণিমার দিন আনন্দবাজার পত্রিকা-র প্রথম সম্পাদকীয়তে লাল কালিতে এই কথাটি ছাপা হয়েছিল। ঠিক তার তিন দিন আগে, ১০ মার্চ, তাঁর ইয়ং ইন্ডিয়া পত্রিকায় ‘দেশদ্রোহী’ লেখা প্রকাশ করার অভিযোগে গান্ধীজি সাবরমতী আশ্রম থেকে গ্রেফতার হয়েছিলেন। ২০২২ সালের ১৩ মার্চ আনন্দবাজার-এর সম্পাদকীয়তে ১০ মার্চ উত্তরপ্রদেশে আদিত্যনাথের ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তন ও ‘হিন্দুত্ববাদের গৈরিক উল্লাস’ বিষয়ে মন্তব্য— “কংগ্রেসকে এই সমকালীন ইতিহাসের পাদটীকা বলিলেও অত্যুক্তি হয়। এক শত বৎসরে ভারত কোথা হইতে কোথায় পৌঁছাইল, এই দৃষ্টান্তটি তাহা নির্মম ভাবে জানাইয়া দেয়।”

Advertisement

কোথা থেকে আমরা কোথায় পৌঁছলাম? সুবর্ণ বসু তাঁর শতকথা বইয়ে লিখেছেন, “আনন্দবাজার পত্রিকা নিজেই যেন চলমান ইতিহাস।” সংবাদপত্রের খবর অবশ্যই অনেক সময় হয়ে ওঠে ইতিহাসের প্রথম খসড়া। সময়ের বহমানতা স্বীকার করেও, একটু অন্য চোখে দেখলে আজকের ভারতে ইংরেজ উপনিবেশবাদের উত্তরাধিকার আমরা প্রত্যাখ্যান করতে পেরেছি কি? আজও আমাদের দেশ ‘শাসনশক্তির রোষে পতিত’, স্বাধীন মতপ্রকাশের অধিকার সিডিশন আইন ১২৪(ক) ধারার নাগপাশে আবদ্ধ।

দুই দেশপ্রেমিক ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন সাংবাদিক প্রফুল্লকুমার সরকার ও সুরেশচন্দ্র মজুমদার এই ঐতিহ্যবাহী খবরের কাগজ প্রতিষ্ঠা করেন। সর্বভারতীয় ও আন্তর্জাতিক খবর পরিবেশন করেও এটি একটি খাঁটি বাঙালি প্রতিষ্ঠান। ১৯২২ সালের অগস্ট মাসে রবীন্দ্রনাথ পরিচালিত ‘বর্ষামঙ্গল’ অনুষ্ঠানের উপর একটি লেখা বেরোয়। শ্রীমতী চিত্রলেখার সুন্দর গানের জন্য তাঁর নাইটিঙ্গল উপাধিতে আনন্দবাজার-এর আপত্তি। “এ দেশে কত শ্যামা, বুলবুল, পাপিয়া, কোকিল থাকিতে নাইটিঙ্গল কেন? সব বিষয়ে বিলাতী কায়দা না হইলে কি আর হয় না?”

আনন্দবাজার পত্রিকা ও সমসমেয়ের শতকথা

সুবর্ণ বসু
৫০০. ০০

আনন্দ

১৯২৮ সালে সুভাষচন্দ্র বসুর সাবরমতী ও পন্ডিচেরি আশ্রমের পুরোধাদের জোরালো সমালোচনা আনন্দবাজার-এর ঠিক মনঃপূত হয়নি। তবে ত্রিশ ও চল্লিশের দশকে এই পত্রিকা সুভাষচন্দ্রকে পূর্ণ সমর্থন জানিয়ে গেছে। ইউরোপে নির্বাসন যাত্রার পথে জাহাজ থেকে ১৯৩৩ সালের ২ মার্চ লিখিত সুভাষচন্দ্রের বাংলার প্রতি বার্তা প্রকাশিত হয়েছিল ১১ মার্চ। সুভাষচন্দ্র লিখেছিলেন: “আমি সেই সম্মিলিত বিরাট বাংলাকেই স্বপ্ন দেখিতেছি— যে বাংলা মুসলমান বা হিন্দু, খৃষ্টান বা বৌদ্ধের নয়, উহা সকল বর্ণ, সকল সম্প্রদায়ের সম্মিলিত বাংলা।”

