—প্রতীকী চিত্র।
আজকের বাঙালি, বিশেষত যাঁদের বয়স পঞ্চাশের নীচে, তাঁদের কাছে সম্ভবত রথীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তের নামটি অপরিচিত ঠেকবে। কিন্তু আধুনিক পশ্চিমবঙ্গ বা আধুনিক ভারতকে বোঝার জন্যই তাঁকে, এবং তাঁর মতো আরও অনেককে চেনা-জানা জরুরি। পেশাগত পরিচয়ে তাঁরা আমলা, আইএএস অফিসার। উপনিবেশ থেকে ভারতের স্বাধীন প্রজাতন্ত্র হয়ে ওঠার যাত্রায় তাঁরা অতি গুরুত্বপূর্ণ কুশীলব। ব্রিটিশ রাজতন্ত্র, স্বাধীনতা আন্দোলন, গণতন্ত্র, বামপন্থা; বদলে যাচ্ছে সমাজ, দেশ, মানুষ, বদলে যাওয়া এই প্রেক্ষাপটে প্রশাসক কোথায়? তিনি কি নিজেকে পাল্টাচ্ছেন? যদি পাল্টান, কী ভাবে? তিনি কি সমাজকে নেতৃত্বও দিচ্ছেন? যদি দেন, কী ভাবে দিচ্ছেন? তাঁর জীবনের, মনের ঘাত-প্রতিঘাতগুলোই বা ঠিক কেমন? আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর বইয়ে উত্থাপন করেছেন এমনই কিছু প্রশ্ন।
যাঁরা আশি-নব্বইয়ের দশকে জ্যোতি বসুর শাসনের সাক্ষী, তাঁদের কাছে রথীন সেনগুপ্ত পরিচিত নাম। ঔপনিবেশিক আমলের আইসিএস-রা, এমনকি প্রথম যুগের ভারতীয় আইসিএস-রাও, ছিলেন গজদন্তমিনারের বাসিন্দা। কিন্তু নতুন জমানার আইএএস রথীন সেনগুপ্ত কলকাতা বইমেলায় এক প্রকাশকের স্টল থেকে অন্য প্রকাশকের স্টলে বই ঘাঁটতেন, অ্যাকাডেমিতে নতুন নাটক হলেই পৌঁছে যেতেন, যেতেন গঙ্গাসাগর মেলার ভিড়ে। দেশভাগ, উদ্বাস্তু আন্দোলন, ষাটের দশকে কমিউনিস্ট পার্টির উত্থান, নকশাল রাজনীতি, বাংলাদেশের স্বাধীনতা— প্রতিটি লগ্নে নিজের তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণের দক্ষতাকে রাষ্ট্রের কাছে অর্থবহ করে তুলেছিলেন তিনি, তখনকার পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যসচিব।
গণতন্ত্রে যখন ভোটে জিতে আসা রাজনৈতিক নেতা ও রাজনৈতিক দল চালিকাশক্তি, তখন পরীক্ষায় পাশ করে আসা প্রশাসক রাষ্ট্রযন্ত্রের কাছে নিজেকে কিছুটা হলেও কী ভাবে অপরিহার্য করে তুলতে পারেন, তার প্রমাণ হয়তো রথীন সেনগুপ্ত। অন্য ভাবে দেখতে গেলে রাজনৈতিক দল ভোট পরীক্ষায় পাশ বা ফেল করে প্রতি পাঁচ বছর, প্রশাসককে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হয় হয়তো বা প্রতি দিন। ভবিষ্যতে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় প্রশাসককে বোঝার জন্য কোনও পিএইচ ডি গবেষণা হলে, তাতে রথীন সেনগুপ্ত এক কেন্দ্রীয় চরিত্র হয়ে থেকে যাবেন বলে আশা করা যায়।
আমলার মন
আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়
২০০.০০
দে’জ
কিন্তু সবাই রথীন সেনগুপ্ত নন। পৃষ্ঠা উল্টে পড়ি তরুণ দত্ত-র কথা। তিনিও মুখ্যসচিব ছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পর শ্মশানে শেষ দেখা দেখার জন্য প্রায় কেউ নেই। অন্য এক, তুলনায় কম ক্ষমতাশালী, মহকুমা শাসকের প্রয়াণের খবর পেয়ে লেখক যখন ডায়মন্ড হারবারে পৌঁছেছিলেন, তখন শহরের কোনও হেলদোল ছিল না। মহকুমা হাসপাতালের সারি সারি বেডের একটিতে পড়ে ছিল মহকুমা শাসকের মৃতদেহ।
