book review

Review: ফারপো’জ় থেকে গোটা সেদ্ধ

বইয়ের শেষে লেখক যে দীর্ঘ গ্রন্থপঞ্জি দিয়েছেন, তা থেকে সহজেই অনুমেয় যে, লেখার রসদ সংগ্রহ করতে তিনি পরিশ্রম করেছেন যথাসাধ্য।

Advertisement
সুমিত চক্রবর্তী
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৪ ডিসেম্বর ২০২১ ০৯:৪১
ঐতিহাসিক: কলেজ স্ট্রিট অঞ্চলের জনপ্রিয় ফেভারিট কেবিন

ঐতিহাসিক: কলেজ স্ট্রিট অঞ্চলের জনপ্রিয় ফেভারিট কেবিন

আ টেস্ট অব টাইম: আ ফুড হিস্ট্রি অব ক্যালকাটা
মোহনা কাঞ্জিলাল
৮৯৯.০০

স্পিকিং টাইগার

Advertisement

এই বইতে মোহনা কাঞ্জিলাল এক জটিল প্রকল্পের দায়িত্ব নিয়েছেন। এমন একটি প্রকল্পের বিন্যাস বিবিধ স্তরে ঘটা সম্ভব। এর এক দিকে যেমন রয়েছে খাদ্য, খাদ্যাভ্যাস অথবা পাকপ্রণালীর ইতিহাসের হদিস, তেমনই অপর দিকে রয়েছে একটা শহরের সামাজিক বা সাংস্কৃতিক চলাচলের হাল-হকিকত। আবার, সেই শহর যদি হয়ে থাকে উপনিবেশের বিস্তার আর সেই সংক্রান্ত বিস্তর ফিকিরের একটা স্থানিক এবং কালিক বিবর্তনের সাক্ষী, তবে এই কাজ হয়ে ওঠে বাস্তবিক অর্থেই বহুস্তরিক আর কঠিন। তবে, সমস্যার শেষ এখানেই নয়। কে হবেন এই বইয়ের পাঠক? উল্টেপাল্টে দেখলে মালুম হবে যে, এই বইতে মোহনা সামগ্রিক ভাবে সব স্তরের পড়ুয়া বা পাঠককেই ধরার চেষ্টা করেছেন। সাংস্কৃতিক ইতিহাসের গবেষক বা ইতিহাসের কৌতূহলী পাঠক বা খাবার ও রান্না নিয়ে ভাবনাচিন্তা করা মানুষ, পেটুক বা রাঁধুনি, উপনিবেশ বা নগরের ইতিহাস নিয়ে চর্চা করা তাত্ত্বিক— সকলকেই খানিক চিন্তার রসদ দেওয়ার চেষ্টা করেছেন লেখক। প্রায় পাঁচশো পাতার সন্দর্ভ— নানা দিকেই তাঁর যুক্তি আর ধারণার বিস্তার করতে চেয়েছেন মোহনা। বিষয় থেকে বিষয়ান্তরে গিয়েছেন, উদাহরণ পেশ করেছেন, তবে শেষাবধি এই সব রকমের পাঠককে নিয়ে চলতে পারলেন কি?

চারটি পর্বে বইটিকে ভাগ করেছেন লেখক। প্রথম ভাগে রয়েছে কলকাতার খানাপিনার সংস্কৃতিতে ইউরোপের প্রভাব। দ্বিতীয় ভাগে অন্যান্য সংস্কৃতির প্রভাব— যথা ইহুদি, নবাবি, পার্সি, বা চিনা। এর পর বাংলার রান্নাবান্না। আর, শেষ ভাগে লেখক আলোচনা করেছেন সমগ্র ভারত, এবং আলাদা করে উত্তর-পূর্বের রান্নার প্রভাব। বইয়ের শেষে আবার প্রত্যেক পর্ব থেকে মোহনা উদ্ধার করেছেন কিছু নির্দিষ্ট রান্না এবং তার পাকপ্রণালী বা রেসিপি। বিন্যাসের দিক থেকে ভেবে দেখলে এই বইয়ের বিস্তার এবং চর্চার নিরিখ এক ধরনের সামগ্রিক মানচিত্রের হদিস দিতে চেয়েছে পাঠককে, যা কিনা জন্মলগ্ন থেকে কলকাতার বিশিষ্টতা, তার কসমোপলিটান চরিত্রের পরিচায়ক। কলকাতার রসনা যে তার জন্মকাল থেকেই বিশ্বজনীন, এই যুক্তির প্রেক্ষিত রচনা করতে চেয়েছেন লেখক।

