Book Review

বাংলা গল্পের পথ তৈরির চেষ্টা যেন হারিয়ে না যায়

নামেই খানিকটা আঁচ করা যায়, ‘রণসজ্জা’টি কেমন। শিল্প–সাহিত্যকর্ম যুদ্ধ তো বটেই। জীবন, মনন, অস্তিত্ব–সঙ্কটের সঙ্গে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ।

Advertisement
প্রচেত গুপ্ত
শেষ আপডেট: ০৬ জানুয়ারি ২০২৪ ১০:৪৬
—প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।

—প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।

শুরুতেই আসল কথা। যাঁরা বলেন, বাংলা গল্পে নতুন ভাবনা ফুরিয়ে আসছে, লেখকরা পরীক্ষা-নিরীক্ষার সাহস হারাচ্ছেন, ‘অন্য স্বর’ শোনা যায় না আর, ‘ছাই ঘেঁটে পাপ দেখে নেবার’ স্পৃহাটি আর বুঝি অবশিষ্ট নেই, এবং বাংলা গল্পের বিষয় ও ভাষা পরিচিত বৃত্তের মধ্যে মাথা কুটে মরছে, তারা এই কৃশকায় গল্প সঙ্কলনটি পড়ে দেখতে পারেন। যদি ধারণাটি না-ও বদলায়, তা হলেও এমন এক অভিজ্ঞতা হবে, যা এই সময়ের বাংলা গল্পের পাঠকদের জন্য প্রয়োজন।

Advertisement

নামেই খানিকটা আঁচ করা যায়, ‘রণসজ্জা’টি কেমন। শিল্প–সাহিত্যকর্ম যুদ্ধ তো বটেই। জীবন, মনন, অস্তিত্ব–সঙ্কটের সঙ্গে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। কেউ কলম ধরার আগেই কাঁধে শ্বেতপতাকা উড়িয়ে আত্মসমর্পণ করেন, কেউ পালিয়ে যান ‘শান্ত নদীতীরে’। আবার কেউ মনে করেন, এই যুদ্ধ, এই রক্ত–ঘাম লেখকের কাছে নিয়তি। এড়ানোর কোনও উপায় নেই। বেঁচে থাকা আসলে তরবারি হাতে তরবারির সামনে দাঁড়ানো, রক্তাক্ত হওয়া এবং পাল্টা আঘাত হানা। এই সঙ্কলন দ্বিতীয় গোত্রের। যে নিজে যুদ্ধে নেমেছে, আবার পাঠককেও ডেকে নিয়েছে সঙ্গে।

সায়ম বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্প সঙ্কলনটি শেষ করে পাঠক দু’ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। এক, মনে করতে পারেন, এই বইয়ের জন্য ‘একপাঠ’ই যথেষ্ট। ফিরে পড়তে গেলে এর আসল রসটি আর পাওয়া যাবে না। আবার অন্য সিদ্ধান্তে পাঠক ভাবতে পারেন, কিছু ব্যবধানে বইটি ফের পড়া যেতে পারে। নিভৃত পাঠের জন্য ‘বছর কুড়ি পরে’ এই সঙ্কলনের খোঁজ পড়বে আবার।

একটি আয়না, একটি ব্যর্থ বিদ্রোহ ও এক আশ্চর্য ষড়যন্ত্রের কাহিনিসায়ম বন্দ্যোপাধ্যায়

২৯৯.০০

দে’জ়

দু’ক্ষেত্রেই বইটি সংরক্ষণ করতে হবে। এক তরুণ লেখকের বই বাংলার তাবড় কথাসাহিত্যিকের কাজের পাশে ঠেলাঠেলি করে, মাথা গোঁজার জায়গা করে নিচ্ছে— সহজ কাজ নয়। সায়ম পেরেছেন। কোনও তুলনা নয়, কাউকে ছোট করাও নয়: দুর্ভাগ্যের বিষয়, বাংলা গল্পে এটাই এখন বড় সঙ্কট। পাঠক মিলুক বা না মিলুক, ‘ঠাঁই’ মেলা কঠিন। সে আসছে ঠিকই, কিন্তু বড় তাড়াতাড়ি চলেও যেতে হচ্ছে। ব্যতিক্রম বড় অল্প।

নিন্দেও রয়েছে, গোড়াতে বলে নেওয়া ভাল। লেখক ভূমিকায় বলেছেন, “...গল্প শব্দ আমার পছন্দ নয়। গল্প শব্দে এক আপাত-লঘুতা আছে, অন্তত আমার কাছে। তাই আমার সকলই ‘কাহিনি’।” মনে হয়েছে, এই ব্যাখ্যা ঠিক নয়। পাঠকদের জন্য বিভ্রান্তিকর। বিশ্বের সেরা সাহিত্যিকরাও ‘গল্প’ বলতে দ্বিধা করেননি। সাহিত্যে এটি একটি পরিচিত বিভাজন-মাত্র। একটা সময় ‘না-গল্প’র খুব চল ছিল। ঘটনাহীন ঘটনা, কাহিনিবিহীন কাহিনি। আসলে সে সব ‘গল্প’ই ছিল। যে নামেই ডাকা হোক। সায়ম বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই বারোটি লেখার অন্তত আটটিতে বুনট গল্প রয়েছে। নায়ক, নায়িকা, খলনায়ক রয়েছে। কখনও ভয়, কখনও দ্বিধা, কখনও সঙ্কট, কখনও পলায়ন, কখনও আত্মসমর্পণ, কখনও আবার অবশ্যম্ভাবী যৌনতা। প্রতিটি গল্পে চিরাচরিত গল্পের মতো রয়েছে সুখ, দুঃখ, বিষণ্ণতার ক্লাইম্যাক্স। পরিচিত, নিশ্চিন্ত অভ্যেসে এই গল্প পাঠ করা যায় না। তবে স্বাভাবিক আকর্ষণও ক্ষুণ্ণ হয় না।

