চিত্রকলা ও ভাস্কর্য ১

সঙ্গীত ও চিত্র-ভাষায় উৎসারিত যে চেতনা

এক্সপেরিমেন্টার গ্যালারিতে অনুষ্ঠিত স্যামসন ইয়ং-এর প্রদর্শনীটি দেখে এলেন মৃণাল ঘোষ সঙ্গীতের কাজ ছন্দোময় ধ্বনির সৃজন। সেই ধ্বনির উদ্ভাসে বাস্তবের আবরণকে দ্রবীভূত করে অলৌকিকের আবহ সৃষ্টি করা। চিত্রকলার পরিধি হয়তো তত বিস্তৃত নয়। কেননা একটি নির্দিষ্ট মুহূর্তেই তো আবদ্ধ তার পরিসীমা। সেই মুহূর্তকে মুহূর্তাতীত বা অনন্তের দিকে মেলে ধরাই চিত্রের একটি চিরন্তন প্রকল্প।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৭ ডিসেম্বর ২০১৬ ০০:০০
শিল্পী : স্যামসন ইয়ং

শিল্পী : স্যামসন ইয়ং

সঙ্গীতের কাজ ছন্দোময় ধ্বনির সৃজন। সেই ধ্বনির উদ্ভাসে বাস্তবের আবরণকে দ্রবীভূত করে অলৌকিকের আবহ সৃষ্টি করা। চিত্রকলার পরিধি হয়তো তত বিস্তৃত নয়। কেননা একটি নির্দিষ্ট মুহূর্তেই তো আবদ্ধ তার পরিসীমা। সেই মুহূর্তকে মুহূর্তাতীত বা অনন্তের দিকে মেলে ধরাই চিত্রের একটি চিরন্তন প্রকল্প। কেবল যে নিরবয়বেই তা সম্ভব, কেবল যে ১৯১০ সালের ভাসিলি কান্দিনস্কির প্রথম প্রয়াসের পর থেকেই এই সাঙ্গীতিক অভিজ্ঞানের দিকে এগিয়ে যাওয়ার দরজা খুলেছিল, তা তো নয়। আদিম মানুষের চিত্রও তো দৃশ্যমান রূপের ভিতর দৃশ্যাতীতের ব্যঞ্জনা আনতে চেয়েছে। শুধু কি চিত্রকলারই থেকেছে সঙ্গীতের দিকে অভীপ্সা? সঙ্গীতও কি চায়নি ধ্বনির ভিতর দৃশ্যের ব্যঞ্জনা আনতে? কোনও কোনও সঙ্গীত সূর্যোদয়কে উদ্ভাসিত করে। অন্য কোনও সুর যুদ্ধের হিংস্রতাকেও দৃশ্যমান করে তুলতে চায়।

চিত্র ও ধ্বনির মধ্যে অন্তর্নিহিত এক সম্পর্ক আছে। তারা পরস্পরকে নির্মাণ করে। আবার বিনির্মাণও করে। এই দুই ভাষার পারস্পরিক টানাপড়েনের মধ্য দিয়ে ভিন্নতর এক চেতনা উৎসারিত করে। এ রকমই এক প্রকল্প নিয়ে সম্প্রতি একটি প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হল ‘এক্সপেরিমেন্টার’ গ্যালারিতে। শিল্পী ছিলেন হংকং-ভিত্তিক ৩৭ বছর বয়স্ক স্যামসন ইয়ং। ভারতে তাঁর এই প্রথম একক প্রদর্শনীর শিরোনাম ‘মাস্টারি অব ল্যাঙ্গোয়েজ অ্যাফোর্ডস রিমার্কেবল পাওয়ার’। সঙ্গীত এবং চিত্র দুইয়েরই মূলগত ভাষাকে তিনি নির্মাণ ও বিনির্মাণ, সংযোজন ও বিয়োজনের মধ্য দিয়ে তৃতীয় একটি ভাষ্যের আভাস আনার প্রয়াস করেছেন। চিত্র এখন আর প্রথাগত দৃশ্যতাতেই সীমাবদ্ধ নেই। ধ্বনিরও পরিসরকে, তার অন্তর্নিহিত সংকেতকে নিছক ধ্বনি-নিরপেক্ষ অন্যতর ব্যঞ্জনায় উদ্ভাসিত করা যায়। এ বিষয়ে বিদেশে কী ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা হচ্ছে তারই একটি দৃষ্টান্ত এই প্রদর্শনী।

