শহরের দর্পণে দেখি ভারতের মুখ

কত-না গল্প কৃষ্ণচন্দ্রের সময়কে ঘিরে, তার কতটা সত্যি? জগদ্ধাত্রী পুজোর প্রচলন কি তিনিই করেন?

Advertisement
শেষ আপডেট: ৩১ অগস্ট ২০১৯ ১৩:০৪

এ বারের ‘পরিচয়’ পত্রিকায় (সম্পা: অভ্র ঘোষ) মুখ্য আলোচ্য সুভাষ মুখোপাধ্যায়। গত ফেব্রুয়ারিতে তাঁর জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে যে অনুষ্ঠান উদ্‌যাপিত হয়েছিল গোর্কি সদনে, তাতে যাঁরা বক্তা ছিলেন তাঁদের কয়েক জনের লিখিত বক্তৃতার পরিমার্জিত-পরিবর্ধিত রূপ প্রকাশ করা হয়েছে এ-সংখ্যায়, জানিয়েছেন সম্পাদক। হিমানী বন্দ্যোপাধ্যায় অপর্ণা সেন রুশতী সেন সাধন চট্টোপাধ্যায় দীপাঞ্জন রায়চৌধুরী ইরাবান বসুরায় অমিতাভ গুপ্ত একরাম আলি প্রণব বিশ্বাস প্রমুখ আছেন ওই লেখক-তালিকায়। আছে কয়েকটি পুনর্মুদ্রণও— কবির চিঠিপত্র সাক্ষাৎকার ও ভাষণের সমাহার। তেমনই একটি ভাষণে তিনি বলেছিলেন ‘‘দেশের বাড়ি খোয়ালেও আমি সে জায়গায় পেয়েছি বিশাল এক দেশ। যার ভূতভবিষ্যৎ সবটাই আমার। আসমুদ্রহিমাচল আমার কাছে অবারিত দ্বার। জাতে বাঙালি হয়েও আমি দ্বিজাতিতে ভারতীয়। আমরা নিজের ভাষার ঘর-সংসার করি, হিন্দির ফেরিনৌকোয় হাটে যাই, তীর্থ করে ফিরি। আমাদের এই শহরের দর্পণে আমি দেখি সারা ভারতের মুখ। এখানকার শানবাঁধানো পাথরে মাথা কুটে যারা বংশপরম্পরায় কলকাতাকে বড় করেছে, আজ বস্তা বস্তা টাকা তাদের মাথা-গোঁজার জায়গা, পার্ক, ময়দান, জলাভূমি সর্বস্ব হাতিয়ে নিচ্ছে।... আসুন আমরা একবাক্যে হাতে হাত বেঁধে এর গতি রোধ করি।’’ আজও যে তিনি ভীষণ ভাবেই প্রাসঙ্গিক, ভাষণের এই অংশটুকুই তার জন্যে যথেষ্ট।

ঢাকা থেকে প্রকাশিত জীবনানন্দ-চর্চার পত্রিকা ‘জীবনানন্দ’-র (সম্পা: মাসউদ আহমাদ) দ্বিতীয় সংখ্যার সম্পাদকীয়-তে পত্রিকাটি সম্পর্কে জানানো হয়েছে: ‘‘আমরা চেয়েছি জীবনানন্দ-চর্চার একটি স্বতন্ত্র পত্রিকা প্রকাশের; এমন একটি পত্রিকা, যেখানে জীবনানন্দ-সম্পর্কিত সমস্তরকম লেখাপত্র-কবিতা-গল্প-ভাবনা-স্কেচ-তথ্য-সংবাদ-গবেষণা-সমালোচনা ইত্যাদি প্রকাশিত হবে।’’ অতএব বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ, দু’পারের নানা ধরনের রচনাদিতেই ভরে উঠেছে পত্রিকাটি। জীবনানন্দের কবিতা নিয়ে যেমন লিখেছেন মুহম্মদ মুহসিন, শামীম রেজা, সৈয়দ তৌফিক জুহরী, মিরাজুল আলম; তেমনই আবার সুবোধ সরকার প্রশ্ন তুলেছেন: ‘‘দুটো দেশ এবং উপমহাদেশের এতটা বিস্তীর্ণ অঞ্চলজুড়ে জীবনানন্দ দাশের এত খ্যাতি, এত সুনাম; অথচ তাঁকে নিয়ে কেন আজ পর্যন্ত একমাত্র ক্লিনটন বি সিলি ছাড়া আর কেউ এগিয়ে এলো না।’’ জয় গোস্বামী জানিয়েছেন, জীবনানন্দকে উৎসর্গ-করা তাঁর ‘শ্রীচরণকমলেষু’ কবিতাগুচ্ছ সৃজনের নেপথ্যকথা। হুমায়ুন কবিরকে লেখা একটি গুরুত্বপূর্ণ চিঠিতে জীবনানন্দ লিখেছেন ‘‘আমি বিশিষ্ট বাঙালিদের মধ্যে পড়ি না, আমার বিশ্বাস জীবিত মহত্তর বাঙালিদের প্রশ্রয় পাওয়ার মতনও কেউ নই আমি। কিন্তু আমি সেই মানুষ, যে প্রচুর প্রতিকূলতা সত্ত্বেও প্রতিটি দ্রব্যকে সোনা বানিয়ে তুলতে চায়... ভবিষ্যতে খাঁটি মূল্যের যথার্থ ও উপযুক্ত বিচার হবে; আমার ভয় হয়, সেই ভালো দিন দেখতে আমি বেঁচে থাকব না।’’ এই আশঙ্কা যে নিজের জীবনে অমোঘ সত্যি হয়ে উঠবে তা কি আর জানতেন কবি!

