মানবিক লগ্নতা ও সহত্বের ভাবাদর্শে প্রাণিত

রণজিৎ গুহের ইতিহাসচিন্তার প্রবাহ বাঁকে বাঁকে নানা ছোট-বড়কে স্পর্শ করেছে।

Advertisement
গৌতম ভদ্র
শেষ আপডেট: ০৪ জানুয়ারি ২০২০ ০০:১৩
‘অসহিষ্ণুতার বাস প্রাত্যহিক জীবনযাপনে’

‘অসহিষ্ণুতার বাস প্রাত্যহিক জীবনযাপনে’

মানুষ সত্তাময় জীব। সত্তাময়তার প্রকাশই তো মানুষী চৈতন্য। এই মানুষী চৈতন্যের স্ফুরণ ঘটে চলে ভাষায়। পার্থিব সব প্রাণীর মধ্যে এই ভাষাবোধ ও সম্পদে মানুষ বলীয়ান। ভাষাসজ্জার মধ্যেই মানুষ বলে জীবটি তার কর্মকাণ্ড ও জ্ঞানকাণ্ডের সব ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও অনুভূতি ব্যক্ত করতে পারে। নিরবধি সময় ও বিপুলা পৃথ্বীর মধ্যে সত্তা, চৈতন্য ও ভাষার পারস্পরিক সম্পর্কের নির্দিষ্ট কালিক ও দৈশিক টানাপড়েনগুলির, কী কী চেহারা, ভারতে, আরও বিশেষ করে, ঔপনিবেশিক ও উপনিবেশ-উত্তর বাঙালি সংস্কৃতি ও সাহিত্যকৃতিতে ধরা পড়েছে, সৃষ্টিশীলতার কী কী সম্ভাবনা সেখানে অঙ্কুরিত ছিল, সেই সব অভিজ্ঞতার ভিন্ন ক্ষণ ও নানা নিদর্শনের বিশ্লেষণ দুই খণ্ডে সংবলিত রণজিৎ গুহের বাংলা রচনা সংগ্রহের উপজীব্য বিষয়। সত্তা, চৈতন্য ও ভাষাদর্শনের অন্বয়ে তৈরি পরিসরে ‘ইতিহাস-সমাজ-রাজনীতি’ ও ‘সাহিত্য’-এর নানা কথাই তো তিনি গত পঞ্চাশ বছর ধরে আলোচনা করেছেন।

রণজিৎ গুহের ইতিহাসচিন্তার প্রবাহ বাঁকে বাঁকে নানা ছোট-বড়কে স্পর্শ করেছে। মেদিনীপুরে লবণশিল্পে নিয়োজিত শ্রমজীবীদের খাটা-খাটুনি ও প্রতিবাদের ইতিবৃত্ত (১৯৫৪) বা ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সূত্রপাত’-এর মতো সন্দর্ভই তো তাঁর ইতিহাসচিন্তার আদি ঘাটচিহ্ন। সেই চিন্তার নবায়নের পরিণত স্বাক্ষর রয়েছে নিম্নবর্গের ইতিহাস রচনার প্রাকল্পিক নিবন্ধে (১৯৮২) বা স্বাধীনতা-উত্তর ভারতে নিম্নবর্গের প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের কুলুজি বিচার ও স্বরূপ বিশ্লেষণে। তাঁর ইতিহাস অন্বেষা আবার মোড় নেয়। তিনি অনুসন্ধিৎসু হয়ে ওঠেন আমাদের আধুনিক স্বাদেশিকতা ও জাতীয়তাবাদের সম্বন্ধ নির্ণয়ে, রামমোহন রায় ভাবিত দয়া ও বঙ্কিমচন্দ্র ভাবিত বাহুবলের বৈপরীত্য বিচারে (২০১০)। এই আলোচনাই প্রসারিত হয় উত্তররামচরিতের বিদ্যাসাগরী ও বঙ্কিমী পাঠের বিতর্কে, পারিবারিক ন্যায়ধর্ম ও লোকোত্তর রাজধর্মের নৈতিক বিচারে (২০১৩)। তাঁর খোঁজ চলতে থাকে। তারই ফল দেখি ধর্মনীতি ও রাজনীতির চিরায়ত ভারতীয় গ্রন্থের একটি মৌলিক পাঠে, ভারত যুদ্ধের ‘দু’-তিন দিন’-এর কথনে ও বিশ্লেষণে, ‘যে ভারতযুদ্ধের কাহিনি এখনও শেষ হয়নি,’ ‘কারণ কুরুক্ষেত্র ছড়িয়ে আছে সমগ্র মানবজাতির ইতিহাস জুড়ে’। মেদিনীপুরের নুন-উৎপাদক মলাঙ্গীদের জীবনবৃত্তান্ত থেকে ভারতযুদ্ধের কথা,— পর্বে পর্বে রণজিৎ গুহের ইতিহাস সন্ধিৎসা ছড়িয়ে পড়েছে ক্ষণকাল ও খণ্ডদেশ থেকে বহু কাল ও বৃহৎ দেশের বিশাল প্রসরে।