তিন বছর পর দেশে ফেরামাত্র ৮ এপ্রিল ১৯৩৬, যে দিন সুভাষচন্দ্র গ্রেফতার হলেন সে দিন আনন্দবাজার-এর পর্যবেক্ষণ: “সুভাষচন্দ্র শাসকগণের প্রতিদ্বন্দ্বী।” মে মাসে সুভাষ দিবস উপলক্ষে রবীন্দ্রনাথের বিবৃতি আনন্দবাজার-এ প্রকাশিত হয়েছিল। কবি লিখেছিলেন: “বিনা বিচারে যারা দণ্ড ভোগ করছে অপরিমিত কাল ধরে, তাদের মধ্যে দেশের যে বেদনা আছে, তার চেয়ে অনেক বড় করে আছে দেশের অসম্মান। বিচারের অধিকারে আছে মনুষ্যত্বের সম্মান।” ১৯৩৭-১৯৩৮ জুড়ে আছে আনন্দবাজার-এর পাতায় সুভাষচন্দ্রের স্থিরবুদ্ধি ও সংগঠন-প্রতিভার প্রশংসা। ১৯৩৯-এ সুভাষচন্দ্রের কংগ্রেস সভাপতি নির্বাচনে জয়ে ‘ক্ষুব্ধ ও রুষ্ট’ গান্ধীজির সমালোচনা ও হাই কমান্ডের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে রয়েছে কাগজের পূর্ণ সমর্থন। ১৯৩৯-এর ১৮ অগস্ট সুভাষচন্দ্রের কলকাতার দেশবন্ধু পার্কে বিরাট জনসভায় সভাপতিত্ব করেন সুরেশচন্দ্র মজুমদার স্বয়ং। তার পর দিন রবীন্দ্রনাথ ও সুভাষচন্দ্রের একত্রে মহাজাতি সদনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের ছবি-সহ বিবরণ।

“দেশের মানুষের মতো আনন্দবাজারও সেদিন বুঝতে পেরেছিল,” সুবর্ণ বসুর ব্যাখ্যা, “দেশকে স্বাধীন করতে হলে সুভাষচন্দ্রের মত ও পথই অবলম্বন করতে হবে।” সুভাষচন্দ্রের মহানিষ্ক্রমণের খবর প্রথমে প্রকাশিত হয়েছিল আনন্দবাজারহিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ড-এ, ২৭ জানুয়ারি ১৯৪১-এ। শরৎচন্দ্র বসু যেমন চেয়েছিলেন খবরটি ঠিক সেই ভাবেই সুরেশচন্দ্র মজুমদার পেশ করার ব্যবস্থা করেছিলেন ইংরেজের চোখে ধুলো দেওয়ার প্রয়োজনে। পঁচিশ বছরে পা দিয়ে ১৯৪৬-এর ১৭ মার্চ আনন্দবাজার লিখল: “নেতাজী সুভাষচন্দ্রের কর্মসাধনা ভারতীয় মুক্তি আন্দোলনের যাত্রাপথে যেন নূতন আলোক সম্পাত করিয়াছে। ১৯৪২ সালের পর হইতে অবসাদগ্রস্ত ভারত আজাদ হিন্দ ফৌজের প্রেরণায় বিদ্যুৎস্পৃষ্টের ন্যায় জাগিয়া উঠিয়াছে।”