Advertisement

‘নাট্যচিন্তা’-র (সম্পা: রথীন চক্রবর্তী) সাম্প্রতিক সংখ্যায় ‘কোম্পানি থিয়েটার বিতর্ক’। ‘সময়ের দাবিতে এই চ্যালেঞ্জ’ যে নিতেই হচ্ছে— ‘কোম্পানি থিয়েটার’ প্রসঙ্গে বলেছেন ব্রাত্য বসু, তাঁর সঙ্গে তীর্থঙ্কর চন্দ, চন্দন সেন, কৌশিক চট্টোপাধ্যায়, অংশুমান ভৌমিক প্রমুখের রচনা রীতিমতো জমিয়ে দিয়েছে তর্ক। আদতে এটি ‘বিপজ্জনক লাইন থেকে বিপজ্জনক প্রস্তাবনা’, এ-বাক্যের সঙ্গে অবশ্য সম্পাদকীয়-তে জানানো হয়েছে: ‘‘গোটা বিতর্ককে একটা ফাইলে বন্দি করা যাক। তাহলে ভবিষ্যতে ইতিহাসটা পাওয়া যাবে...’’।

‘‘নদীয়ার রাজবংশের বর্তমান প্রধান শ্রী সৌমীশচন্দ্র রায় এবং তাঁর স্ত্রী শ্রীমতী অমৃতা রায়ও মনে করেন, [গোপাল ভাঁড়কে নিয়ে] গবেষণার প্রয়োজন আছে। গোপাল ভাঁড় যে মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের পঞ্চরত্নের একজন ছিলেন, তা অস্বীকার না করেই শ্রী সৌমীশ রায়ের বক্তব্য, গবেষণার সুযোগ রয়েছে মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রকে নিয়েও। কারণ সঠিক গবেষণার অভাবে মহারাজা সম্বন্ধেও অনেক অবিশ্বাস্য ইতিহাস লেখা হয়েছে।’’ ‘গোপাল ভাঁড়— ইতিহাস নাকি কল্পনা?’ নিবন্ধে লিখছেন সুজিত রায়। মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের (১৭১০ -১৭৮২) রাজত্বকাল বাংলার ইতিহাসে এক বিরাট পালাবদলের সময়। পলাশির যুদ্ধ, নবাবি আমলের অবসান ও ইংরেজ রাজত্বের প্রতিষ্ঠার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গি জড়িয়ে আছে বাংলার সমাজ-সংস্কৃতির আমূল পরিবর্তন। আর সেই পরিবর্তনে নদিয়া রাজপরিবার তথা মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের ভূমিকা ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এক দিকে কৃষ্ণনগর রাজসভার জাঁকজমক— বহিরঙ্গে অনেকটাই উত্তর ভারতের মুঘল ও রাজপুতদের থেকে নেওয়া, কিন্তু ভিতরের রূপটি পুরোপুরি বাঙালি, এবং এক ধরনের গ্রামীণ সংস্কৃতির। কৃষ্ণচন্দ্রের সভাসদ ছিলেন রায়গুণাকর ভারতচন্দ্র, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় তাঁর ‘অন্নদামঙ্গল’ কাব্যের উপর ভিত্তি করে সেই সময়ের চিত্রটি পুনর্গঠন করার চেষ্টা করেছেন। ১৯৪৮ সালের এই নিবন্ধটি কৌশিক গুহর অনুবাদে নতুন করে পাওয়া গেল ‘মুদ্রা’ পত্রিকার ‘মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র ও সমকাল’ সংখ্যায় (সম্পা: শৈবাল সরকার)। কত-না গল্প কৃষ্ণচন্দ্রের সময়কে ঘিরে, তার কতটা সত্যি? জগদ্ধাত্রী পুজোর প্রচলন কি তিনিই করেন? পলাশির ষড়যন্ত্রে তাঁর ভূমিকা ঠিক কতটা? মুর্শিদাবাদের নবাব-নাজিম, রানি ভবানী ও রাজা রাজবল্লভের সঙ্গে কৃষ্ণচন্দ্রের সম্পর্ক, ভারতচন্দ্র ও রামপ্রসাদের সাহিত্যকীর্তি, নবদ্বীপে শক্তিপুজোয় কৃষ্ণচন্দ্রের ভূমিকা, অগ্রদ্বীপের গোপীনাথ-বিতর্ক এই সব প্রসঙ্গের পাশাপাশি এই সঙ্কলনে উঠে এসেছে গোপাল ভাঁড়ের কথা, তখনকার বাঙালির বেশবাস, রাজসভার গানবাজনা, খাওয়াদাওয়া, কৃষ্ণচন্দ্রের মন্দির নির্মাণ, বাংলা ভাষা ও কৃষ্ণচন্দ্র, বাংলা পঞ্জিকা ও কৃষ্ণচন্দ্র, দুর্গাপুজো, সমকালীন লোকধর্ম এমন কত প্রসঙ্গ। বিশেষ করে নদীপথের কেমন পরিবর্তন ঘটানো হয় নদিয়ারাজদের সময়, নিম্নবর্গের সংস্কৃতি ইত্যাদি লেখা কৌতূহল জাগায়।

আরও পড়ুন
Advertisement