Pranab Mukherjee

এই প্রথম খোলামেলা প্রণববাবু

প্রণব মুখোপাধ্যায় অকপট, ঘটনার পিছনের ঘটনাকে বিধৃত করতে অকুণ্ঠ, শুকনো ইতিহাসের পরতে পরতে বুনে দিচ্ছেন নিজের কৌণিক দৃষ্টিভঙ্গি, মন্তব্য এবং পর্যবেক্ষণ। হ্যাঁ, সে পর্যবেক্ষণ যদি তিক্তও হয়, তবুও।

Advertisement
অগ্নি রায়
শেষ আপডেট: ২৩ জানুয়ারি ২০২১ ০৩:১৮
স্মৃতি: রাষ্ট্রপতি ভবনের মোগল গার্ডেনে প্রণব মুখোপাধ্যায়। ১৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৫। প্রেম সিংহ।

স্মৃতি: রাষ্ট্রপতি ভবনের মোগল গার্ডেনে প্রণব মুখোপাধ্যায়। ১৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৫। প্রেম সিংহ।

দ্য প্রেসিডেনশিয়াল ইয়ার্স: ২০১২-২০১৭

প্রণব মুখোপাধ্যায়

Advertisement

৬৯৫.০০

রূপা পাবলিকেশনস

মন্ত্রগুপ্তি ছিল তাঁর অন্যতম প্রহরণ। রাজধানীর প্রশাসনিক মহাযজ্ঞ, রাজনীতির পালাবদল, শাহি ষড়যন্ত্র, ক্ষমতার নাগরদোলা— প্রায় অর্ধশতাব্দী এই সমস্ত কিছু ভিতর থেকে দেখেও, তাঁর মুখ থেকে পাইপের ধোঁয়া ব্যতীত বিতর্কের জন্মদাত্রী কোনও বাক্য উচ্চারিত হতে শোনা গিয়েছে কদাচিৎ। আর লেখার ক্ষেত্রে প্রণব মুখোপাধ্যায় আরও সতর্ক। হিমশীতল পরিসংখ্যান এবং বিশুদ্ধ তথ্য তাঁর কাছে ঈশ্বর।

আলোচ্য গ্রন্থটি তিনি যখন লিখছেন, তখন রাজনীতির সেই ঘনঘোর উথালপাথাল দিন-রাত (রাষ্ট্রপতি হওয়ার ঠিক পরে বলেছিলেন, তিনি সেই উত্তেজনা মিস করছেন) তাঁর কাছে পূর্বাশ্রমের মতো। তাই বোধ হয়, তাঁর এই শেষ বইটিতে যে ভাবে পাখির চোখে তিনি দেখে ও দেখিয়ে গেলেন ভারতের গণতন্ত্র, সংবিধান, বিদেশনীতি, বিচার ব্যবস্থা, সংসদের ভূত ও ভবিষ্যৎ— তা যেন তাঁর নিজেরই যত্নলালিত অভ্যাস ও চর্যাকে ছাপিয়ে এক অন্য প্রণব মুখোপাধ্যায়ের মলাট খুলে ধরল। যে প্রণব মুখোপাধ্যায় অকপট, ঘটনার পিছনের ঘটনাকে বিধৃত করতে অকুণ্ঠ, শুকনো ইতিহাসের পরতে পরতে বুনে দিচ্ছেন নিজের কৌণিক দৃষ্টিভঙ্গি, মন্তব্য এবং পর্যবেক্ষণ। হ্যাঁ, সে পর্যবেক্ষণ যদি তিক্তও হয়, তবুও।

এই বইটির থেকে বড় প্রাপ্তির দিক এটিও। এর আগে যে আত্মজৈবনিক সময়মন্থন করেছেন তিনি তিনটি পর্বে (দ্য ড্রামাটিক ডিকেড: দ্য ইন্দিরা গাঁধী ইয়ার্স, দ্য টারবুলেন্ট ইয়ার্স, দ্য কোয়ালিশন ইয়ার্স), তার চতুর্থ এবং শেষ এই পর্বটি তাই অনেক বেশি আকর্ষণীয় এবং বর্ণময়। এই বইয়ের পাতায় পাতায় লেখকের শ্বাসধ্বনি শোনা যায়।

