Book Review

তর্কে সজীব, তথ্যে একনিষ্ঠ

প্রাচীন ভারতের মানুষ তাঁদের আপন আপন অতীতকে কী কী ভাবে এবং কেন অনুধাবন করতেন, সেই জিজ্ঞাসাই তাঁর অন্বিষ্ট।

Advertisement
রণবীর চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ১০ জুন ২০২৩ ০৯:০৩
যুদ্ধ: কুরুক্ষেত্রে মুখোমুখি কৌরব-পাণ্ডব। উইকিমিডিয়া কমনস

যুদ্ধ: কুরুক্ষেত্রে মুখোমুখি কৌরব-পাণ্ডব। উইকিমিডিয়া কমনস

বিশ শতকের ইতিহাসবিদ হেমচন্দ্র রায়চৌধুরী তাঁর পলিটিক্যাল হিস্ট্রি অব এনশেন্ট ইন্ডিয়া-য় সখেদে বলেছিলেন, হেরোডোটাস ও থুকিদিদেস-এর মতো ইতিহাস রচনার পদ্ধতির দেখা প্রাচীন ভারতে মেলে না। ইউরোপীয় জ্ঞানদীপ্তির মাপকাঠিতে অতীতবীক্ষণের যে বিশেষ মানববিদ্যা বর্তমানে ‘হিস্ট্রি’ তথা ইতিহাস বলে পরিচিত, তা কি অতীত-অধ্যয়নের দেশকাল-নিরপেক্ষ একমাত্র বৈশ্বিক মাপকাঠি? অন্য দিকে, ‘ইতিহাস’ কথাটি সংস্কৃত তথা তৎসম শব্দ, যার আক্ষরিক অর্থ: অতীতে এমনটিই ছিল বা ঘটেছিল (ইতি হ আস)। পুরাণ শব্দটিও পুরাতনেরই দ্যোতক। কিন্তু সংস্কৃত ইতিহাস আর হিস্ট্রি-র সমার্থক ইতিহাস সমোচ্চারিত হলেও ভিন্নার্থক। সংস্কৃত ইতিহাস শব্দটি পুরাণ-এর সংশ্লেষে কি প্রাচীন পর্বে অতীত-চেতনার পরিচয় দেবে না? ব্রতীন্দ্রনাথ মুখোপ্যাধ্যায় (ইতিহাস একটি প্রাচীন ভারতীয় চেতনা, ১৯৬৭) তেমনই ভেবেছিলেন। এ বিষয়ে সেরা বিশ্লেষণাত্মক গবেষণা রোমিলা থাপরের (দ্য পাস্ট বিফোর আস: দ্য হিস্টরিক্যাল ট্র্যাডিশনস অব আর্লি নর্থ ইন্ডিয়া, ২০১৩): প্রাচীন ভারতের মানুষ তাঁদের আপন আপন অতীতকে কী কী ভাবে এবং কেন অনুধাবন করতেন, সেই জিজ্ঞাসাই তাঁর অন্বিষ্ট।

এই ধারার চর্চায় কণাদ সিংহের বইটি একটি মাইলফলক। ঋগ্বেদে উল্লিখিত দশ কৌমপতির বিরুদ্ধে তৃৎসু-ভরত কৌমের নেতা সুদাসের বিজয়াখ্যান (দাশরাজ্ঞ) থেকে মহাভারতের কুরুক্ষেত্র যুদ্ধকথার সানুপুঙ্খ ব্যাখ্যা তাঁর উপজীব্য। তাই বইটিতে রোমিলা থাপরের মুখবন্ধটি প্রাসঙ্গিক তো নিশ্চয়ই, তা এক বৌদ্ধিক সম্পদও। দাশরাজ্ঞ ও কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ দু’টি ঐতিহাসিক ঘটনা কি না, তা কিন্তু লেখকের আগ্রহের বিষয় নয়। তাঁর মুখ্য লক্ষ্য দুই ভিন্নধর্মী এবং পৃথক কালের সাহিত্যগত উপাদানে সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরম্পরা-পরিবর্তনের ব্যাখ্যা দেওয়া।