১৯৪৭ সালের ১৫ অগস্ট আনন্দবাজার পত্রিকা-য় লেখা হয়েছিল: “এই খণ্ডিত বিচ্ছিন্ন ভারতের রক্তক্ষরা বেদনা ভুলিবার নহে।” দেশভাগের এই ট্র্যাজেডি রোধ করতে আনন্দবাজার-ও যে সদর্থক ভূমিকা পালন করতে ব্যর্থ হয়েছিল সে কথা এই বইয়ে ঊহ্য থেকে গেছে। ১৯৪৭-এর ব্যর্থতার প্রায়শ্চিত্ত খানিকটা করা গিয়েছিল ১৯৭১-এ বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের খবর পরিবেশনায়। সে বছর বাংলার সেরা সাহিত্যিক ও সাংবাদিকেরা বাঙালি পরিচয়ের শ্রেষ্ঠ সংজ্ঞা রচনা করেছিলেন এই পত্রিকায়।

আনন্দবাজার-এর সম্পাদকীয় নীতি কেন্দ্রে বা রাজ্যে ক্ষমতার অপব্যবহারের বিরুদ্ধে ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির পক্ষে জনমত গড়ে তোলা। ১৯৯২-এ বাবরি মসজিদ ধ্বংসের দু’দিন পর একটি মাত্র সম্পাদকীয় প্রকাশিত হয়েছিল: “সরযূ নদী তীরে মধ্যাহ্নে নামিয়া আসে অন্ধকার। শুরু হয় বর্বরতার উদ্দাম আস্ফালন।” তার এক দশক বাদে ২০০২-এ গুজরাতের দাঙ্গা বিষয়ে আনন্দবাজার-এর সম্পাদকীয় মন্তব্য: “গুজরাতের সদ্য নির্বাচিত মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বেহালা পছন্দ করেন, না বাঁশি, তাহা আমাদের জানা নাই। তবে প্রজারা যখন জীবন্ত অগ্নিদগ্ধ হইতেছে, লুণ্ঠিত হইতেছে, তখন তাঁহার পুলিশ যে লুঠেরা ও ঘাতকদের বাধা দিবার বিন্দুমাত্র চেষ্টা করে নাই, উপরন্তু দাঙ্গাকারীদের সাহায্য করিয়াছে, ইহার প্রমাণ বৈদ্যুতিন গণমাধ্যমের যুগে আড়াল করা কঠিন।”

রাজনীতি ছাড়াও কোর্ট-কাছারি থেকে শুরু করে খেলাধুলা পর্যন্ত নানা খবর আনন্দবাজার-এর পাতায় স্থান পেয়েছে। পত্রিকার একশো বছরের পুঁজি ব্যবহার করে আমরা অন্তত আরও দু’টি বই আশা করতে পারি কি? একটি হতে পারে মূল্যবান ফোটোগ্রাফের একটি সঙ্কলন। ১৯৩৪-এ বিহার ভূমিকম্পের ছবি তোলার পর বীরেন্দ্রনাথ সিংহ আনন্দবাজার-এ স্থায়ী চাকরি পেয়েছিলেন। তাঁর ও অন্যান্যের তোলা ঐতিহাসিক ছবি গ্রন্থাগারিক শক্তিদাস রায় নিশ্চয়ই বেছে দিতে পারবেন। দ্বিতীয় বইটি হতে পারে আনন্দবাজার-এ প্রকাশিত রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে বাংলার মনীষীদের বিভিন্ন বিষয়ে লেখার সমারোহ। সাহিত্য, সংস্কৃতি, অভিনয়, সঙ্গীত, চিত্রশিল্প, নৃত্যকলা, সিনেমা ও খেলা নিয়ে বিশিষ্টজনদের লেখা সমাদৃত হবে।

আজ সংবাদপত্রের স্বাধীনতা খর্ব করার লক্ষ্যে রাষ্ট্রশক্তি ও পুঁজিবাদের যৌথ আস্ফালন প্রকট রূপ ধারণ করেছে। তাই নব্বই বছর আগে ১৯৩৩ সালে আনন্দবাজার-কে পাঠানো রবীন্দ্রনাথের আশীর্বাণী আজও সমান প্রাসঙ্গিক: “তোমার লেখনী যেন ন্যায়দণ্ড ধরে/ শত্রুমিত্র নির্বিভেদে সকলের ’পরে।”

আরও পড়ুন
Advertisement