Advertisement

রণজিৎ গুহের সামগ্রিক চিন্তায় সত্তা, চৈতন্য ও ভাষাভাবনার ত্রিভুজে বিকশিত মানবিক বিদ্যার পরিসরে ইতিহাস চর্চা ও সাহিত্য সাধনা হয়তো অভেদ সম্বন্ধে আবদ্ধ নয়, কিন্তু তুতো ভাইয়ের মতো সুহৃদ, সমবায় ও সংযোগ সম্বন্ধে শ্লিষ্ট। সাহিত্য আলোচনার বিষয়তালিকা দীর্ঘ, আলোচনার প্রসারও অতি বিস্মৃত। যৌবনে লেখা ম্যাকবেথের অনুবাদ বিতর্ক থেকে প্রৌঢ়ে তিনি তাঁর অভিনিবেশ নিবদ্ধ করেছিলেন সমর সেনের কাব্যচৈতন্যে দায়বোধ ও জীবনানন্দ দাশের কবিতার সময়বোধের সঙ্গ ও অনুষঙ্গ বিচারে (১৯৮৮)। এর পরেই তাঁর লেখনী ধাবিত হয়েছে রবীন্দ্রনাথের ‘ত্রিগীত’ (গীতাঞ্জলি, গীতিমাল্য ও গীতালি) থেকে রবীন্দ্রোত্তর পর্বের তিন বিশিষ্ট কবির আমিত্বের বিশ্লেষণে (২০০৯-২০১১)। রণজিৎ গুহের মেধাচর্চা ক্লান্তিহীন। শেষে তাঁর অন্বিষ্ট হয়ে উঠল বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রকৃতি ও সাহিত্যভাবনায় স্বকাল থেকে মহাকাল, স্থানিক থেকে বিশ্ব তথা অধ্যাত্মজগতের চিন্তার অভিমুখে লেখক সত্তার অনুক্ষণ প্রসর্যমানতার লক্ষণ বিচার। এই সব অন্বেষায় তিনি অভিজ্ঞতা ও অভ্যাসের ঐতিহাসিকতা আর সাহিত্য বুদ্ধি ও মীমাংসার নিহিত সম্পর্ককে স্পষ্ট করে তুলেছেন। কোনও এক অতীত কালের অভিজ্ঞতাকে বর্তমানের বোধিতে ধরা, কোনও এক গোষ্ঠীর প্রাত্যহিক কিংবা নৈমিত্তিক খণ্ড অভ্যাসের বৈশিষ্ট্য থেকে বৃহত্তর কোনও সমূহের সাধারণ অভিজ্ঞানে উত্তরিত হওয়া ইতিহাসবিদ্যার ঈপ্সা। ঐতিহাসিকের চিন্তনে জাত যুক্তির বিন্যাসে ও লেখনী নিঃসৃত ভাষাসজ্জায় পরিশ্রমলব্ধ যাচাই করা তথ্যাবলি আকাঙ্ক্ষিত আখ্যানের রূপ পায়। সদৃশ ভাবেই নিজস্ব ঐকান্তিক অভিজ্ঞতা ও অনুভূতিকে সচেতন কবি সাহিত্যিক শব্দের ব্যঞ্জনায় ভাষিত ও প্রসারিত করে নানা দেশে ও কালে নিজের রচনাকে ভিন্ন ভিন্ন সহৃদয়ের হৃদয়সংবাদী করে তোলেন। চৈতন্যময় আমিটি তার আমিত্বকে অনেক সত্তার মধ্যে ছড়িয়ে দেয়, বহুর সঙ্গে কবি অহং-এর অন্তরঙ্গতা জমে ওঠে। ভাষার নানা নির্দেশ, যেমন নাম ও সর্বনামের খেলার নিয়ম, এই যাতায়াতকে সম্পন্ন করে। এই ভাবনাসূত্রেই তীক্ষ্ণ ইতিহাস অনুসন্ধিৎসার উপস্থাপনা ও নিবিড় সাহিত্যপাঠের অনুশীলন হয়ে ওঠে সহচারী, সমগোত্রীয় বুদ্ধিচর্চার শরিক। ফলে ইতিহাস-সমাজ-রাজনীতি ও সাহিত্য আলোচনার ক্ষেত্রে নানা বৈচিত্রময় লেখার সঙ্কলনে ভরপুর রচনা সংগ্রহটি বিন্যাসে দু’খণ্ডে বিভক্ত, অথচ আপাত ভেদের মধ্যে দুইটির অন্তর্লীন সম্পর্কের জের একদম আলগা হয়নি।