Advertisement

ঋগ্বেদের সম্ভাব্য কাল খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০-১০০০; মহাভারতের রচনাকাল খ্রিস্টপূর্ব ৪০০ থেকে ৫০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত, নয় শতাব্দী ব্যেপে। কালের ফারাক তো সহজেই নজরে আসে, এলাকার তফাতও লক্ষণীয়। দাশরাজ্ঞর স্থান পারুষ্ণী নদীর (আধুনিক পঞ্জাবের রাভি) তীরে; কুরুক্ষেত্রের অবস্থান আরও পূর্বস্থ বর্তমান হরিয়ানাতে। সুদাসের দ্বারা পর্যুদস্ত দশটি গোষ্ঠীর অন্যতম ছিল পুরু; বিজেতা তৃৎসু-ভরত গোষ্ঠীর সঙ্গে জুড়ে গেল বিজিত পুরু কৌমটি (নৃতাত্ত্বিক গবেষণায় এমন নজির সুলভ)। এই সংযুক্তির ফলে দেখা দিল কুরু গোষ্ঠী, মহাভারতের আখ্যান যাদের সঙ্গে পরতে পরতে জড়িত। অন্য দিকে, ঋগ্বেদে শকুন্তলা ও দুষ্যন্তের পুত্র ভরত, ভরতের বংশজরা ভারত বলে আখ্যাত। এ কারণেই কুরু-পাণ্ডব বীররা প্রায়ই ‘ভারত’ বলে সম্বোধিত হন মহাভারতে। এই স্পষ্ট যোগসূত্রের ভিত্তিতে লেখক কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের কালনির্দেশ করেন আনুমানিক ৯০০ খ্রিস্টপূর্ব অর্থাৎ পরবর্তী-বৈদিক আমলে। কৌমকেন্দ্রিক সমাজ ও রাজনীতি ওই পর্বে বংশানুক্রমিক ক্ষত্রিয়কুলের কুক্ষিগত হচ্ছে, অথচ পূর্ণাঙ্গ রাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র-সমাজ তখনও অনাগত। এই জটিল ও বহুমাত্রিক সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার উন্মোচন ঘটেছে বইটিতে।

মহাভারতের অভ্যন্তরীণ তথ্য-উপাত্তও তারই ইঙ্গিতবাহী। ব্যাসদেব রচিত ৮,০০০ শ্লোকের জয়কাব্য শুক বৈশম্পায়নের আবৃত্তিতে ২৪,০০০ শ্লোকে রূপান্তরিত; সেই কাহিনিই নৈমিষারণ্যে উগ্রশ্রবা সৌতির কথনে ৮৪,০০০ শ্লোকের কলেবর পেয়েছে। ৫৩৩ খ্রিস্টাব্দের একটি লেখতে মহাভারত এক লক্ষ শ্লোকের শাস্ত্র (শতসাহস্রীসংহিতা) বলে তার চূড়ান্ত রূপে পৌঁছল। আট বা নয় শতাব্দী ধরে কোনও সমাজই অনড় থাকে না। মহাভারত যে চারণকবিদের (সূত/মাগধ) বীরগাথামূলক সৃষ্টি থেকে ভার্গব-ব্রাহ্মণদের হস্তাবলেপনে বৈষ্ণবভক্তি-আশ্রয়ী শাস্ত্রে পর্যবসিত হল, ঠাসবুনোট পাঁচটি অধ্যায়ে তার সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক টানাপড়েনের জঙ্গম এক সিংহাবলোকন উপহার দিয়েছেন লেখক। তাঁর আলোচনার কেন্দ্রে আছেন যুধিষ্ঠির এবং (একাধারে) বৃষ্ণি-বীর, দ্বারকাধীশ, কূটনীতিক ও দর্শনশাস্ত্রী কৃষ্ণ। মহাভারতে উল্লিখিত কোনও ব্যক্তিই যে-হেতু একমাত্রিকতায় এবং সোজাসাপটা সাদা-কালোতে ধরা দেন না, তাই সেই পালাবদলের ছন্দকে অদ্যতন ইতিহাসচর্চার আশ্রয়ে মূর্ত করা অত্যন্ত উপভোগ্য, কিন্তু সুকঠিনও।

ব্যাখ্যার অভিনবত্বে সবচেয়ে চমকপ্রদ দু’টি বিষয়ের প্রথমটি হল গীতার বিখ্যাত বক্তব্য— শ্রীকৃষ্ণ-সৃষ্ট চতুর্বর্ণব্যবস্থার আধার হল গুণ ও কর্মের বিভাজন, যা ব্যক্তিবিশেষের স্ব-ভাব থেকে উদ্ভূত এবং যা স্ব-ধর্মের অনুকূল। লেখক আর এক ধাপ এগিয়ে দাবি করেছেন, এই উচ্চারণ নিছক জন্মের দ্বারা বর্ণ-নির্ধারণের তত্ত্বের এক সাধুতর বিকল্পের পথ প্রশস্ত করেছিল। তিনি শ্রীকৃষ্ণকে ছান্দোগ্য উপনিষদের আলোকে ঘোর আঙ্গিরসের শিষ্য দেবকীপুত্র কৃষ্ণের সঙ্গে শনাক্ত করেছেন। তাই তাঁর সিদ্ধান্ত, বৌদ্ধ, জৈন, আজীবিক এবং উপনিষদীয় মতে জন্ম-চিহ্নিত বর্ণব্যবস্থার কঠোর সমালোচনার সঙ্গে গীতার বচনটিও সমপর্যায়ের। লেখকের সঙ্গে আমি সহমত নই। পতঞ্জলির মহাভাষ্য (খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতক) যেখানে শ্রমণ ও ব্রাহ্মণের বৈরিতাকে অহি-নকুলের সম্পর্ক দিয়ে তুলনা করে, সেখানে বেদ-অপ্রামাণ্যবাদী শ্রমণগোষ্ঠীর সঙ্গে বৈদিক ঐতিহ্যবাহী ব্রাহ্মণ্য অনুশাসনকে একাসনে বসানো অসম্ভব। তার থেকে অন্য ভ্রান্তিতেও পৌঁছনোর আশঙ্কা রয়ে যায় যে, বৌদ্ধ, জৈন মতবাদগুলি আসলে ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দুধর্মের বিদ্রোহী সন্তান মাত্র, যারা আবার তাদের মূল পরিবারে ফিরে আসবে। একলব্য বা জতুগৃহে জীবন্ত-দগ্ধ নিষাদ পরিবারটির দশা কোন গুণকর্মের দোহাই পেড়ে দর্শানো যাবে?

