Books

‘গদ্য লিখেছেন কবিতার মতো’

যারা গত শতকের অপরাহ্ণে বয়ঃপ্রাপ্ত হইনি, কবি বুদ্ধদেব বসুর গদ্য পড়িনি, তারা হয়তো এই বই হাতে নিয়ে এক অনাস্বাদিতপূর্ব গদ্যের দেখা পাব।

Advertisement
অমিয় দেব 
শেষ আপডেট: ০৮ অগস্ট ২০২০ ০১:০৫

সঙ্গ: নিঃসঙ্গতা রবীন্দ্রনাথ
বুদ্ধদেব বসু
৩০০.০০
সিগনেট প্রেস

বুদ্ধদেব বসুর (১৯০৮-৭৪) সঙ্গ: নিঃসঙ্গতা রবীন্দ্রনাথ বেরিয়েছিল জানুয়ারি ১৯৬৩ তথা মাঘ ১৩৬৯-এ, প্রকাশ করেছিল এম সি সরকার অ্যান্ড সন্স প্রাইভেট লিমিটেড। সম্প্রতি সিগনেট প্রেস সেই বই নতুন করে বার করেছে। আমরা সিগনেটের কাছে কৃতজ্ঞ; কারণ, যদিও তা জানুয়ারি ২০১০/ মাঘ ১৪১৬-তে পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি প্রকাশিত ‘বুদ্ধদেব বসুর প্রবন্ধসমগ্র ৩’-এ অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল, তবু আলাদা বই হিসেবে তা হাতে পাওয়ার এক অন্য সুখ আছে। তা ছাড়া, যারা গত শতকের অপরাহ্ণে বয়ঃপ্রাপ্ত হইনি, কবি বুদ্ধদেব বসুর গদ্য পড়িনি, তারা হয়তো এই বই হাতে নিয়ে এক অনাস্বাদিতপূর্ব গদ্যের দেখা পাব।

Advertisement

বইটি সঙ্কলন। দুটো ভাগ। প্রথম ভাগের শিরোনামের প্রথমাংশ; দ্বিতীয় ভাগে দ্বিতীয়াংশ। প্রথম দু’টি লেখা, ‘সঙ্গ ও নিঃসঙ্গতা’ (১৯৫৩-র গোড়ায় তিনি কর্মোপলক্ষে তিন মাস মহীশূরে ছিলেন— সেই একাকিত্ব এখানে অভিজ্ঞতা হয়ে উঠেছে) এবং ‘হেমন্ত’, রম্যরচনা— তাঁর দুই পুরনো বই ‘হঠাৎ-আলোর ঝলকানি’ (১৯৩৫/৪৬/৫৮) ও ‘উত্তরতিরিশ’ (১৯৪৫/৫২)-এর কথা মনে করিয়ে দেয়। পরবর্তী নিবন্ধ ‘আধুনিক কবিতায় প্রকৃতি’তে জড়জগৎ বনাম চেতনা নিয়ে তাঁর এক প্রিয় তর্ক দানা বাঁধে (‘আধুনিকতা ও রবীন্দ্রনাথ’ লিখে তাতে পরে বিবাদী হবেন আবু সয়ীদ আইয়ুব)। অতঃপর, যে দুই আধুনিক কবির ‘সঙ্গ’ (শিরোনামসম্মত অর্থে) তিনি এখানে মাথায় তুলে নিয়েছেন, তাঁরা বরিস পাস্তেরনাক ও সুধীন্দ্রনাথ দত্ত। মনে আছে, তাঁরই উৎসাহে ‘ডক্টর জ়িভাগো’-র বাংলা অনুবাদ করেন মীনাক্ষী দত্ত ও মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। আর উপন্যাসের শেষে জ়িভাগোর কবিতাগুলির বাংলা করেন তিনি নিজে। তখন তিনি সিনেমা দেখতেন না, কিন্তু জ়িভাগোর ওই লম্বা ফিল্ম তিনি দেখতে গিয়েছিলেন। আর পাস্তেরনাক নিয়ে অমিয় চক্রবর্তীর সঙ্গে তাঁর বিতর্কও তখন পাঠকমহলে খানিক সাড়া জাগিয়েছিল।

সুধীন্দ্রনাথ দত্তের উপর দু’টি লেখার প্রথমটি শোকগাথা, দ্বিতীয়টি তাঁর ‘কাব্যসংগ্রহ’-এর ভূমিকা। এক ‘কবির মৃত্যু’ তাঁর স্নেহলব্ধ বন্ধু কবিকে কী গভীর ভাবে স্পর্শ করতে পারে, তার ক্লাসিক উদাহরণ ওই প্রথম লেখা। তাঁর শেষ কাব্যগ্রন্থে (‘স্বাগতবিদায় ও অন্যান্য কবিতা’, ১৯৭১) ‘সেতুবন্ধ’ নামের কবিতায় তাঁর মৃত বন্ধুর কথা আছে: “যে-তুমি আমাকে ভালোবেসেছিলে/ কৈশোরে, যৌবনে আর এমনকি প্রৌঢ়তার কঠিন সংকটে”, সেই তুমি আসলে “এক নও, তুমি দুই— দুই নও— তুমি তিনজন... সুধীন্দ্র, প্রভুচরণ, পরিমল রায় (প্রভু গুহঠাকুরতা তাঁর কৈশোরের আর পরিমল রায় যৌবনের বন্ধু)।”