মুখবন্ধ আর উপসংহার বাদে মোট ১১টি ভাগে বিন্যস্ত তাঁর রাইসিনা হিলের কালখণ্ডটি। কিন্তু শুধুই কি সেই সময়টুকু? আসলে, এই সময়যানের মধ্য দিয়ে তিনি অনায়াস ভ্রমণ করেছেন স্বাধীনতা-পরবর্তী (কখনও তার আগেরও) ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসপথ। যেখানে এক দিকে রয়েছে বিভিন্ন রাষ্ট্রনেতার সঙ্গে তাঁর বিনিময়, সংবিধানের ৩৫৬ ধারা ও কেন্দ্র-রাজ্য কাঠামো, সংসদীয় গণতন্ত্রে বিরোধিতার স্বরের প্রসঙ্গ; অন্য দিকে আছে হালফিলের জিএসটি, নোট বাতিলের অধ্যায়, রাষ্ট্রপতির বক্তৃতার প্রকরণ, প্রাণভিক্ষার আর্জির মতো তাঁর শেষ কর্মজীবনের অনুপুঙ্খ বিবরণ। অনেক ক্ষেত্রেই তাঁর প্রিয় নৈর্ব্যক্তিক, পক্ষপাতহীন, ইতিহাস রচয়িতার কলমটিকে সচেতন ভাবে পরিহার করেছেন। বরং বিভিন্ন রঙের কালিতে তথ্য, ঘটনাপরম্পরা ও ইভেন্ট-কে সাজিয়েছেন নিজের দৃষ্টিকোণে। অবশ্যই তথ্যের শুদ্ধতাকে একশো শতাংশ রক্ষা করেই। একেবারে শেষে, অর্থাৎ একাদশ পর্বে লিখেছেন আক্ষরিক অর্থেই একটি দুর্লভ অধ্যায়। যে প্রধানমন্ত্রীদের নিয়ে কাজ করেছেন, তাঁদের মূল্যায়ন আছে সেখানে। তুলনামূলক বিশ্লেষণে না গিয়ে ইন্দিরা গাঁধী, মনমোহন সিংহ, নরেন্দ্র মোদীদের যে ভাবে দেখেছেন, পাশাপাশি সাজিয়ে দেওয়া হয়েছে। বাকিটা পাঠকের উপর।

উৎসর্গ পত্রেই এক রূপকথাসুলভ যাত্রার ইঙ্গিত তাঁর ভাবী পাঠককে দিয়ে দেন প্রণববাবু, সিটবেল্ট বেঁধে নিতে বলেন যেন! উৎসর্গ করা হয়েছে— “ভারতের গণতন্ত্রকে, যার কারণেই বাংলার এক প্রত্যন্ত গ্রামের নিভু নিভু লণ্ঠনের আলো থেকে রাষ্ট্রপতি ভবনের ঝাড়বাতি পর্যন্ত এই সফর সম্ভব হল।”

এই সফর যেমন প্রবাদপ্রতিম এক রাজনীতিকের, তেমনই এক ব্যক্তিমানুষেরও— সেই ইঙ্গিতটুকুই কি প্রচ্ছন্ন রইল না এই উৎসর্গ পত্রে? সম্ভবত এই প্রথম ছাপার অক্ষরে নিঃসঙ্কোচে তিনি লিখলেন, রাষ্ট্রপতির শপথবাক্য উচ্চারণ করার সময় তাঁর ‘পেট গুড়গুড় করছিল’! লিখলেন, রাষ্ট্রপতি ভবনের গবাক্ষে দাঁড়িয়ে বাইরের নয়নাভিরাম মোগল গার্ডেনের দিকে তাকিয়ে তৈরি হওয়া ব্যক্তিসত্তার টানাপড়েন এবং দ্বিধাকে। এ যেন নিজের সঙ্গে নিজের সংলাপ; যখন লিখছেন, “দীর্ঘ দিন সক্রিয় রাজনীতিতে থাকার সুবাদে শুধুমাত্র আমার দলই নয়, বিরোধী দলনেতাদের কাছ থেকেও অভূতপূর্ব সম্মান পেয়েছি। কিন্তু সেই সব দিন এখন পুরোপুরি ভাবে আমার পিছনে। যদিও কংগ্রেসের আদর্শকেই সবচেয়ে ভাল করে অধ্যয়ন ও আত্মস্থ করে এসেছি— কিন্তু আমি এখন অরাজনৈতিক ব্যক্তি। দেশের রাষ্ট্রপতি।… এটাও আমার মাথায় এল যে, আমি বোধ হয় একটু আগেই রাজনীতিকে চিরবিদায় জানিয়ে দিলাম।… এটাও মনে হল যে আরও কয়েক বছর প্রত্যক্ষ রাজনীতিকে হয়তো আমি দিতে পারতাম। কিন্তু এই সব চিন্তা দ্রুতই মাথা থেকে বের করে দিলাম। কারণ, এখন অর্থহীন এই সব চিন্তার জাল।”

