book review

এত বিপদ, তবু পাহাড় টানে কেন

আস্তে আস্তে স্বাস্থ্য ফিরে পাওয়ার পর আবার পাহাড় চড়া শুরু করেন জিম। এক দিন এক শৃঙ্গে পৌঁছনোর পর তাঁর সঙ্গী বলেন আর এক বার এভারেস্ট চড়ার চেষ্টা করতে। রাজি হয়ে যান জিম।

Advertisement
সুনন্দন চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ০৮ অক্টোবর ২০২২ ১০:০৫

সামান্য অসতর্কতায় টাকরা ঝলসে যাওয়ার সম্ভাবনাও পাহাড়ের এক মস্ত বিপদ, আমরা ভাবতে পারি কি? সেই অনন্ত বরফের রাজ্যে প্রতিফলিত অতিবেগুনি রশ্মি যেমন চোখে লাগলে স্নো ব্লাইন্ডনেস হতে পারে, তেমনই বেদম হয়ে পড়ে বেশি ক্ষণ হাঁ করে নিঃশ্বাস নিলে সেই প্রতিফলিত রশ্মি টাকরাও ঝলসে দিতে পারে।

জিম ডেভিডসন এমন খুঁটিনাটি দিয়ে জ্যান্ত করে তুলেছেন তাঁর এভারেস্ট অভিযান। জিম তাঁর প্রিয়তম বন্ধু মাইককে হারিয়েছিলেন এক হিমবাহের খপ্পরে। বেদনাক্লিষ্ট অপরাধবোধ দীর্ঘ দিন তাঁকে বিমর্ষ করে রেখেছিল। এভারেস্ট বেসক্যাম্পের অল্প আগে কালাপাত্থর নামে যে গিরিশিরাটি আছে, তার চূড়ার এক কোণে মাইকের অস্থিভস্ম প্রোথিত করে গিয়েছিলেন জিম। ফেরিচে থেকে গোরখশেপের পথে এমন অসংখ্য প্রস্তর ত্রিভুজ রয়েছে নামী এবং অনামী পরলোকগত পর্বতারোহীদের জন্যে। পাহাড়িয়াদের সেই ভুবনে মাইককে জায়গা করে দিতে পেরে জিমের মনের ভার খানিকটা লাঘব হয়েছিল, আর জিম আরও জড়িয়ে পড়েছিলেন এভারেস্টের সঙ্গে।

Advertisement

প্রস্তুতিতে কোনও ফাঁকি দেননি জিম। সমস্ত পরিকল্পনা নিখুঁত ভাবে করেছিলেন। কিন্তু ভূমিকম্পটা হিসাবের মধ্যে রাখেননি। কিন্তু সে কথা পরে। আগে তাঁকে পার হতে হবে এভারেস্ট সাউথ কল দিয়ে অভিযানের প্রথম দুর্লঙ্ঘ্য বাধা খুম্বু আইসফল। অসংখ্য ভঙ্গুর বরফের স্তম্ভখচিত এক তুষারপ্রান্তর ভেদ করে উঠে আসতে হবে এক নম্বর শিবিরে। মধ্যে মধ্যে আছে হিমবাহের লম্বা ফাটল, যেগুলোর উপর অবহেলায় ফেলা আছে পলকা চেহারার মই। সেই আড়াআড়ি করে রাখা মই-ই ফাটল পার হওয়ার সেতু। আর বরফের দেওয়ালের গায়ে গুঁজে রাখা পিটন ধরে ধরে চলে গেছে দড়ির পথ। আমেরিকা আর ইউরোপে নিয়মিত পাহাড় চড়া জিমের চোখে সে দড়ির পথও যথেষ্ট নিরাপদ দেখায়নি। আর একটা কথা ওঁর মাথায় ঘোরে। এজেন্সির সঙ্গে আসা বিদেশি পর্বতারোহীরা অন্তত এই দড়ির পথের নিরাপত্তাটুকু পাচ্ছেন, কিন্তু যে শেরপারা এগুলো লাগিয়েছেন, তাঁরা তো উঠেছেন দড়ি বিনা-ই। জিমের বইয়ের মূল কাহিনির নীচে অন্তঃসলিলা ধারা এই শেরপাদের গল্প। তাঁরা পাহাড়ে চড়েন— শখের এবং পেশাদার পর্বতারোহীদের থেকে অনেক বেশি বার— শখে নয়, দুর্নিবার কোনও আকর্ষণে নয়, শুধুমাত্র দ্রুত অর্থ উপার্জন করে পরিবারের অবস্থা ফেরানোর তাগিদে।

