—প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।
ভূতত্ত্ব বা জিয়োলজি আসলে তো পাথরের রূপকথা। স্মৃতি যেখানে স্থাণু, ইতিহাসও যেখানে পৌঁছয় না, পৃথিবীর সেই সময়কালও ছুঁয়ে দেখতে চায় সে, পাথরের ঘুম ভাঙিয়ে। বালিগঞ্জে বড় হয়ে ওঠা মেয়ে সুদীপ্তা সেনগুপ্ত ষাটের দশকের কলকাতায় যখন এই বিষয়টাই বেছে নিচ্ছেন পড়বেন বলে, তখন কে-ই বা চেনে বিষয়টাকে সে ভাবে! খটোমটো পাথুরে বিষয়, তা আবার পড়বে একটা মেয়ে! এমনই ছিল সমাজের ভাবখানা। সে সময় কবেই পেরিয়ে গেছে, কয়েক দশক পরে লেখা এই আত্মকথার নামকরণ ব্রেকিং রকস অ্যান্ড ব্যারিয়ারস হওয়া যেন অনিবার্য ছিল। দুই-ই ভাঙতে হচ্ছে এক জীবনে: কখনও পাথরের বাধা, কখনও বাধার পাথর। চমৎকার রূপক!
লব্ধপ্রতিষ্ঠ মানুষদের আমরা যে মাইলফলকগুলো ধরে চিনি, সুদীপ্তা সেনগুপ্তও সেই ভাবে পরিচিত: ভূতত্ত্বের কৃতী ছাত্রী, গবেষক, অধ্যাপিকা; সুদক্ষ পর্বতারোহী, শৃঙ্গজয়ী; শান্তিস্বরূপ ভাটনগর পুরস্কারে সম্মানিতা বিজ্ঞানী, সর্বোপরি অ্যান্টার্কটিকা অভিযানে শামিল প্রথম ভারতীয় দুই নারীর এক জন। আম-মানুষ স্ট্রাকচারাল জিয়োলজি জানে না তাই তাঁর কাজের উচ্চতা ও গভীরতা আন্দাজ করা কঠিন; অ্যান্টার্কটিকার চটকও তার কাছে কল্পনাতীত দূরের এক সিল-পেঙ্গুইনের দেশ বলেই হয়তো। কিন্তু সেই কবে আশির দশকেই একটি মেয়ে ভারতের তৃতীয় অ্যান্টার্কটিকা-অভিযান সফল ভাবে সেরে আসছেন, বাঙালির কাছে এ যুগপৎ গর্ব শঙ্কা বিস্ময় আনন্দ— সবই উদ্রেক করেছিল। দেশ পত্রিকায় সুদীপ্তা সেই সময়ই ধারাবাহিক ভাবে লিখেছিলেন এই অভিজ্ঞতা, পরে বই হয়ে বেরোয় আনন্দ পাবলিশার্স থেকে: দু’টিই সমান জনপ্রিয়।
সে তো ছিল একটা পর্ব শুধু। এ বারের বইটি পূর্ণাঙ্গ, যেখান থেকে এই যাত্রাপথের আনন্দগান পুরোটাই শোনা যাবে। খুব কৃতী মানুষের আত্মকথা জানতে বা অজানতে অনেক সময়ই হয়ে ওঠে শুধুই ‘আমি’ময়, এ বই সেই দোষ থেকে মুক্ত। সুদীপ্তা বরং ধরেছেন বহতা একটা সময়কে, যে সময়ের ধারাবিবরণীর মধ্যে রয়েছে স্বাধীন দেশ, তার হর্তাকর্তা থেকে আম-নাগরিক সবাই। নিজেকে সময়ের কেন্দ্রে স্থাপিত করা নয়, সময়ের মধ্যে নিজেকে (এবং অন্যদের) ভাসিয়ে দেওয়া— এটাই লেখিকার উদ্দেশ্য। পাঠকও তাই ছবির মতো পেরিয়ে যান এক-একটা কালপর্ব: ভারত, কলকাতা ও বিশ্বেরও পঞ্চাশ ষাট সত্তর আশির দশক। এই সবই আমরা দেখি ওঁর অধীত বিষয়ের প্রিজ়মের মধ্য দিয়ে: এক কিশোরী ভালবাসছে পাহাড় তথা হিমালয়কে, তা থেকেই আসছে ভূতত্ত্ব পড়ার সিদ্ধান্ত, ফিল্ডওয়ার্ক থেকে শুরু করে রক ক্লাইম্বিং ও মাউন্টেনিয়ারিংয়ের প্রশিক্ষণ তাঁকে এগিয়ে দিচ্ছে পরের ধাপে।
ব্রেকিং রকস অ্যান্ড ব্যারিয়ারস
সুদীপ্তা সেনগুপ্ত
৪৯৯.০০
হার্পার কলিন্স