রচনাসংগ্রহ, খণ্ড ১-২
রণজিৎ গুহ
২০০০.০০
আনন্দ পাবলিশার্স

সামগ্রিক ভাবে রণজিৎ গুহের বাংলা রচনাসংগ্রহ পড়ার অভিজ্ঞতা আমাদের মতো পাঠককে অভ্যাসগত শৈথিল্য ও আলস্য থেকে ধাক্কা দিয়ে বই পড়াটাকেও সতর্ক ও বুদ্ধিমনস্ক কাজ বলে মনে করায়। প্রবন্ধ তো প্রকৃষ্ট বন্ধ, এই বাগর্থটি তাঁর রচনাশৈলীর ভিত্তি। প্রতিটি প্রবন্ধে উল্লিখিত ঐতিহাসিক নথি, নিবন্ধ, উপন্যাসের বয়ান বা কবিতার স্তবককে ছোট ছোট অনুপুঙ্খ, এমনকি একটি মাত্র পঙ্‌ক্তিতে ভাগ করে পাঠককে তাঁর নিজস্ব পাঠের সচেতন সঙ্গী করেছেন। অন্য পক্ষে ওই সব অনুপুঙ্খ বা পঙ্‌ক্তি ভাগের তাৎপর্য বিশ্লেষণের সময়ই দু’-একটি ইঙ্গিতে তিনি তাঁর বক্তব্যে ক্রমজায়মান বড় নকশারও আন্দাজ দিয়েছেন। প্রতিটি ফোঁড়ের টানটোনের মধ্যেই সামগ্রিক পটচিত্রটি কী ভাবে ফুটে উঠছে, সেই প্রক্রিয়াটি বাক্য-অনুচ্ছেদ-অধ্যায়ের পারম্পর্যগত নিপুণ বিন্যাসে ধরা পড়েছে। এই গদ্যশৈলী আজকের বাংলা ভাষায় অতি দুর্লভ, বঙ্কিমচন্দ্র, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত বা কমলকুমার মজুমদারের রচনারীতিকে মনে করিয়ে দেয়।