কিন্তু এমনটা হয়তো হত না, আমলাদের একাংশের সঙ্গে সমাজের বিচ্ছিন্নতা এমন প্রকট হত না, যদি ব্রিটিশ আমলের এক বাঙালি আইসিএস গুরুসদয় দত্ত-র ব্রতচারী ভাবনা স্বাধীন দেশে পশ্চিমবঙ্গের শিকড়ে প্রোথিত হত। রথীন সেনগুপ্ত যেমন গণতান্ত্রিক ও বাম জমানার বর্ণময় প্রশাসক, গুরুসদয় দত্ত তেমনই ক্ষয়িষ্ণু উপনিবেশিক শাসনের পরিমণ্ডলের মধ্য থেকে উৎসারিত নতুন স্বদেশি জাতীয়তাবাদের পথিকৃৎ। ব্রিটিশ শাসনের শেষের দশকগুলোতে ভারতীয় আইসিএস-দের চিন্তায় একটা কল্যাণব্রত উঠে এসেছিল। ১৯৪৭-পরবর্তী ভারত রাষ্ট্রের চেহারাটা পূর্ণতায় অনুধাবন করতে গেলে শুধু ঔপনিবেশিক শাসনবিরোধী গান্ধীবাদী বা চরমপন্থী আন্দোলনকে বুঝলেই হবে না। প্রশাসনের একটা মহলে গড়ে ওঠা এই কল্যাণব্রত-র কথাও মনে রাখা দরকার।
গুরুসদয় দত্ত এই বিষয়ে বিশেষ ভাবে স্মরণীয়। তিনি এক দিকে যেমন ব্রতচারী আন্দোলনের জনক, অন্য দিকে তেমনই বাংলার লোকশিল্প ও লোককলার বিশাল ভান্ডারকে বোঝার ক্ষেত্রে পথিকৃৎ। তাঁর মন ধরেই ভদ্রলোক বাঙালি নিম্নবর্গের মানুষের সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচয়ের শিকড় খুঁজে পেল। শ্রমকে মর্যাদার আসনে বসিয়ে, বাঙালি সাংস্কৃতিক জীবনকে এক নতুন ধারায় চালনা করার ব্রতে সুদূরচারী হয়েছিলেন গুরুসদয়। নিম্নবর্গের প্রতি গুরুসদয়ের গভীর মমতা ছিল, এবং বৃহত্তর বাঙালি জীবনকে বুঝে তাকে এক স্বদেশি জাতীয়তাবাদের রূপ দিতে চেয়েছিলেন তিনি।
ভারত যে সাধারণতন্ত্রের রূপ পেল ১৯৫০-এ, তার পিছনে শুধু মহাত্মা গান্ধীর জাতীয়তাবাদ বা রবীন্দ্রনাথের ভাবনা ছিল না, ছিল গুরুসদয় দত্তের মতো মানুষের অবদানও। বাংলার প্রাদেশিক সংস্কৃতি চিন্তন ও ভারত ভাবনা, যা গুরুসদয়ের মধ্যে আমরা দেখি, তা ভারতের ফেডারাল ব্যবস্থার পক্ষে জোরালো সওয়াল। ১৯৪৭-পরবর্তী ভারত অবশ্য ফেডারেশন হয়নি। কেন্দ্র-রাজ্য দ্বৈরথে, রথীন সেনগুপ্ত যখন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর মুখ্যসচিব, তখন পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে রাজ্যের স্বার্থে সর্বদাই কেন্দ্রের সঙ্গে যুযুধান হতে হয়েছে।
কিন্তু তার চেয়েও অনেক গভীরে তাঁদের মিল আছে। গুরুসদয় লোকমনকে এলিট মনের অঙ্গ করতে ব্রত নিয়েছিলেন। রথীন্দ্রনাথ এলিট গণ্ডি থেকে বেরিয়ে লোকমনের সন্ধান করেছেন এবং সেখানকার বিশল্যকরণী দিয়ে প্রশাসনের উচ্চতম মহলকে ঋদ্ধ করেছেন। ভারতীয় সাধারণতন্ত্রের আদর্শ তো এমন প্রশাসকদেরই মনের ফসল।
আমলার মন-এর সব কথা এই ছোট লেখায় ধরা কঠিন। তবু ভাবলাম এই দুই বটগাছের মতো প্রশাসকের ছায়া যদি একটু বেশি ছায়া দিতে পারত পশ্চিমবঙ্গকে, বা আমরা যদি তাঁদের আদর্শ আর একটু নিতে পারতাম, তা হলে হয়তো ডায়মন্ড হারবারের মহকুমা শাসককে বা অন্য কোনও আমলাকে একটা হাসপাতালের বেডে মৃত্যুশয্যায় অবহেলিত ভাবে চলে যেতে হত না। মানুষ তাঁদের মনে রাখতেন।