সংগ্রামী: কৃষক আন্দোলনে শামিল বৃদ্ধা।
সঙ্কট বিপুল, পরিসর সীমিত। সুতরাং শেষ থেকে শুরু করা যাক। বইটির উত্তরকথা-র একটি অনুচ্ছেদে পড়ি, “স্বৈরতন্ত্র ক’দিনের মধ্যে হঠাৎ আসেনি। অনেক বছর ধরে তার নির্মাণ চলছিল।... যে উন্নয়নের ইমারত নিয়ে আপনাদের এত গর্ব, লক্ষ লক্ষ আদিবাসী মানুষকে তাঁদের বাসভূমি থেকে উৎখাত করে তা তৈরি হয়েছিল। যে ধর্ম নিয়ে আপনারা গৌরবান্বিত, তা ক্রীতদাসের কারখানা চালিয়ে আসছে। এখন আপনাদের গায়ে আঁচ লাগছে বলে আপনারা ভাবছেন সব শেষ হয়ে গেল। আপনাদের নিরাপত্তা, আপনাদের বিশ্ববিদ্যালয়, আপনাদের বাক্স্বাধীনতা, এ সবই ছিল নিয়মের ব্যতিক্রম। কিন্তু স্বৈরতন্ত্রকে নিয়ে মুশকিল হল, ও জিনিস থামে না। সব কিছুর দখল নিতে চায়। সব কিছুকে টেনে নামাতে চায়। যখন অন্যরা মার খাচ্ছিলেন, আপনারা মনে করেছিলেন সেটা তুচ্ছ ব্যাপার। যখন মারটা আপনাদের ওপর এসেছে, আপনারা ভাবছেন সব শেষ হয়ে গেল।”
স্বৈরতন্ত্র কেমন করে সমাজের বুকের উপর চেপে বসে তার দম বন্ধ করে দেয়, দু’শো পৃষ্ঠার বইটিতে তার স্বরূপ উন্মোচন করেছেন জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে স্কুল অব আর্টস অ্যান্ড এসথেটিক্স-এর শিক্ষক। এই শ্বাসরোধকর আগ্রাসনের বিরুদ্ধে, তার চাপিয়ে দেওয়া ব্যারিকেডের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের রাজনীতি গড়ে তোলার লক্ষ্যেই লেখা হয়েছে এ বইয়ের আটটি অধ্যায়। অধ্যায় না বলে প্রবন্ধ বলাই হয়তো যুক্তিযুক্ত— লেখক নিজেও জানিয়েছেন, কোনও পূর্বনির্ধারিত কাঠামোয় তিনি বইটিকে বাঁধেননি।
বডি অন দ্য ব্যারিকেডস: লাইফ, আর্ট অ্যান্ড রেজ়িস্ট্যান্স ইন কনটেম্পোরারি ইন্ডিয়া
ব্রহ্ম প্রকাশ
৩২৫.০০
লেফ্টওয়ার্ড
শ্বাসরোধের রূপকল্পটি এ বইয়ের প্রাণকেন্দ্র। দু’টি ঘটনা সেই রূপকল্পের প্রেরণা হিসাবে কাজ করেছে। এক দিকে ২০২০-২১’এ কোভিড অতিমারির সময় দুনিয়া জুড়ে শারীরিক এবং সামাজিক শ্বাসরোধের অভিজ্ঞতা, অন্য দিকে ওই ২০২০’র ২৫ মে আমেরিকার মিনিয়াপলিস শহরের রাস্তায় ঘাড়ের উপর ৯ মিনিট ২৯ সেকেন্ড ধরে সাদা চামড়ার পুলিশ অফিসারের বলিষ্ঠ হাঁটুর চাপে ‘নিয়ন্ত্রিত’ (মহান গণতন্ত্রের পুলিশি ভাষায় ‘রেসট্রেনড’) আফ্রিকান-আমেরিকান নাগরিক জর্জ ফ্লয়েডের আর্তনাদ: “আই ক্যান্’ট ব্রিদ।”
দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে— এই অনুভূতিকে চেতনায় ধারণ করে আমাদের চার পাশে ঘনিয়ে আসা বিভিন্ন ‘আনফ্রিডম’ বা অ-স্বাধীনতার সম্বন্ধে সচেতন হওয়ার মানসিক অনুশীলন জরুরি। ব্রহ্ম প্রকাশের প্রথম প্রবন্ধটি তার এক পরিশ্রমী নজির। এই ধারণার সূত্র ধরেই দ্বিতীয় প্রবন্ধে তিনি দেখিয়েছেন, অতিনায়করা (এবং অতিনায়িকারাও) যে কেবল নিজের কথা বলেন, অন্যদের কথা শোনেন না, অন্যদের কথা বলতে দেন না, সেই বাক্রোধও শ্বাস রোধের অন্যতম প্রকরণ। হীরক রাজ্যের চরণদাস আজকের ভারতে বলতেন: কথা বন্ধ, তাই শ্বাসও বন্ধ। এই সূত্রটিই বিস্তৃত হয় পাঁচ নম্বর প্রবন্ধে, যেখানে ধরা আছে স্বাধীনচেতা বিবেকবান কবি সাহিত্যিক শিল্পীদের উপর ক্ষমতার দাপটের সাম্প্রতিক ইতিহাসের বেশ কিছু নজির। বইয়ের তৃতীয় প্রবন্ধে বিশেষ ভাবে লেখা হয়েছে এ দেশের সংখ্যালঘু মানুষের রুদ্ধ-জীবনের কথা, সেই আলোচনায় বাড়তি মূল্য যোগ করেছে লেখকের নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা। এই অধ্যায়টি পড়তে পড়তে আরও এক বার ভাবি, এই দেশে যদি জন্মসূত্রে সংখ্যালঘু হতাম! ভাবি, আর অমনি মনে হয়— দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। চার নম্বর প্রবন্ধের বিষয়: অতিমারির সময় পরিযায়ী শ্রমিকদের অভিজ্ঞতা। তার পিছনে ছিল ওই শ্রমিকদের শরীর এবং চলাচলকে বেঁধে ফেলার আধিপত্যবাদী প্রকল্প, ক্ষমতার ফরমান অগ্রাহ্য করে (আসলে বাঁচার তাগিদে, ঘরে ফেরার তাগিদে অগ্রাহ্য করতে বাধ্য হয়ে) ওই শ্রমিকদের ক্ষতবিক্ষত এবং মরণপণ পদযাত্রা যে প্রকল্পকে দেশ ও দুনিয়ার সামনে তুলে ধরেছিল এক নির্মম অপদার্থতার প্রতিমূর্তি রূপে। শেষ অধ্যায় আমাদের দেখায় কণ্ঠরোধের এক চরম রূপ— উত্তরপ্রদেশের হাথরসে (এবং দেশের অন্যত্রও) ক্ষমতার পীড়নে বিপর্যস্ত মানুষের কান্নার অধিকারও কেড়ে নেওয়ার কাহিনি।
স্বৈরতন্ত্রের বলিষ্ঠ হাঁটুর নীচে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করাই কি তবে ভবিতব্য? নিয়তি? না। প্রতিরোধ আছে, আছে প্রতিস্পর্ধা। ষষ্ঠ এবং সপ্তম প্রবন্ধে তার ইতিবৃত্ত পেশ করেছেন লেখক। তার মধ্যে আছে কৃষক আন্দোলনের সামনে আধিপত্যবাদী রাষ্ট্রের পশ্চাদপসরণের বৃত্তান্ত, গুজরাতের উনায় দলিত নিপীড়নের প্রতিবাদে দীর্ঘ এবং রাজ্যব্যাপী প্রতিবাদী আন্দোলনের বৃত্তান্ত, বিভিন্ন আন্দোলনে শিল্পকলা, কবিতা, নাটক, গানের মর্মস্পর্শী ব্যবহারের বৃত্তান্ত। উপায় একটাই: বহু কাল ধরেই যাঁদের শ্বাসরোধ হয়ে আসছে, সেই সংখ্যাগরিষ্ঠ মার-খাওয়া মানুষের পাশে গিয়ে দাঁড়ানো, এবং একযোগে ঘুরে দাঁড়ানো। পড়ে নেওয়া যাক এই বইয়ের শেষ কয়েকটি কথা: “ব্যারিকেডে আবার আমাদের দেখা হবে, দেখা হবে জীবনের কথায়, স্বাধীনতার কথায়। কথায় আছে, ব্যারিকেড রাস্তা বন্ধ করে, কিন্তু পথ খুলে দেয়।”