রণজিৎ গুহের বাংলা রচনার সঙ্গে কমবেশি ওয়াকিবহাল পাঠক মাত্রই জানেন যে অন্য ভাষার বিশিষ্টার্থক শব্দের সমদ্যোতক পরিভাষা তিনি তৈরি করতে আগ্রহী ও পটু। চার দশক আগে ‘নিম্নবর্গ’, ‘সর্বেশ্বরতা’ ও ‘আদিকল্প’ ইত্যাদি তাৎকালিক অপরিচিত পারিভাষিক শব্দগুলি তাঁরই বানানো। বাংলা ভাষায় হাল আমলে লেখা সমাজ ও রাজনীতির প্রবন্ধে ওইগুলি চালু শব্দ, সংবাদপত্রেও আকছার ব্যবহার করা হয়। এই রচনাসংগ্রহেও একাধিক অজানা ও নতুন পরিভাষার দেখা পাওয়া যায়, যেমন স্বগম (subjective), পরংগম (objective), পরিজ্ঞেয়তা (communicability) বা আস্তিত্বিক (existent?)। তৎসম শব্দের ওজনদার ভার একটু গা সওয়া হয়ে গেলেই পাঠক বুঝতে পারেন যে উপর্যুক্ত কথাগুলি নিছক প্রতিশব্দ নয়, বরং বাংলা রূপান্তরে ভাবশব্দগুলি যেন স্বঅর্থে ও যাথার্থ্যে প্রোজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।

রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ইতিহাস সব দেশে সমান হবে এই কুসংস্কারটি বর্জনীয়। এই মতে রণজিৎ গুহের পূর্ণ সায় আছে। ঔপনিবেশিক ও উপনিবেশ-উত্তর ভারতে নানা প্রকারে সাহেবি মডেলের ঢঙে লেখা অনাধুনিকতা বনাম প্রগতির আগুপিছু থাকা ও গুঁতোগুঁতির ইতিবৃত্তের ধাঁচা থেকে বেরিয়ে আমাদের আধুনিকতার ‘এতদ্দেশীয় অনন্যতা ও মৌলিকতা’র লক্ষণ নির্ণয় করার চেষ্টা তাঁর অনেক রচনাতেই দেখা যায়। এই অনুসন্ধানে তিনি দেশজ চিন্তাবর্গের সাহায্য নিয়েছেন, ভারতীয় ধ্রুপদী দর্শনচিন্তার বহু ভাবনাবীজকে নিজের ব্যাখ্যায় আত্মস্থ করে জিজ্ঞাসাকে শাণিত করেছেন। সঙ্গে এটাও দেখি, গোঁড়া দেশিপনা তাঁর ধাতে নেই। তাঁর নিজের ভাষ্যে ভর্তৃহরি বা অভিনবগুপ্তের সঙ্গে কান্ট বা হাইডেগারের আলাপ চলে। আলাপের অংশগুলি পাঠকের বিশেষ অভিনিবেশ দাবি করে, একেবারেই জলবৎ তরল নয়, ফিরে ফিরে পড়তে হয়। কারণ, পারস্পরিক আলোচনার জেরে চিন্তার বর্গগুলির অভ্যস্ত ঠাঁই নড়ে যায়, ভাবনার নতুন পরিসর তৈরি হয়, চর্বিত পাণ্ডিত্যের জায়গা থাকে না।

