যেখানে জীবন ও প্রকৃতির বিপন্ন প্রতিচ্ছবি

সম্প্রতি আকৃতি গ্যালারিতে সুদীপ রায়ের একক প্রদর্শনী দেখলেন মৃণাল ঘোষ সুদীপ রায়ের ক্যানভাসের উপর তেলরঙে আঁকা বিমূর্ত ছবি নিয়ে প্রদর্শনী চলছে আকৃতি আর্ট গ্যালারিতে। প্রদর্শনীর শিরোনাম ‘অডিসি’। তাঁর এই ‘অভিযাত্রা’ রূপের শুদ্ধতার দিকে। আমাদের চারপাশে ছড়িয়ে আছে বস্তুপুঞ্জ। ছড়িয়ে আছে জীবন এবং প্রকৃতি। আপাত ভাবে তা অগোছালো, এলোমেলো।

Advertisement
চিত্রকলা ও ভাস্কর্য ১
শেষ আপডেট: ১৯ মার্চ ২০১৬ ০০:০০

সুদীপ রায়ের ক্যানভাসের উপর তেলরঙে আঁকা বিমূর্ত ছবি নিয়ে প্রদর্শনী চলছে আকৃতি আর্ট গ্যালারিতে। প্রদর্শনীর শিরোনাম ‘অডিসি’। তাঁর এই ‘অভিযাত্রা’ রূপের শুদ্ধতার দিকে। আমাদের চারপাশে ছড়িয়ে আছে বস্তুপুঞ্জ। ছড়িয়ে আছে জীবন এবং প্রকৃতি। আপাত ভাবে তা অগোছালো, এলোমেলো। নানা সংঘাতে অন্তর্দ্বন্দ্বে বিপন্ন, বিকৃত। হয়তো প্রকৃতির ভিতর এবং জীবনের ভিতর সন্তর্পনে কাজ করে যায় সংস্থিতির দিকে মগ্ন এক গতিপ্রবাহ। কিন্তু কোনও দিন জীবন ও প্রকৃতি সেই পরিপূর্ণ সংস্থিতিকে ছুঁতে পারবে কি না, এটাই এক চিরন্তন সংশয়। একজন শিল্পী তাঁর শিল্পের ভিতর দিয়ে প্রতিনিয়ত সেই শুদ্ধতাকে ছুঁতে চান। ভাঙনের, বিপন্নতার দিকচিহ্নগুলোকে চিনিয়ে দিতে থাকেন। এটাই একজন শিল্পীর দায়। জীবনের দিকে তাঁর ‘অভিযাত্রা’। এই অভিযাত্রা-র পথে অনেক শিল্পী ক্রমান্বয়ে অবয়ব থেকে নিরবয়বের দিকে এসেছেন। মূর্ততাকে বিমূর্তের দিকে নিয়ে গেছেন। রূপকে পৌঁছে দিতে চেয়েছেন সাঙ্গীতিক শুদ্ধতায়। ১৯১০ সালে জার্মানিতে ক্যানদিনস্কি যে কাজ শুরু করেছিলেন পরবর্তী শতাধিক বছরে বিশ্ব জুড়ে আধুনিকতাবাদী চিত্রধারায় তা নানা শাখা-প্রশাখায় পল্লবিত হয়েছে।

সুদীপ তাঁর শৈল্পিক অভিযাত্রাকে এই শুদ্ধতার সন্ধানে চালিত করেছেন বেশ কয়েক দশক আগে থেকে। ১৯৮০-র দশকে তাঁর শিল্পযাত্রার সূচনা হয়েছিল অবয়বী ছবির চর্চার মধ্য দিয়ে। জলরঙের একজন সুদক্ষ শিল্পী ছিলেন তিনি। নিসর্গের ছবির ভিতর দিয়ে প্রকৃতির তন্ময়তার কেন্দ্রটির সন্ধান করতেন। জ্যামিতিক কোলাজের শৈলী নিয়েও নানা রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন। তার পর ধীরে ধীরে বিষয়ের বহিরবয়বকে দ্রবীভূত করতে করতে নিরবয়বে পৌঁছেছেন।