Advertisement

স্যামসন ইয়ং একাধারে একজন সঙ্গীতস্রষ্টা, সঙ্গীতশিল্পী, লেখক এবং চিত্রশিল্পী। সঙ্গীত, দর্শন ও জেন্ডার স্টাডিজ নিয়ে তিনি সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করেছেন, সঙ্গীত রচনার উপর প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করেছেন।

২০১৭-র ভেনিস দ্বিবার্ষিকীতে হংকং-এর প্রতিনিধিত্ব করার জন্য তিনি নির্ধারিত হয়ে আছেন।

আলোচ্য প্রদর্শনীর শিরোনামে ব্যবহৃত হয়েছে আফ্রো-ক্যারিবিয়ান দার্শনিক, লেখক ও বিপ্লবী ফ্র্যাঞ্জ ফেনন-এর একটি বই ‘ব্ল্যাক স্কিন, হোয়াইট মাস্ক’-এর একটি উদ্ধৃতি, যেখানে ফেনন দেখিয়েছেন ‘বাচিকতা’ কেমন করে হয়ে ওঠে ক্ষমতায়ন ও একই সঙ্গে এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদের হাতিয়ার। বাচিকতারই উল্টো পিঠে থাকে নৈঃশব্দ্য। এই দুইয়ের রসায়নে ও দ্বান্দ্বিকতাতেই গড়ে ওঠে শিল্প। এই প্রদর্শনীতে শিল্পের সেই রসায়নকে অনুধাবনের চেষ্টা হয়েছে।

তাই প্রদর্শিত সাতটি রচনাগুচ্ছের পাঁচটিই ‘ফেনন’ নামটির সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে। এই সাতটি রচনাগুচ্ছ যার প্রতিটিতে পাঁচ থেকে আটটি চিত্রধর্মী দ্বিমাত্রিক রূপবন্ধ আছে, সেখানে প্রেক্ষাপট হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে সঙ্গীতের স্বরলিপি লেখা চিত্রপট।

এই যে সাঙ্গীতিক সংকেত, এগুলি প্রকৃত এক-একটি সঙ্গীতের বিমূর্তায়িত রূপ। সেই ধ্বনির স্মারককে তার নিজের অবস্থান থেকে সরিয়ে আনা হয়েছে।

সঙ্গীত-সত্তার এই বিনির্মাণের উপর আঁকা হয়েছে প্রেক্ষাপটের সঙ্গে আপাত-সম্পর্কহীন প্রতিমাকল্প, যেমন গাছের ডালে বসে থাকা একটি পাখি; বিউগল বাদনরত কোনও সুরশিল্পী, উপরে লেখা রয়েছে ‘মোজার্টস গ্রেস’ কথাটি; রাইফেল বগলে সৈনিক রয়েছে; কোথাওবা রয়েছে আঁধারলীন বিমূর্ত এক রূপবন্ধ, যার উপরে লেখা ‘আই সামন ইনটু বিইং’; কোথাও বা তুলি বা প্যাস্টেলের দ্রুতসঞ্চারী টানে আঁকা হয়েছে নিসর্গের দূরতর কিছু আভাস ইত্যাদি।

সুরের বিনির্মিত সংকেতের সঙ্গে প্রকৃতির ও জীবনের এই যে পুঞ্জ পুঞ্জ সংলাপ, এর ভিতর দিয়েই শিল্পী ধ্বনি ও দৃশ্যতার পারস্পরিক বিনিময়ের কতকগুলি সংহত মুহূর্ত তৈরি করেছেন। জীবনের ভাষ্য রচনা করেছেন নানা মাত্রায়।

এর সঙ্গে প্রদর্শিত হয়েছে দুটি ভিডিও। ‘মিউটেড স্ট্রিং কোয়ার্টেট’ এবং ‘মিউটেড লায়ন ডান্স’।

আরও পড়ুন
Advertisement