বইয়ের শেষে লেখক যে দীর্ঘ গ্রন্থপঞ্জি দিয়েছেন, তা থেকে সহজেই অনুমেয় যে, লেখার রসদ সংগ্রহ করতে তিনি পরিশ্রম করেছেন যথাসাধ্য। আর, সেই সব তথ্য বা মতামত সাজিয়ে দিয়েছেন বিভিন্ন অধ্যায়ে। তবে, আদতে লেখক এই বইয়ে ঠিক কী দাবি করতে চাইলেন, তাঁর গবেষণার প্রতিপাদ্য হিসাবে শহর কলকাতা বা তার খাদ্যের সংস্কৃতি বিষয়ে ঠিক কী আলোকপাত করতে চাইলেন, সেটা যে সব সময় খুব স্পষ্ট হল, তা বলা চলে না। দু’-একটা উদাহরণ দিলে ঠিক কী বলতে চাইছি তা বোঝা যাবে। ধরা যাক, প্রথম পর্বে কলকাতার চা ও কফি পানের সংস্কৃতি বিষয়ে উপনিবেশের সাহেবদের প্রভাব সম্বন্ধে আলোচনা করছেন লেখক। সেখানে চা ও কফির উৎপত্তি, চাষের পদ্ধতি, বিভিন্ন দেশে ব্যবহার বা চলাচল, ঐতিহ্য ইত্যাদি বিষয়ে দীর্ঘ আলোচনা রয়েছে। সে আলোচনা মনোগ্রাহী এবং তথ্যসমৃদ্ধ। তবে, এই বইয়ের প্রতিপাদ্য বিষয়ের সঙ্গে এই আলোচনার সম্পর্ক কী, সেটা খুব স্পষ্ট বোঝা গেল না। কোনও একটি শহরের খাদ্য-সংস্কৃতির ইতিহাস যে নিবিড় বিশ্লেষণের দাবি রাখে, এই অকারণ প্রসঙ্গান্তর যেন সেই উদ্দেশ্যকে খানিক ক্ষুণ্ণ করেছে বলেই মনে হয়। অপর দিকে, যে আলোচনা বিস্তারে করা প্রয়োজন ছিল, অনেক সময়ে তা ছোট একটি বাক্যে সেরে ফেলা হয়েছে। যেমন মোহনা লিখছেন, “বেঙ্গলিজ় অলসো হ্যাড দেয়ার ওন ভার্সন অব আফটারনুন টি, হুইচ ওয়াজ় নোন অ্যাজ় ‘জলখাবার’।” বরং ‘জলখাবার’ শব্দের উৎপত্তি, তার সাংস্কৃতিক এবং সামাজিক বিন্যাস নিয়ে আরও খানিক আলোচনা হলে এই বইয়ের বিষয়ের সঙ্গে মানানসই হতে পারত। একটিমাত্র বাক্যে ‘জলখাবার’ শব্দের সঙ্গে শহুরে বাঙালি জীবনের বহুমাত্রিক সম্পর্ক ধরা পড়ল না। এমন উদাহরণ রয়েছে আরও নানা জায়গায়।