এক নম্বর শিবিরে যখন ঘুমোতে গেলেন জিম, আরও শত শত অভিযাত্রীর মতো তিনিও জানতেন না কী হতে চলেছে। দূরাগত একটি গর্জনে ঘুম ভাঙে তাঁর। প্রথমে ডান দিক, তার পর বাঁ দিক থেকে তুষারধস নামার আওয়াজ আসে। তাঁবুর চেন খুলতে যেতেই বুনো ঘোড়ার মতো লাফিয়ে ওঠে তাঁবু। ভূমিকম্প! তাঁবুর বাইরে এসে তাঁরা দেখলেন এক বিহ্বল, বিভ্রান্ত ভিড়। কিছু ক্ষণের মধ্যেই ধাবিত তুষারকণা আচ্ছন্ন করে ফেলল তাঁদের। কিছু ক্ষণ পরে পরিস্থিতি খানিক শান্ত হল। সবাই বুঝেছেন, অপেক্ষা করা ছাড়া আর কিছুই করার নেই। ন্যুপ্তসে আর লোতসে-র দেওয়ালের মাঝখানে একটা তুষার প্রান্তরে তাঁদের তাঁবু। ভূমিকম্পের পরের ধাক্কা বা আফটারশক তাঁদের শেষ করে দিতে পারে। কিংবা ভূমিকম্পের ফলে ন্যুপ্তসের আর লোতসের দিক থেকে যে তুষারধস আসার শব্দ জিম-রা তাঁবু থেকে পেয়েছিলেন, তা যদি এই অবধি এসে পৌঁছয়, তা হলেও তাঁরা হারিয়ে যেতে পারেন চিরদিনের মতো।

সেই দীর্ঘতম রাতও শেষ হয়। আশ্চর্য ভাবে এক নম্বর শিবিরে সবাই সহি সালামত। কিন্তু জিমের জিপিএস যন্ত্র— যেটা দিয়ে মেসেজও দেওয়া যায়— গুঞ্জন করেছে সারা রাত। তাঁর দেশ থেকে ঘন ঘন যোগাযোগ করছে বিভিন্ন টিভি চ্যানেল— নেপালের এই বৃহত্তম বিপর্যয়ের মধ্যে থাকা এক প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ চায় সবাই। কিন্তু জিমকে যে কথা বলতে হচ্ছে সঙ্গীর স্যাটেলাইট ফোন ধার করে, তাঁবুর নিরাপদ আশ্রয়ের বাইরে, হিমাঙ্কের নীচে, ঝোড়ো হাওয়া মুখে নিয়ে। ফোন ধরার জন্য দস্তানা খুললে অসাড় হয়ে যাচ্ছে আঙুল। তবু তাঁরা যে ঠিকঠাক আছেন, এটা পরিজনদের জানিয়ে দেওয়ার এই অমূল্য সুযোগ। আর বেসক্যাম্পে, উপরের শিবিরগুলোতে, বাকি নেপালে কী ঘটেছে, তারও একটা আন্দাজ পাওয়া দরকার।

জানা গেল, গোটা নেপাল বিধ্বস্ত। এভারেস্ট বেসক্যাম্প এবং উপরের দিকের শিবিরেও খবর খারাপ। শেরপাদের একটি দল অসীম ঝুঁকি নিয়ে নীচে নামার পথের খবর নিতে গিয়ে দেখে এল খুম্বু আইসফল লন্ডভন্ড হয়ে গেছে, ছিঁড়েখুঁড়ে উড়ে গিয়েছে দড়ির পথ। অর্থাৎ এই মৃত্যুফাঁদ থেকে বেরোনোর একমাত্র উপায় হেলিকপ্টার। কিন্তু, এই উচ্চতায় হেলিকপ্টারের উড়ে আসা কঠিন, খারাপ আবহাওয়ায় অসম্ভব। এক-এক উড়ানে মোটে দু’জন করে যেতে পারবে। সুতরাং বেশ কিছু ক্ষণ আবহাওয়া সদয় থাকা জরুরি।

প্রলয়ের পরে সহসা এক অতি ঝকঝকে সকাল এল। সমস্ত উৎকণ্ঠার শেষে এক নম্বর শিবিরের সবাইকে নামিয়ে আনা গেল বেসক্যাম্পে। আর সেখানে এসেই প্রত্যক্ষ হল সহ-অভিযাত্রীদের মৃত্যুর মিছিল। তছনছ হয়ে যাওয়া জীবন কুড়িয়ে বাড়িয়ে স্বাভাবিকের দিকে এগোনোর প্রক্রিয়ার মধ্যে তখন সবচেয়ে প্রবল হয়ে উঠেছে বাড়ি ফিরে যাওয়ার দুর্দমনীয় এক টান।