আবার এই শোকগাথাতেই তিনি জীবনানন্দ ও সুধীন্দ্রনাথের সম্পূরকতার কথা বলেন (“এই দু-জন, পরস্পরের দিকে পিঠ ফিরিয়ে, স্থাপত্য-ক্ষোদিত অর্ধ-দেবতার মূর্তির মতো, আমাদের সমগ্র আধুনিক কবিতাকে দুই প্রান্তে ধারণ ক’রে আছেন...।”) ‘কবিতা’ পত্রিকার জীবনানন্দ ও সুধীন্দ্রনাথ সংখ্যা দুই-ই আজ স্মরণীয়। ‘সঙ্গ’ পর্বে আর আছে দুই প্রয়াণলেখ: রাজশেখর বসু ও শিশিরকুমার ভাদুড়ি— এক জন প্রতিভার বিরল ‘সুবর্ণমধ্যম’, অন্য জন প্রতিভার অসামান্যতার উচ্চাবচ। রাজশেখর বসুর গদ্যানুবাদ সংবলিত মেঘদূত-ই তাঁকে পরিণত বয়সে মেঘদূত অনুবাদে প্রণোদিত করেছিল; আর যৌবনে শিশির ভাদুড়ি দেখতে দেখতেই বুঝি তাঁর একদা পেশাদার নাট্যকার হওয়ার বাসনা হয়েছিল, যদিও তাঁর ‘রাবণ’ নাটক মঞ্চস্থ হতে হতেও হয়নি।

বইয়ের দ্বিতীয়াংশে আছে রবীন্দ্রনাথের উপর আটটি প্রবন্ধ, কোনও কোনওটি ছোট, কোনও কোনওটি বড়। নানা বিষয় তাদের। সবচেয়ে বড়টির বিষয়, রবীন্দ্রনাথের গদ্য। তার প্রথম বাক্য: “রবীন্দ্রনাথ গদ্য লিখেছেন কবির মতো; তাঁর গদ্যের গুণ কবিতারই গুণ; যা কবিতা আমাদের দিতে পারে, তা-ই তাঁর গদ্যের উপঢৌকন।”

এই আলোচনা মুখ্যত প্রবন্ধ নিয়ে, আর রবীন্দ্রনাথের প্রবন্ধ যে মূলত বিষয় নয়, বিষয়ীসুখী— তা-ই এর প্রতিপাদ্য। রবীন্দ্রনাথ সাধারণত আগে থেকে ভেবে নিয়ে লেখেন না, লিখতে লিখতে ভাবেন; আর প্রত্যাশিত যুক্তির বদলে হঠাৎ উপমা নেমে এসে আমাদের বিদ্যুতের মতো চমকে দেয়। এমনকি, যেখানে সন্দর্ভকালীন তর্ক করছেন সেখানেও তাঁর কবিমন ঘুমিয়ে নেই। মালার্মে-ভক্ত না হয়েও রবীন্দ্রনাথের গদ্যবিচারে মালার্মেরই এক কৈবল্যধর্মী উক্তির শরণ নেন বুদ্ধদেব বসু: “আসলে গদ্য ব’লে কিছু নেই: আছে বর্ণমালা, আর নানা ধরনের কবিতা, কোনোটি শিথিল, কোনোটি সংহত, কোনোটি বা একটু বেশি ছড়িয়ে-যাওয়া।” বুদ্ধদেব বসুর নিজের গদ্য— যে গদ্য আমরা পড়ছি— তা-ও কি একটু তা-ই, অর্থাৎ রবীন্দ্রধর্মী? অন্তত সুধীন্দ্রনাথ দত্ত তেমনই ভাবতেন (দ্রষ্টব্য, ‘কুলায় ও কালপুরুষ’-এর ‘উক্তি ও উপলব্ধি’)।

আর যে তিনটি বড় প্রবন্ধ আছে এই অংশে, তাদের একটি রবীন্দ্রগানে পদ্য ও গদ্য বিষয়ক, অন্য দু’টির বিষয় কবিতা। সেই দু’টির একটি মানসী কাব্যগ্রন্থ নিয়ে, অন্যটি যুগপৎ রবীন্দ্রকবিতার বিশ্বত্ব ও বাঙালিত্ব নিয়ে। প্রথম প্রবন্ধটি, আমাদের জানিয়ে দিয়েছেন তিনি, রবীন্দ্রনাথের গদ্যগান বিষয়ক এক প্রবন্ধের সম্প্রসারণ। তার উপসংহার: “কাব্যরচনার দিক থেকে দেখলে, রবীন্দ্র-সংগীতে বৈচিত্র্য যে কত বিপুল তা আমরা গীতমুগ্ধ হ’য়ে সব সময় মনে রাখতে পারি না; তবু শেষ পর্যন্ত ভুলে থাকা অসম্ভব যে তাঁর শ্রেষ্ঠ কবিতার তালিকায় তাঁর গান যেমন একটি বড়ো অংশের অধিকারী, তেমনি— শুধু সুর নয়— ছন্দ ও ছন্দোমুক্তির কারুশিল্পেও তাঁর কৃতি এখানে অপর্যাপ্ত।”