রন্টি ও ললনা, এই দুই পর্বতশৃঙ্গ অভিযানের অধ্যায় দু’টি রোমাঞ্চকর। এই দু’টিই ব্যক্তিগত ভাবে সুদীপ্তার তো বটেই, জাতিগত ভাবে বাঙালিরও স্মরণীয় ‘কীর্তি’। বিশেষত ললনা শৃঙ্গজয়। শুধুই বাঙালি মেয়েদের নিয়ে গড়া একটি দল বিশ-হাজারি এমন এক শৃঙ্গ জয় করে আসছে যেখানে ওঁদের আগে কারও পা পড়েনি, এমনকি সেই শৃঙ্গের নামকরণও হচ্ছে ওঁদের হাতে— ‘ললনা’— পড়তে শিহরন জাগে। শৃঙ্গজয়ের সাফল্যের পরেই ফিরতি-পথে ঘটে যায় ট্র্যাজেডি, দুই শৃঙ্গজয়ী সদস্যা সুজয়া ও কমলা প্রাণ হারান দুর্ঘটনায়— সুদীপ্তা সে বিবরণ লিখেছেন বেদনাকে শব্দে গেঁথে। পর্বতারোহী ও অভিযাত্রীদের কলমে এ-হেন সঙ্কট ও বিপদের নানাবিধ বয়ান আমাদের জানা ও পড়া, কিন্তু সুদীপ্তার কলমে সহমর্মীর আবেগকে ছুঁয়ে থাকে বিজ্ঞান-গবেষকের ব্যাখ্যা: ট্র্যাজেডির নির্মোহ ভাষ্য।
লন্ডন ও উপসালা-তে তাঁর উচ্চতর গবেষণার যে দিনগুলি, তার ধারাবিবরণীও মন কাড়ে লেখার গুণে। অনেকটা ‘জার্নাল’-এর মতো করে লেখা: তাতে সত্তর দশকের আলো-ঝলমল বিলিতি দিন, কুয়াশা-মাখা বিকেল আছে, বিদেশি বন্ধু অধ্যাপক পড়শি চেনা-অচেনা মানুষের গল্পগাছা খাওয়াদাওয়া বিনোদন, সব আছে। সুদীপ্তা খুব আদর করে লেখেন ওঁর মাস্টারমশাইদের কথা: সে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ওঁর অধ্যাপক ও পরবর্তী কালে সহকর্মী সুবীর কুমার ঘোষই হোন, অথবা ইম্পিরিয়াল কলেজে জ্যানেট ওয়াটসন, কিংবা উপসালা ইউনিভার্সিটিতে প্রফেসর র্যামসে। বিচিত্র, বহুবর্ণ চরিত্রেরা চোখের সামনে ঘোরাফেরা করে: রন্টি-অভিযানের শেরপারা, লন্ডনে ডব্লিউ এইচ অডেনের বড়দা— বিখ্যাত ভূতাত্ত্বিক জন অডেন, অ্যান্টার্কটিকা অভিযানের সঙ্গী ডক্টর গুপ্ত, মেজর নায়ার, আর কে সিংহ, আরও কত জন— যে যাঁর নিজস্ব গল্প নিয়ে। এঁরা তো তবু নামীদামি মানুষ, চলার পথে জড়িয়ে যান অল্প-জানা আর একেবারে অজানা বহু মানুষও— একা কাজে মগ্ন মেয়েকে দিয়ে যান মন-ছোঁয়া কত না মুহূর্ত: তৃষ্ণার জল বা পথনির্দেশ হাতে তুলে দিয়ে, হয়তো বা মুখের মিষ্টি হাসি আর কথাতেই, ঠিক যেটা জরুরি যখন।
কিন্তু সবচেয়ে বড় কথা, সুদীপ্তা লিখতে লিখতে বার বার বলে যান আসল কথাটা: স্বপ্ন দেখা আর স্বপ্ন পূরণের কথা, বিশেষত মেয়েদের দিক থেকে। তিনি যেমন লিখেছেন ভূতত্ত্ব-পড়াশোনার সেই সব দিগ্দর্শক মেয়েদের নিয়ে, তাঁর পূর্বসূরি মহিলা ভূবিজ্ঞানী ও গবেষকদের নিয়ে, তেমনই লিখেছেন আমাদের চার পাশের ‘সাধারণ মেয়ে’দের কথাও: দেশ পত্রিকায় ওঁর অ্যান্টার্কটিকা-অভিযান পড়ে যাঁরা চিঠিতে উজাড় করে দেন নিজস্ব স্বপ্নভঙ্গ ও ‘ব্যর্থতা’র বারোমাস্যা। সুদীপ্তা যেমন তাঁর ষাট-সত্তর দশকে দেখা হিমালয়ের প্রকৃতির কথা লেখেন, তার পাশাপাশিই মনে করিয়ে দেন, আজ কী নির্মম অত্যাচার চলছে হিমালয়ের পরিবেশের উপর। এইখানটায় এসেই এক ব্যক্তিগত জীবনস্মৃতি ছুঁয়ে ফেলে এক সুচেতন নাগরিকের বিশ্ববোধকে। স্রেফ সুখপাঠ নয়, হয়ে ওঠে ভূয়োদর্শন।
শিশির রায়