‘একটি আয়না, একটি ব্যর্থ বিদ্রোহ...’, ‘মলিমো দিয়সের বাড়ি আর সেই লোকটা’, ‘শয্যাতলে’, ‘ধৃতেরা আর মৃতেরা’, ‘শমীন্দ্রের কাহিনি’, ‘রেড রোডে’, ‘ও’, ‘এসকেপিস্ট’ গল্পগুলিতে এমন সব বিস্ময় ছড়িয়ে আছে, যা এড়িয়ে থাকা কঠিন। অবশ্যই সেই বিস্ময়ের ‘প্যাটার্ন’ আলাদা। গল্পগুলি নিয়ে আলাদা ভাবে আলোচনার প্রয়োজন এবং তারা দাবিও করে, পরিসর স্বল্প বলে তা থেকে বিরত থাকতে হল। বারোটি গল্প যে সুতোতে বাঁধা— লেখকের কথায় তা ‘ভয়’। লেখক সেই ‘ভয়’ চিনিয়েছেন, কখনও যে দেখাচ্ছে তার দিক থেকে, অথবা যে পাচ্ছে, তার দিক থেকে। মূল চরিত্রেরা যেমন ভয় পাচ্ছে, ভয় দেখাচ্ছেও। ভয় বাইরের থেকে বেশি ভিতরের: অস্তিত্বের, অনিশ্চয়তার, চেতনাকে আক্রান্ত ও আচ্ছন্ন করার। প্রথম গল্প দু’টিতে ভয়কে চেনার এবং তাকে ভাঙার আকুল চেষ্টা নতুন ভয়কে উন্মোচিত করে। গল্পে সত্যিই একটি আয়না আসে প্রতিবাদ হয়ে। এই আয়না নিজেকে দেখায়, আত্মার শক্তিকে চেনায়, যে শক্তি স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে চায়।

‘শয্যাতলে’ গল্পটি সঙ্কলনের সেরা পাঁচটির একটি। দামিনীর খাটের নীচ থেকে বেরিয়ে আসে দৈত্যাকৃতির এক পোকা। সে দামিনী এবং আদিনাথকে নিষ্পেষিত করে, গ্রাস করে। এই পোকা মেটামরফোসিস-এর পোকা নয়, এই পোকাকে সায়ম এনেছেন চেতনার গভীর অন্ধকার থেকে। পোকা দেশ-কাল-পাত্রকে নিজের দেহের মধ্যে নিয়ে গহনে মিলিয়েছে। নীতি, সমাজ, বিশ্বাসের দেওয়াল ভেঙেছে সদম্ভে।

পরাবাস্তব, মায়াবাস্তবের মতোই অতিবাস্তবের এক জগৎ তৈরি করেছেন লেখক। বাস্তব এবং বাস্তবের থেকেও বেশি। মাঝের সীমারেখাটি আবছা। সেই সীমা পেরোনোর ক্ষণে ঝাঁকুনি লাগে। ঝাঁকুনি যেমন ভয়ঙ্কর, কখনও ক্লেদাক্ত, কখনও মায়াময়। যৌনতা এসেছে প্রবল স্বরে। বহু দিন পর আবার বাংলা গল্প যৌনতা-বিষয়ক মিথ ভেঙেছে। ‘আমন্ত্রণ’, ‘ও’ এবং ‘এসকেপিস্ট’ গল্পে নগ্নতা, আত্মরতি, ধর্ষণ— আর্তি এবং আর্তনাদের।

গল্প বলার ভঙ্গিতে লেখক অন্য রকম। সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, অরূপরতন বসু থেকে গার্সিয়া মার্কেস ও মুরাকামিরা সাহিত্যে যে ভাষা, প্রকাশের যে ভঙ্গি তৈরি করেছেন, অস্তিত্ববাদী দর্শনের কথা যে ভাবে ভাঙতে চেয়েছেন, লেখক নিজের মতো করে তেমনই কোনও পথ তৈরি করতে চান। সেই পথ ঘাসেহারিয়েও যেতে পারে। তা নির্ভর করে লেখকের সাহসের উপর। তিনি কি পারবেন, হেঁটে যেতে? আমরা যারা বাংলা গল্পকে বিশ্বাস করি, তারা চাই, লেখক পারুন।

আরও পড়ুন
Advertisement