লীলা মজুমদার লিখেছিলেন, রবীন্দ্রনাথের কয়েকটি গল্পের পাশে দাগ দিয়ে তাঁর এক প্রবীণ আত্মীয়া সেগুলো পড়তে নিষেধ করেছিলেন। অতঃপর সেই ‘দাগী’ গল্পগুলো তন্নতন্ন করে পড়েও খারাপ কিছু খুঁজে না পেয়ে অতিশয় হতাশ হয়েছিলেন লীলার দিদি। লীলার সরস লেখনীর আরও একটি সোনালি দানা হয়ে এ গল্প গেঁথে ছিল মনে। নারী ইতিহাস: নানা প্রসঙ্গ দেখাল, নারীচরিত্রের শুদ্ধতা বজায় রাখতে রবীন্দ্রনাথকে ‘সেন্সর’ করার চেষ্টা চলেছে প্রায় ধারাবাহিক ভাবে। ১৯১৫ সালে ‘স্ত্রীর পত্র’ প্রকাশিত হওয়ার পরে নিন্দার ঝড় উঠল, নানা পত্রিকায় চারটি ‘জবাব’ বেরোল। তার দু’টি (‘প্রকৃত স্ত্রীর পত্র’, ‘মৃণালের কথা’) খোদার উপর খোদকারি গোছের— ‘চরণতলাশ্রয়চ্ছিন্ন মৃণাল’-এর সুবুদ্ধি ফিরিয়ে ঘরে ফেরানোর বিবরণ। আর একটিতে (‘ভর্ত্তার উত্তর’) বিলাতি শিক্ষার প্রভাবে জন্মানো বিধ্বংসী স্বাতন্ত্র্যবোধের জন্য মৃণালকে তিরস্কার করেছে তার স্বামী। বলছে, হিন্দু বিবাহের বন্ধন ছেঁড়ার সাধ্য মৃণালের মতো নব্যনারীর নেই।
বাংলায় মানবীবিদ্যা চর্চার একটি ধারা বয়ে গিয়েছে উনিশ শতকে মেয়েদের লেখালিখির পুনরুদ্ধারে। সেই সঙ্গে, উনিশ-বিশ শতকের পত্রপত্রিকায় মেয়েদের শিক্ষা, তাঁদের কর্তব্য বিষয়ে প্রকাশিত রচনার নিবিড় পাঠও যোগ হয়েছে। এ ধরনের বই এখন বাংলা প্রকাশনায় একটা শ্রেণি, তার চাহিদাও আছে। আত্মকথা, উপন্যাস, বা প্রবন্ধ থেকে উদ্ধৃতি, সঙ্গে কিছু মন্তব্য জুড়ে দিলে শব্দের সংখ্যা বাড়ে, সুখপাঠ্যও হয়। ঝুঁকির দিকটা হল, গল্প-উপন্যাসের চরিত্র ও ঘটনা থেকে সমাজ-রাজনীতি সম্পর্কে সিদ্ধান্তে পৌঁছনোর একটা ঝোঁক তৈরি হয় লেখক-পাঠকদের মধ্যে। অপর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায় ইতিহাসের গবেষক। তিনি এই ফাঁদ এড়িয়েছেন, তুলে এনেছেন ইতিহাসের প্রচলিত ভাষ্যের ত্রুটি সংশোধন করার মতো উপকরণ। যেমন, অনেক ইতিহাসবিদ বলেন, বিধবা বিবাহ আইন (১৮৫৬) হওয়ার পরে নারীমুক্তির প্রশ্নটি আগের তীব্রতা হারিয়েছিল, আইন করে সমাজ সংস্কারের ঝোঁক স্তিমিত হয়ে এসেছিল বাংলায়। সে সময়ের পত্রপত্রিকা খুঁটিয়ে পড়লে কিন্তু দেখা যায়, উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে মেয়েদের নিয়ে বাঙালি পুরুষের চিন্তা কমেনি, বরং আরও জাঁকিয়ে বসেছে।
নারী ইতিহাস: নানা প্রসঙ্গ
অপর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায়
৫৯৯.০০
সম্পর্ক