গ্রন্থপ্রণেতার দ্বিতীয় প্রতিপাদ্য: মহাভারতের এক মৌলিক অবদান আনৃশংস্য (নৃশংসতা পরিহারের) তত্ত্ব, যার সঙ্গে অনুক্রোশ (অনুকম্পা)-এর ধারণাও জড়িত। নৃশংসতা পরিহারের অর্থ অহিংসা নয়, প্রয়োজনে অপরিহার্য ন্যূনতম হিংসার প্রয়োগ এ তত্ত্বে প্রতিষ্ঠিত। মহাভারতে আনৃশংস্য-র সাতটি নজির পেশ করেছেন লেখক। তার তিন প্রধান উদাহরণ— যক্ষের প্রশ্নের উত্তরে যুধিষ্ঠিরের জবানিতে আনৃশংস্য-র শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিপাদন; ধর্মব্যাধের উপাখ্যান এবং স্বর্গারোহণের অবিচল সঙ্গী (ধর্মরূপী) সারমেয়টিকে পরিত্যাগ করে স্বর্গে প্রবেশে যুধিষ্ঠিরের দৃঢ় আপত্তি। আনৃশংস্য-র তাত্ত্বিক অবস্থান ব্যাখ্যায় তাঁর অগ্রপথিক মুকুন্দ লাঠ ও শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায়। অতি উচ্চমানের যুক্তি ও তথ্যের আধারে আশ্রিত এই ব্যাখ্যার ব্যাপারেও আমার ভিন্ন মত আছে। আনৃশংস্য এবং অনুক্রোশ শব্দ দু’টি নিশ্চয়ই প্রথম দেখা দিল মহাভারতে। কিন্তু অনুক্রোশের মূলে আছে যে করুণার তত্ত্ব, তা বৌদ্ধচিন্তার আগে কোথাও আছে কি? যে অহিংসার প্রাচীন প্রয়োগকর্তা বলে অশোক কীর্তিত, সেই অশোক যে প্রয়োজনে অবিমিশ্র অহিংসা সরিয়ে দিতে প্রস্তুত, তা তো গ্রন্থপ্রণেতাও বলেছেন। তাঁর ত্রয়োদশ শিলানুশাসনের (যেখানে কলিঙ্গবিজয় উল্লিখিত) একেবারে অন্তিম অংশে অশোক আশা ব্যক্ত করেছেন, তাঁর উত্তরসূরিরা আর নতুন বিজয়ের পথে হাঁটবেন না; তবে তা যদি একান্তই অপরিহার্য হয়, তবে তার ন্যূনতম ব্যবহার ঘটাবেন এবং লঘু দণ্ডের প্রয়োগ করবেন। আনৃশংস্য শব্দের মূল দর্শন এই উক্তিতেই নিহিত; অশোক-উক্তির চেয়ে এর প্রাচীনতর কোনও সাবুদ নেই। ব্রাহ্মণ্য মতাদর্শের অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি হল প্রতিপক্ষের মূল বক্তব্য নিঃশব্দে ও মসৃণ ভাবে আত্তীকরণ করা। মহাভারতের আনৃশংস্য তত্ত্ব উদ্ভাবনের নেপথ্যে এই আত্তীকরণ-প্রক্রিয়া সক্রিয় ছিল কি না, তা ভাববার।

গ্রন্থের সেরা সম্পদ আকর তথ্যসূত্রের উপর লেখকের নীরন্ধ্র দখল, সংস্কৃত ভাষায় ব্যুৎপত্তি, পূর্বপক্ষ-প্রতিপক্ষের মধ্যে সুস্থ বিতর্কের অবকাশ দেওয়া এবং তাঁর বিপুল আয়াস (গ্রন্থপঞ্জি ও নির্ঘণ্ট তার তর্কাতীত নিদর্শন)। প্রাচীন ভারতের জয়গানের অছিলায় যে আকাট নির্মনন এখন জাঁকিয়ে বসছে, তার থেকে বাঁচার নির্মল আলো-বাতাস নিয়ে হাজির লেখক।

আরও পড়ুন
Advertisement