আমাদের একটি চিন্তাস্থানে আদি বিদ্বান হলেন বৈয়াকরণ। সেই ব্যাকরণ তথা ভাষাচিন্তার সমৃদ্ধ ভাণ্ডার থেকে সূত্র, সংজ্ঞা ও তত্ত্ববীজ আহরণ করে নিজের বিশ্লেষণী প্রতর্ককে রণজিৎ স্তরে স্তরে সাজিয়েছেন। যেমন ‘মহাভারতের মেধাজীবী’ প্রবন্ধে বাগর্থের বলয়ে ‘শ্রমজীবী’ ও ‘বুদ্ধিজীবী’ শব্দের তুলনায় ‘মেধাজীবী’ শব্দের বিশেষ দ্যোতনা তিনি ঠাহর করেন। সেই সূত্রেই মহাভারতে বর্ণিত প্রাক-আধুনিক থাকবন্দি সমাজে দ্রোণাচার্যের মতো মেধাজীবীর অনন্য জীবনট্র্যাজেডি বিশ্লেষিত হয়েছে।

‘দয়া’ নিবন্ধে দিলীপকুমার বিশ্বাসের গবেষণার সূত্র ধরে রণজিৎ গুহ বলেছেন যে হিতবাদী যুক্তি ও শাস্ত্রীয় আলোচনার পাশাপাশি রামমোহন রায়ের সংস্কার চেতনা ও সংস্কৃতি ধারণার একটি শিকড় লৌকিক উত্তানে প্রোথিত ছিল। ওই ক্ষেত্র থেকেই দয়া, শ্রদ্ধা ও অনুভূতির বোধ জন্ম নিয়েছে ও পরে প্রবর্ধিত হয়েছে। এই বোধের স্বরূপ সহজ, সহজাত, কান্টের ভাষায় ‘প্রাগভিজ্ঞ’ ও ভর্তৃহরির চিন্তায় ‘পূর্বার্জিত সংস্কার’ সদৃশ। এই তাত্ত্বিক সাযুজ্যতা নির্ণয়ের জেরেই প্রাবন্ধিক দেখান যে হেতুনির্ভর কর্তব্য-অকর্তব্য বিচার বা কাণ্ডজ্ঞানের খোপ থেকে আত্ম-অনুভূতির পৃথক বর্গে দয়া ইত্যাদি মমত্ববোধকে রাখা সঙ্গত। স্ব-ভাব ভাবনার তাগিদেই রামমোহন রায়ের আত্মবোধে জারিত মমত্ব মানবিক অনুভূতিকে শুষ্ক যুক্তির সঙ্গে অন্বিত করেছিল, সেই অন্বয়েই তাঁর স্বাদেশিকতা ও নিজস্ব নীতিবোধের মানচিত্র আভাসিত হয়।

ভর্তৃহরির ‘বাক্যপদীয়’-এর ভাষাচিন্তা থেকে ‘উপচার’ বৃত্তির ধারণা রণজিৎ গুহ তুলে নিয়েছেন, প্রবন্ধ সংগ্রহের দ্বিতীয় খণ্ডে সন্নিবিষ্ট নানা আলোচনায় ধারণাটি তাঁর বৈচারিক কুশলতায় স্বপ্রভ হয়ে উঠেছে। ‘চর’ ধাতুতে সিদ্ধ উপচার শব্দটিতে গতি ও চলিষ্ণুতার ব্যঞ্জনা হামেহাল হাজির থাকে, স্বভাবে উপচার বৃত্তিটি যেন চরণিকের মতোই সঞ্চরণশীল। উপচারের ছলাকলাতেই শব্দের অভিধাসিদ্ধ মুখ্য অর্থ পিছনে হটে, গৌণী অর্থ সামনে জাঁকিয়ে বসে, প্রতিসরণের একাধিক দুয়ার খুলে যায়। নানা প্রাসঙ্গিক সমস্যার জট ছাড়াতে রণজিৎ গুহ উপচার ধারণাটিকে স্বকীয় দৃষ্টিকোণে ব্যবহার করেছেন। প্রসঙ্গগুলিও হরেক রকম, যেমন কাব্যজিজ্ঞাসা থেকে জীবনজিজ্ঞাসার অনুবাদ, ব্যক্তি আমি থেকে অপর আমিতে সম্প্রসারণ, বা এক কাল ও এক দেশে জাত অভিজ্ঞতা থেকে অন্য কাল ও অন্য দেশে উদ্ভূত অভিজ্ঞতার ব্যবধান বিচার ও পারস্পরিক বিনিময়ের সম্ভাবনা সন্ধান। গত শতকের ত্রিশের দশকে দার্শনিক কৃষ্ণচন্দ্র ভট্টাচার্য ভারতীয় মননে স্বরাজের সাধনার প্রয়োজনীয়তার দিকে নজর টেনেছিলেন। রণজিৎ গুহের প্রবন্ধগুলি সেই স্বরাজসিদ্ধির শ্রেষ্ঠ ফসল। তাঁর নির্দিষ্ট বক্তব্যের সঙ্গে কারও দ্বিমত থাকতে পারে। কিন্তু মননে স্বরাজ সাধনার বীজশব্দ নিতে গেলে তাঁর বাংলা রচনাসংগ্রহের কাছে আমাদের বার বার যেতে হবে। এই ‘গ্লোবায়িত’ যুগেও তাঁর বাংলা প্রবন্ধগুলি কোনও ইংরেজি রচনার অনুবাদ নয়, বাংলা ভাষাতেই তাঁর চিন্তার মৌলিক রূপটি লেখা হয়েছে।