কোনও জাতি অথবা শহরের সাংস্কৃতিক ইতিহাসের পরতে পরতে স্বাভাবিক নিয়মেই জড়িয়ে থাকে কিছু অপ্রামাণিক ঘটনা অথবা লোকমুখে চলতে থাকা গল্প। কালের নিয়মে গল্প আর সত্যের ফারাক করা দুষ্কর হয়ে পড়ে। তবু ইতিহাস লেখকের কাজ সেই ঘটনার বিবরণ দেওয়ার সময় ক্রমাগত এই অপ্রমাণের সূত্র নির্দেশ করা অথবা পাঠককে এই বিবরণের প্রেক্ষিত বুঝিয়ে দেওয়া। তা না হলে ইতিহাস আর পাড়ার আড্ডার তফাত থাকে না। বিখ্যাত ফেভারিট কেবিনের কথা লিখতে গিয়ে মোহনা সেখানকার বৈপ্লবিক আবহের দিকে পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। সেখানে চায়ের আসরে আসছেন লোকনাথ বল, গণেশ ঘোষ অথবা কল্পনা দত্ত। এমনকি, সুভাষচন্দ্র স্বয়ং প্রেসিডেন্সি থেকে চা খেতে চলে আসতেন নিয়মিত। মোহনা লেখেন: “জানালার পাশে একক চার নম্বর টেবলটির প্রতি এখনও সবাই সসম্ভ্রমে তাকান: এই টেবিলে বসেই তিনি এবং খ্যাতনামা কবি, কাজী নজরুল ইসলাম, চা খেতেন। তখন চায়ের দাম ছিল দু’পয়সা।” এমন ঘটনা অবাস্তব নয় মোটে, হয়তো বা ঘটেও থাকবে, তবু ইতিহাস লেখকের বুঝি দায় থাকে এমন নিশ্চিত দাবিকে খানিক তাত্ত্বিক দূরত্ব থেকে দেখার। এতে খাবার নিয়ে আলোচনার বৈঠকি মেজাজ ক্ষুণ্ণ হয় না কিছু।

কলকাতার খাদ্য-সংস্কৃতির প্রায় গোটাটাই লেখক তাঁর আলোচনায় ধরতে চেয়েছেন বলেই বোধ করি যা কিছু বাদ পড়ে গেল, তা আরও প্রকট হয়ে ধরা দেয়। তার জন্মলগ্ন থেকেই কলকাতা কসমোপলিটান একটা পরিসর। মজুর থেকে মেমসাহেব, বাবু থেকে বারাঙ্গনা, দালাল থেকে দানবীর— সকলেরই শহর কলকাতা। অতএব, খাদ্য-সংস্কৃতির আলোচনার সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে রয়েছে সামাজিক এবং অর্থনৈতিক শ্রেণির প্রশ্ন। এ আলোচনা একেবারেই এড়িয়ে গিয়েছেন মোহনা। সে কথা পাঠককে ধরিয়ে দিলে আপত্তি ছিল না। তবে, সাধারণ মধ্যবিত্ত থেকে অতি উচ্চবিত্ত, এই শ্রেণি পরিসরের বাইরে যে খাদ্য-ভোজ্যের আরও একটা জগৎ রয়ে গেল, সে কথা এই বইয়ের পাঠক টের পেলেন না। আর, কলকাতার রাস্তা জুড়ে যে বিখ্যাত ‘স্ট্রিট ফুড’, তারও তো একটা নিজস্ব, স্বকীয় সংস্কৃতি রয়েছে। সে আলোচনাও বাদ রয়ে গেল এক রকম। রাস্তার খাবারের পরিসরে যে মোহনার আলোচিত সব পর্বের খাবারের একটা আশ্চর্য মিশেল তৈরি হয়ে চলে ক্রমাগত, এই চমকপ্রদ আর গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাস থেকে এই বইয়ের পাঠক কিন্তু বঞ্চিত রইলেন।

আসলে এই বইয়ে মোহনা কাঞ্জিলাল যা করতে চেয়েছেন, সেই প্রকল্পের বিস্তার দুই মলাটে লিখে ফেলা মুশকিল। কয়েক খণ্ডে ধৈর্য ধরে লিখলে আমরা আরও সামগ্রিক একটা চিত্র পেতে পারতাম। নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছেন লেখক। ফারপো’জ় থেকে গোটা সেদ্ধ, সব মিলিয়ে দিব্য একটা গল্প বুনেছেন। তবু স্বাভাবিক নিয়মেই কিছু অতৃপ্তিও রয়ে গেল।

আরও পড়ুন
Advertisement