Advertisement

আশির দশকেরই অন্তপর্বে যে প্রকল্পের সূচনা, তা আজ বহু ধারায় পল্লবিত হয়েছে। ১৯৯০-এর দশকের শেষ পর্ব থেকে তিনি দিল্লিতে স্থায়ী ভাবে বসবাস করছেন। দিল্লিকে ভিত্তি করে সারা দেশেই এখন তাঁর শিল্পের বিস্তার।

তাঁর বিমূর্ততায় দুটি মাত্রাকে তিনি বিশেষ ভাবে সক্রিয় রাখতে চান। একটি সঙ্গীত। দ্বিতীয়টি সময়। সঙ্গীতের একজন নিমগ্ন শ্রোতা তিনি। ছবিতে সেই সাঙ্গীতিক শুদ্ধতা তাঁর অন্বিষ্ট। পরোক্ষ ভাবে সময়কেও তিনি ধারণ করতে চান ছবির মধ্যে। তাঁর প্রতিটি ছবিরই শিরোনামের ভিতর একটি নির্দিষ্ট সময় চিহ্নিত হয়ে আছে। তিনি যে সময়ে ছবি আঁকেন, সেই নির্দিষ্ট সময়টিকেই শিরোনাম হিসেবে চিহ্নিত করে রাখেন। কিন্ত সময়ের যে আলোড়ন, যে আলোড়ন জীবনের মধ্যে, সমাজের মধ্যে সঞ্চালিত হয়ে যায়, তার কোনও স্পন্দন কি ধরা পড়ে তাঁর ছবিতে?

জানা যায় তিনি রূপের শুদ্ধতার সন্ধানী। কিন্তু তাঁর ছবি এই প্রত্যয়কে সমর্থন করে না।

শিল্পী: সুদীপ রায়।

তাঁর বিমূর্ততার ধরনকে বলা যেতে পারে অভিব্যক্তিবাদী। তাঁর চেতনার উত্তাল আবেগকে তিনি ছবিতে ধরতে চান। কখনও কখনও সেই আবেগ সংবৃত হয়ে আসে। বর্ণের গতিপ্রবাহ প্রশান্তিতে বিস্তৃত হতে থাকে। কিন্তু সেই প্রশান্তি নিস্তরঙ্গ নয়। সেই মন্ময়তার ভিতরও বহির্জগতের আলোড়ন কিছু তরঙ্গ তুলে যায়।

বিকেল ৫টা ৫০ মিনিট শিরোনামের ১৫৩ সেমি-বর্গ আকারের ছবিটিতে দেখি হাওয়ায় আলোড়িত কিছু বস্ত্রপুঞ্জ স্তব্ধ হয়ে গিয়ে ত্রিমাত্রিক এক উত্তুঙ্গতা তৈরি করেছে। চিত্রক্ষেত্রের উপরের দিকে ত্রিকোণাকৃতি একটি তমসাময় পরিসর তৈরি হয়েছে। রাত্রি-প্রতিম এই আঁধারের সঙ্গে আলোকিত ও আলোড়িত পরিসরের যে সংঘাত, তার ভিতর জীবনের অন্তর্লীন দ্বন্দ্বের আলোড়ন তো থাকেই। সময়ের দায়কে শিল্পী হয়তো এ ভাবেই আত্মস্থ করে নেন।

সকাল ৮-টা শিরোনামের ক্যানভাসটিতে যেন মনে হয় বিধ্বস্ত একজন মানুষ ভূমিতলে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। সময়ের আলোড়নকে এ ভাবেই শনাক্ত করা যায় তাঁর ছবিতে।

‘রাত ২-টো’ শিরোনামের ছবিতে যে ভাবে জলের সঞ্চরণের মতো নীল ও হলুদের বিভিন্ন প্রচ্ছায়া ছন্দিত হয়ে ছড়িয়ে পড়ে তাতে প্রশান্তির এক আবহ তৈরি হয়। সেই প্রশান্তিও অবশ্য সম্পূর্ণ নির্দ্বন্দ্ব নয়।

সুদীপের ছবিতে শেষোক্ত বিপ্রতীপের এক পরোক্ষ সংশেষের কিছু আভাস থাকে, বর্তমান সময়ের প্রবহমানতায় যাকে তিনি নতুনভাবে আত্মস্থ করে নিতে চান।

আরও পড়ুন
Advertisement