জিমের শিকড় তাঁর ক্যাথলিক পরিবারের গভীরে। তাঁর বাবা শিখিয়েছেন সঙ্কটে শান্ত থাকতে। তাঁর স্ত্রী-পুত্র-কন্যা, তাঁর পাহাড় চড়ার বন্ধুরা— সবার সঙ্গে নিবিড় এক ভালবাসার বন্ধন তাঁর। এঁদের সমর্থন থেকেই শক্তি সঞ্চয় করেন জিম। সেই বৃত্তে ফিরে আসা এ বার তাঁর কাছে সত্যি এক পুনর্জন্ম। কিন্তু নেপালও রয়েছে তাঁর ভালবাসার বৃত্তে। তাই পুরনো জীবনে ফিরে তাঁর নতুন এক কাজ হয়ে দাঁড়ায় বিধ্বস্ত নেপালের জন্যে অর্থসংগ্রহ।

আস্তে আস্তে স্বাস্থ্য ফিরে পাওয়ার পর আবার পাহাড় চড়া শুরু করেন জিম। এক দিন এক শৃঙ্গে পৌঁছনোর পর তাঁর সঙ্গী বলেন আর এক বার এভারেস্ট চড়ার চেষ্টা করতে। রাজি হয়ে যান জিম। আবার শূন্য থেকে শুরু করতে হবে তাঁকে। এই বিরাট ব্যয়বহুল অভিযানের খরচ জোগাড় করতে হবে। চালিয়ে যেতে হবে কঠোর অনুশীলন। তার পর স্মৃতির সরণি বেয়ে আবার খুম্বু আইসফল। তার পর ক্রমশ ঢুকে যেতে হবে সেই অতি হিম কুহকের রাজ্যে, যেখানে যেতে পারে অল্প কিছু কুশলী ভাগ্যবান। ফেরে আরও কম।

দ্য নেক্সট এভারেস্ট: সারভাইভিং দ্য মাউন্টেন’স ডেডলিয়েস্ট ডে অ্যান্ড ফাইন্ডিং দ্য রেসিলিয়েন্স টু ক্লাইম্ব এগেন

জিম ডেভিডসন

৬৯৯.০০

ম্যাকমিলান

এই জান বাজি রেখে পাহাড়ে কেন চড়তে যায় কিছু বেওকুফ, সে ধাঁধার উত্তর কেউ কখনও খুঁজে পায়নি। জিম তাঁর নিজের মতো করে একটা মীমাংসা করেছেন। কথাটা হল, জীবনে আমরা যেখানে পৌঁছতে চাই, সেখানেই কি আমাদের যাত্রা শেষ, না কি পরের উচ্চতম শিখর, পরের এভারেস্টের জন্যে আবার প্রস্তুতি নিতে হয়?

জিমের গল্প বলার ধরনটি কথকতার। তিনি জানেন, ক্লাইম্যাক্সের মুহূর্তটি তৈরি করার পরেই শেষটা বলতে নেই। তখন তিনি ফিরে যান পুরনো কোনও গল্পে। অতীতের কোনও এক লহমা, যা তাঁকে প্রস্তুত করেছিল যেন আজকের এই সঙ্কটের জন্যই। নিজের গল্প তিনি বলেন অপূর্ব এক বিনয়ের সঙ্গে, প্রচারবিমুখ ভাবে, যার ফলে পাঠকও ক্রমে ক্রমে ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠে সেই প্রতিটি চরিত্রের সঙ্গে, যাঁরা জিমের এই যাত্রায় রয়েছেন। জিমের কাছে এভারেস্ট একটি যাত্রা, অভিযান নয়।

হিমবাহবিদ্যার ছাত্র জিম সমস্ত অতিকথন পরিহার করে পর্বত আরোহণের বিজ্ঞান এবং প্রকৌশলের খুঁটিনাটি ব্যাখ্যা করেন সহজবোধ্য ভাষায়। যাঁরা সমঝদার, আর যাঁরা দার্জিলিং যাওয়ার আগে উইল করে যান, উভয়ের কাছেই বইটি সমান সমাদৃত হবে। ঝানু পর্বতারোহীরা, যাঁরা এভারেস্ট অভিযানের স্বপ্ন দেখছেন, তাঁরা আরও নানা বর্ণনার সঙ্গে মিলিয়ে আঁচ করতে পারবেন এখন অবস্থা কেমন, এবং এখন ওখানে কী কী করণীয়। আর আমার মতো ছাপোষা পাঠক রোমাঞ্চকর ছায়াছবি দেখার আনন্দ পাবেন।

আরও পড়ুন
Advertisement