পাঠগুণে ও চিন্তাসৌকর্যে দশ বছর আগে লেখা এতাবৎকাল অনালোচিত প্রবন্ধ ‘আদি কবি আর প্রথম পাঠক: একটি পৌরাণিক সাক্ষাৎকারের কাহিনী’ রবীন্দ্রনাথের প্রাচীন সাহিত্য ও মেঘদূতের উপরে বুদ্ধদেব বসুর আলোচনার সহধর্মী। প্রাবন্ধিকের আধুনিক মননে ভারতীয় ভাষার আদি মহাকাব্যের পাঠ নতুন জিজ্ঞাসার ইঙ্গিতবাহী হয়ে ওঠে। অভিজ্ঞতা ইতিহাসের সামগ্রী, ঘটনার পারম্পর্যে ও কার্যকারণ ব্যাখ্যার শৃঙ্খলে তার বর্ণন অতীত আখ্যানের রূপ পায়। অন্য পক্ষে কাব্য সাহিত্যে জায়গা পাওয়া লোক অভিজ্ঞতা চেষ্টা করে বহু কালে, লোক অন্তরে। ক্রৌঞ্চ মিথুনের হত্যায় ব্যথিত বাল্মীকির প্রতিক্রিয়া তাৎক্ষণিক, একক বেদনাবোধে নিষিক্ত ছন্দোময় স্বগত উচ্চারণ, একটি অভিশাপ ধ্বনি। আশ্রমে আগত নারদ ও ব্রহ্মার সঙ্গে হার্দিক কথোপকথনে উচ্চারণটি শ্লোকের স্বীকৃতি পেল। দেবগুণে মার্জিত দুই শ্রোতার উৎসাহে ও নির্দেশে, আদি কাব্যসৃষ্টিতে, সাজিয়ে তোলা ছন্দ, ভাষা ও কল্প-সজ্জায়, মুনিবরের বিশেষ অনুভূতির সর্বজনীন সংবেদন সম্ভব হয়ে উঠল। ‘অসীম রোদন জগৎ প্লাবিয়া দুলিছে যেন’ এ ভাবেই প্রাত্যহিকের তুচ্ছ ঘটনা ও অভিজ্ঞতা কাব্যের বিষয় হয়ে ওঠে, পারস্পরিকতার সূত্রে ওই ক্ষণকালে চিরকালের ছোঁয়া দেখতে পাই। কাব্যকথার সামাজিক টানে রাষ্ট্রসর্বস্বতার বাইরে ইতিহাস-চেতনা জনকথা ও জন অভিজ্ঞতার গহনে ডুব দিতে সক্ষম হয়। অতীত কথাবৃত্তে গ্রহণ ও বর্জনের প্রক্রিয়ায় আখ্যায়িত কোনও না কোনও অভিজ্ঞতার শরিক পাঠক হতে চান। সেই পাঠে তার বর্তমান লগ্ন হয় চলে যাওয়া সময়ের প্রেক্ষিতে আর ভবিষ্যৎ প্রসারিত হয় কোনও না কোনও প্রাপ্তির আকাঙ্ক্ষাতে, বা অবাঞ্ছিতের প্রতিষেধে। এই রাগ-বিরাগের টানাপড়েনেই কাব্যবোধ ঐতিহাসিক রসের উপাদান হয়ে ওঠে। তবে নিছক ইতিহাস নির্মিতি কেবল বস্তুতথ্যের দিকে ঝুঁকে পড়ে ও কাব্যসাহিত্যে তথ্য অভিজ্ঞতা কল্পনার অশেষ মর্যাদায় ভূষিত হয়। (‘তুমিও আইস, দেবি, তুমি মধুকরী কল্পনা!’) সংস্কৃতির ঐতিহাসিকতা ও ঐতিহ্যের রাজনীতি বিচারে, উপর্যুক্ত দুই রাশির দ্বন্দ্ব, মিলন বিরোধের দ্বিবিধ অর্থেই, ক্রিয়াশীল থাকে। রণজিৎ গুহের কথনে বিশ্লেষিত একটি পৌরাণিক সাক্ষাৎকার মানবিক বিদ্যাচর্চায় সৃষ্টি ও সংসারের পারস্পরিকতার সমস্যা নিয়ে নানা প্রশ্ন উসকে দেয়।