মানসী-কে তিনি বলেছেন ‘বাংলা কবিতার স্বপ্নভঙ্গ’। ‘স্বপ্নভঙ্গ’ কথাটি, যাকে জয়েস ‘এপিফ্যানি’ বলতেন, সেই অর্থে ব্যবহৃত। প্রবন্ধটা বুদ্ধদেব বসু লিখেছেন কবির চোখে। কবিতার যে দুই সামগ্রী, কলাকৌশল ও ভাববস্তু, সেই দুই নিরিখেই তিনি দেখেছেন এই কাব্যগ্রন্থকে। সানুপুঙ্খ। দেখেই তিনি একে ‘রবীন্দ্র-কাব্যের অণু বিশ্ব’ বলে প্রস্তাব করেছেন। জীবনস্মৃতি রবীন্দ্রনাথ শেষ করেছেন কড়ি ও কোমল-এ পৌঁছে। কিন্তু মানসী যে আগতপ্রায় তার ইঙ্গিত ওই শেষ পরিচ্ছেদেই আছে— ‘ইহার চেয়ে হতেম যদি আরব বেদুয়িন’ এক বার গুনগুন করে গেল। আর, মানসী-তে রবীন্দ্রকাব্যের বয়ঃপ্রাপ্তির সঙ্গে সঙ্গে বাংলা কবিতারও নতুন জন্ম হল। তিরিশের কবি বুদ্ধদেব বসুর তা-ই প্রতীতি।

“যেন এক দৈব আবির্ভাব—অপর্যাপ্ত, চেষ্টাহীন, ভাস্বর, পৃথিবীর মহত্তম কবিদের অন্যতম: আমার কাছে এবং আমার মতো আরো অনেকের কাছে, এ-ই হলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।” এই তারে বেঁধেছেন বুদ্ধদেব বসু তাঁর ‘বিশ্বকবি ও বাঙালি’ প্রবন্ধ, যার প্রাথমিক চেহারা ছিল রবীন্দ্র-শতবর্ষে মুম্বই বিশ্ববিদ্যালয়ে দেওয়া পাঁচটি ইংরেজি বক্তৃতার একটি। রবীন্দ্রনাথের তুলনীয় তাঁর কাছে শেষ পর্যন্ত জার্মান কবি গ্যোটে, যিনিও যুগপৎ জার্মানির ও বিশ্বের। বস্তুত, গ্যোটে যে ‘বিশ্বসাহিত্য’-এর কথা বলেছিলেন, তা-ই বুঝি বা রূপ নিয়েছিল রবীন্দ্রনাথে। তা ছাড়া, তাঁর নিজেরও তো এক সদা নির্মীয়মাণ ‘বিশ্বসাহিত্য’-এর ধারণা ছিল। অথচ বিশ্ব তাঁর আবির্ভাবে যে অভ্যর্থনা জানিয়েছিল, তা কি এখন মাত্র এক স্মৃতি, না কি ভাবী অনুবাদের অপেক্ষা?

যে চারটি ছোট প্রবন্ধ আছে, তার একটি রিভিউ বা সমালোচনা, দু’টি বেতার-বক্তৃতা ও চতুর্থটি (সঙ্গে একটি পরিশিষ্টও আছে) সেই লেখা, যার কদর্থ করে ১৯৬১-তে তাঁকে রবীন্দ্র-বিরোধী বলে অপপ্রচার করা হয়েছিল।

এই চারটির মধ্যে আমার খুব জরুরি লেগেছে ‘রবীন্দ্রনাথের উপমা’ লেখাটি। তাঁর শেষ রবীন্দ্রপাঠ (মুম্বইয়ের সেই বক্তৃতাপঞ্চক ‘টেগোর: পোর্ট্রেট অব আ পোয়েট’-এর উপর ভিত্তিশীল), ‘কবি রবীন্দ্রনাথ’ (১৯৬৬)-এর এক সংক্ষিপ্ত ভূমিকা মতো তা হতে পারত।

পরিশেষে, সিগনেট প্রেস-কে বইটির এক ‘নির্দেশিকা’ সংযোজনের জন্য সাধুবাদ। সেই সঙ্গে অনুরোধ, বইটির পরবর্তী মুদ্রণে যেন দু’টি সংশোধন করে নেওয়া হয়: লেখকের ভূমিকাতে ‘রবীন্দ্রনাথ টেগোর: আ সেন্টিনারি ভলিউম’, আর ‘রবীন্দ্রনাথ ও প্রতীচী’র প্রথম পাদটীকায় গাঁধীর প্রবন্ধের ঠিক শিরোনাম।

আরও পড়ুন
Advertisement