তাঁর নিজের কথাতেই, বহু ঝঞ্ঝাটপূর্ণ পরিস্থিতি তিনি রাষ্ট্রপতি ভবনে বসে দেখেছেন, সামলেছেন এবং সেগুলিকেই লিখেছেন এই বইয়ে। কিন্তু সেটা ‘রাজনীতি থেকে দূরে দাঁড়িয়ে’।
হয়তো রাজনৈতিক পক্ষপাত থেকেও দূরে দাঁড়িয়ে। কিন্তু আদৌ রাজনৈতিক মননকে দূরে রেখে নয়। নিজের দীর্ঘ পরিক্রমা শেষে, একই সঙ্গে সনিয়া গাঁধী এবং নরেন্দ্র মোদী— দুই শিবিরের শীর্ষ নেতার ভুলগুলি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়ারও একটা দায় থেকে গিয়েছিল যেন তাঁর। ২০১৪ সালের নির্বাচনকে ফিরে দেখতে গিয়ে যিনি জানাচ্ছেন, তিনি সরকারে থাকলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে কোনও মূল্যেই ছেড়ে যেতে দিতেন না। তাঁর মতে, সনিয়া গাঁধীর ভুল সিদ্ধান্তে মহারাষ্ট্র হাতছাড়া হয়েছিল। কখনও যে দাবি প্রকাশ্যে করতে শোনা যায়নি, এমনকি ঘরোয়া আড্ডাতেও নয়, সে কথা নির্দ্বিধায় বলছেন তাঁর শেষ গ্রন্থে। “আমি দৃঢ় ভাবে বিশ্বাস করি, যদি প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে থাকতাম, তা হলে ২০১৪ সালের লোকসভা ভোটে কংগ্রেসের ওই দশা হতে দিতাম না।”

আবার, এই একই বইতে মোদীর বিদেশনীতির সমালোচনা করে প্রণববাবু লিখছেন, “প্রধানমন্ত্রী বিদেশি রাষ্ট্রনেতাদের সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্ক নিয়ে বড় বেশি প্রচার করেন। এই সব সম্পর্ককে সত্য হিসেবে ভেবে নেওয়াটা অবাস্তব।” দফায় দফায় বিদেশমন্ত্রকের দায়িত্ব সামলানো প্রণববাবুর মতো কেই বা জানেন, ‘অন্য দেশের সঙ্গে সম্পর্কে জাতীয় স্বার্থকে সামনে নিয়ে আসতে ব্যক্তিগত বন্ধুত্বের কোনও স্থান নেই। দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক রচিত হয় হিমশীতল কাঠখোট্টা বাস্তব তথ্যের উপর।’

সার্জিক্যাল স্ট্রাইক নিয়ে সরকারের ‘বুক চাপড়ানো’-ও যে তিনি পছন্দ করেননি, এ কথাও স্পষ্ট ভাবে লিখে রেখে গিয়েছেন প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি। তাঁর কথায়, “ওই বহুচর্চিত স্ট্রাইকটি আসলে পাকিস্তানের ধারাবাহিক হিংসার বিরুদ্ধে স্বাভাবিক এক সামরিক অভিযান। সেটিকে নিয়ে অতিরিক্ত প্রচারের কোনও প্রয়োজনই ছিল না। এই অভিযান নিয়ে এত কথা বলে আমাদের কোনও লাভই হয়নি।” আবার ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ় শরিফের জন্মদিনে শুভেচ্ছা জানাতে লাহৌরে মোদীর পৌঁছে যাওয়ার সিদ্ধান্ত সম্পর্কে তাঁর তির্যক মন্তব্য, ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিতে ওই সিদ্ধান্ত ‘অপ্রয়োজনীয়’ এবং ‘অবাঞ্ছিত’। সংসদ চালানোর ক্ষেত্রেও প্রথম পর্বে সরকারের ব্যর্থতার কথা উল্লেখ করে প্রণববাবু নরেন্দ্র মোদীর প্রশাসনকে সরাসরি ‘একনায়কতন্ত্রী’ বলেই উল্লেখ করেছেন।

জীবনের সূর্যাস্তের কাছে পৌঁছতে পৌঁছতে লেখা এই গ্রন্থটি অর্গলহীন এক প্রণব মুখোপাধ্যায়কেই স্থাপিত করে দিয়ে গেল। শুধু সমসময়ের নয়, আগামী প্রজন্মের অনুসন্ধিৎসু পাঠকের জন্যেও।

আরও পড়ুন
Advertisement