রণজিৎ গুহের সব প্রবন্ধই মানবিক লগ্নতা ও সহত্বের ভাবাদর্শে প্রাণিত। এই দর্শন কোনও বায়বীয় ভাববাদে লালিত নয়। বাস্তব অভিজ্ঞতার জমিতেই লগ্নতা ও সহত্বের গোড়াপত্তন হয়েছে। প্রাকৃতিক ভাণ্ডার থেকে জীবনযাপনের রসদ সংগ্রহের চেষ্টায়, যৌথ প্রতিরোধের জন্য লোকসংহতি নির্মাণে, কৌম বা শ্রেণিচেতনার নানা ক্রিয়াকাণ্ডে সহত্বের স্বাক্ষর অপরিহার্য। ব্যক্তির ভাব-ভাবনার নানা প্রকাশেও সহত্বের আকাঙ্ক্ষা ঝলসে ওঠে, যেমন রামমোহন রায়ের দয়া বোধে, যুদ্ধের অবসানে কুরুক্ষেত্রে রাজমাতা কুন্তীর আত্ম-অপরাধের স্বীকৃতিতে ও পাণ্ডবজ্যেষ্ঠ রাজা যুধিষ্ঠিরের শোচনা ও আক্ষেপে।

আজকের পৃথিবীতে হিন্দুত্ববাদের বীভৎস কর্মকাণ্ড, ইসলামি ধর্মধ্বজীদের জেহাদ, গ্লোবায়িত রাষ্ট্রের সর্বগ্রাসী আগ্রাসন বা তথ্যসর্বস্ব বাজারি যু্ক্তিবাদের বন্ধ্যত্বের বিরুদ্ধে রণজিৎ গুহ চৈতন্যের বোধন ও সত্তার সাধনে মানবিক প্রকর্ষের সন্ধানী। সেই মানবিকতার নানা চেহারাই তিনি খুঁজে পান সংসারের প্রাত্যহিক চেনাজানা ও সহজ অন্তরঙ্গতায়, ইতিহাসসিদ্ধ সহত্বের ন্যায়বোধে ও সাহিত্যের সৃজনশীলতায়।

আরও পড়ুন
Advertisement