অপর্ণা বলছেন, জাতীয়তাবাদের উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষিত বাঙালি পুরুষ বিদেশি শাসকের দ্বারা দেশের আইনে পরিবর্তনের দাবিকে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন ঠিকই, তা বলে আইনি সংস্কারই তো আর ‘উইমেন’স কোয়েশ্চন’-এর সবটা নয়। স্ত্রীর কাছে স্বামীর তথা সমাজের কী প্রত্যাশা, তা নিয়ে একের পর এক প্রতিবেদন, বই, উপদেশমূলক নানা সন্দর্ভ প্রকাশিত হয়েছে। এমন ‘পাঠ্য’ তৈরির পাশাপাশি চলেছে ‘অপাঠ্য’ নাটক-নভেল পড়া থেকে মেয়েদের নিবৃত্ত করার প্রাণপণ চেষ্টা। পরিচারিকা পত্রিকায় জনৈক লেখক (১৮৮০) লিখছেন, ‘অনীতিপূর্ণ’ নাটক-নভেল পড়াকে স্ত্রীস্বাধীনতা বলা চলে না। আসলে সংস্কারপন্থী আর রক্ষণশীল, দু’তরফেই উদ্বেগ ছিল— প্রেম-ভরপুর নভেল পড়ে মেয়েরা যদি বেজাতের পাত্র নির্বাচন করে, বাড়ির কাজ না করে? বিধবার প্রেম, বিবাহ-বহির্ভূত প্রেমের গল্প লেখায় নিন্দিত হয়েছেন বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র। একের পর এক বটতলার প্রহসনে দেখানো হয়েছে নভেল-পড়া মেয়েদের বেআক্কেলে প্রেমের করুণ পরিণাম। এর কারণ নির্ণয়ে অপর্ণা যথাযথ, লিখছেন— “হিন্দু জাতীয়তাবাদী চিন্তায় সংসার, সমাজ এবং জাতি, এই তিনটি হল এককেন্দ্রীয় বৃত্ত, ছোটো থেকে বড়ো, এবং এদের কেন্দ্রবিন্দুতে হল নারী, নির্ধারিত গুণসম্বলিত নারী। শুধু যে সংসার ও সমাজের স্থিতি ও শান্তির ভিত্তি তাই নয়, হিন্দু জাতির গৌরবের স্তম্ভ।”
এমন ‘স্তম্ভিত’ করে রাখায় কী দশা হয়েছিল মহিলা লেখকদের, তারও অনুসন্ধান করেছেন অপর্ণা। যেমন, কেবল যে উপন্যাসগুলোর (সাবেক হিন্দুয়ানির পক্ষে) সুবিধাজনক পাঠ সম্ভব, সেগুলির সমালোচনা করা হত। “নিরুপমা দেবী, অনুরূপা দেবী, আশালতা সিংহ, শৈলবালা ঘোষজায়া, এঁদের বেশির ভাগ উপন্যাস সম্বন্ধে সমালোচকেরা আশ্চর্যজনক ভাবে নীরব।” আর একটি সমস্যা, প্রকাশক-সমালোচকদের সঙ্গে মহিলা লেখকদের জনসংযোগের অভাব। ফলে নিজেদের সময়ে যে মহিলা সাহিত্যিকরা অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিলেন, যাঁদের লেখা থেকে নাটক মঞ্চস্থ হয়েছিল, তাঁরাও লেখা থামানোর পর হারিয়ে গিয়েছেন।
বইয়ের প্রবন্ধগুলি নানা মাপের, নানা সময়ে লেখা, তবে কেন্দ্রীয় বিষয় ও মৌলিক চিন্তাধারাটি এক। গবেষকদের আগ্রহ জাগবে বহু আকর গ্রন্থ, পত্রিকার উল্লেখে। সর্বাধিক মূল্যবান অপর্ণার অনুসন্ধানী পর্যবেক্ষণ, বিশ্লেষণে পারদর্শিতা। দূর থেকে যাকে মনে হয় সাফল্যের মাইলফলক, গবেষকের অণুবীক্ষণে তা-ই হয়ে ওঠে এক বহুস্তরীয় ঘটনা, যার ঘাত-প্রতিঘাত আজও নিত্য স্পন্দিত হচ্ছে জাতির জীবনে। প্রথম যে মেয়েরা বেথুন বা ডায়োসেশনে যাচ্ছিলেন, তাঁরা যেমন শিক্ষার ইতিহাস তৈরি করছিলেন, তেমনই মোকাবিলা করছিলেন যৌন হয়রানির— বাসে, রাস্তায়, ক্লাসরুমে। উনিশ শতকের বাংলায় নারীশিক্ষার দ্রুত বিস্তারের উল্টো পিঠে এই যন্ত্রণার ফোঁড়গুলি তুচ্ছ নয়, চাপা দেওয়ার নয়। ইতিহাসের কাজ আস্ফালন নয়। সার্থকতা আর বিপন্নতা, দুইয়েরই খোঁজ করেছে এ বইটি