চিত্রকলা ও ভাস্কর্য ১

অন্ধকার ছাপিয়েও আলোর আত্মপ্রতিকৃতি

সম্প্রতি অ্যাকাডেমিতে অনুষ্ঠিত শ্যামলবরণ সাহা-র প্রদর্শনীটি দেখে এলেন মৃণাল ঘোষতোমার এলোচুল বেয়ে পৃথিবীতে নেমে এল সন্ধ্যার কালো রঙ! চতুর্দিকে অন্ধকার। ... আমি আর আলো জ্বেলে ভাঙতে চাইনে এমন কাঞ্চন আঁধার। — এমন কাঞ্চন আঁধারের বন্দনা করেছেন যে কবি, তিনি একজন চিত্রীও।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ০০:০০
শিল্পী: শ্যামলবরণ সাহা।

শিল্পী: শ্যামলবরণ সাহা।

তোমার এলোচুল বেয়ে পৃথিবীতে নেমে এল সন্ধ্যার কালো রঙ! চতুর্দিকে অন্ধকার। ... আমি আর আলো জ্বেলে ভাঙতে চাইনে এমন কাঞ্চন আঁধার। — এমন কাঞ্চন আঁধারের বন্দনা করেছেন যে কবি, তিনি একজন চিত্রীও। চিত্রশিল্পী পরিচয়েই তিনি অবশ্য সমধিক পরিচিত। তিনি শ্যামলবরণ সাহা। ছবি আঁকছেন প্রায় তিন দশক ধরে। কলকাতার কলেজ অব ভিসুয়াল আর্টস থেকে চিত্রশিক্ষা শেষ করেছিলেন ১৯৮৭-তে। প্রথম একক প্রদর্শনী করেছেন ২০০৪-এ। যে আঁধারের কথা তিনি বলেছেন উপরোক্ত শব্দবন্ধে, সেই আঁধারের তন্ময়তা থেকে তিনি জীবনের রহস্য সন্ধান করেন। এরই প্রকাশ ঘটে তাঁর কবিতায় যেমন, তেমনই ছবিতেও।

ছবির বিষয় হিসেবে তিনি বেছে নেন যে প্রাকৃতিক অবয়ব, তার ভিতর পুঞ্জিত থাকে এই অন্ধকার। শুধু অন্ধকার নয়, আলোর সঙ্গে অন্ধকারের এর রহস্যময় মিতালি, এই সখ্যেরই নাম দিয়েছেন তিনি আত্মপ্রতিকৃতি। না, সেই আত্মপ্রতিকৃতিতে তাঁর নিজের মুখের ছবি নেই। রয়েছে প্রকৃতির ছবি। প্রকৃতির সমগ্রতাকেও ধরতে চাননি তিনি। কাগজের উপর জলরঙে রূপায়িত করে আসছেন একটি নির্দিষ্ট বিষয় বাঁশগাছ বা বাঁশের বনের সম্পৃক্ত ঐকতান। এ রকম ছোট-বড় ৪৫-টি ছবি নিয়েই সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হল তাঁর পঞ্চম একক প্রদর্শনী।

Advertisement

কেন তিনি বাঁশবনের তন্ময়তার মধ্যে খুঁজে পান তাঁর আত্মআলেখ্য, তার কারণও তিনি বলেছেন কাব্যধর্মী কিছু শব্দবন্ধে। ‘সামান্য বাতাসে দুলে উঠে/ আমাকে দিয়েছো তুমি-/ ছন্দজ্ঞান,/ ... আমারই মতোন তুমি/ বড় অবহেলায় উঠেছো বেড়ে,/ দুর্বিনীত সবুজের কলকল স্রোতে/ আমিও অবিকল কিছুটা/ তোমার মতোন।’ শ্যামবরণের জীবনযাপনের মধ্যে গ্রাম ও শহর— দুই উৎসের ছন্দেরই আত্তীকরণ আছে। বর্ধমানের গ্রামীণ পরিবেশে তিনি বড় হয়েছেন। এখনও থাকেন সেখানে। একই সঙ্গে কলকাতাও তাঁর আবাসস্থল। এই দ্বিবিধ ছন্দের দোলা আছে তাঁর কবিতায় এবং ছবিতেও। কিন্তু উচ্ছৃঙ্খল, অনিয়ন্ত্রিত নাগরিক কোলাহলকে তিনি প্রকৃতির তন্ময়তা দিয়ে আবৃত করতে চান। বৃক্ষের বেড়ে ওঠার ছন্দ উপহার দেন শহরের মানুষকে।

ছন্দের এই অন্তর্মুখী তন্ময়তা প্রাচ্য শিল্পের একটি বৈশিষ্ট্য। প্রকৃতির অন্তহীন রহস্যের কাছে সব সময়ই নতজানু হতে চান প্রাচ্যের শিল্পী। আত্মাকে ছাপিয়ে যেতে দেন না সেই তন্ময়তার উপর। আমাদের দেশে যেমন, তেমনই চিন, জাপানের ধ্রুপদী শিল্পেও এই অভিজ্ঞান আমরা দেখে থাকি। প্রাচ্যে এমন শিল্পী অনেক আছেন যাঁরা গাছের পাতা বা জলের ঢেউ এঁকে গেছেন দীর্ঘ দিন ধরে। আধুনিক যুগেও এই পুনরাবর্তনের দৃষ্টান্ত অবিরল নয়। ক্লদ মানে একই খড়ের গাদার দৃশ্য এঁকেছন বিভিন্ন আলোর প্রতিফলনে। পল সেজান পুনরাবৃত করেছেন একই পাহাড়ের ছবি। আমাদের দেশে নন্দলাল বসু, যামিনী রায় থেকে সৈয়দ হায়দর রাজা-র বিন্দু-চিত্রমালা পর্যন্ত একই বিষয়ে দীর্ঘ দিন মগ্ন থাকার দৃষ্টান্ত আরও আছে।

শ্যামলবরণ যে বাঁশগাছের ছবি আঁকেন তা এক অর্থে তাঁর কাছে প্রকৃতির ছন্দকে আত্মস্থ করার সাধনা। সেই ছন্দের সঙ্গে সঙ্গে চিত্রীয় পরিসরের রহস্যময়তাকেও নানা দৃষ্টিকোণ থেকে অনুশীলন করেন তিনি। তাঁর একটি ছবিতে ঘনসংবদ্ধ পত্রপুঞ্জের মগ্নতা। ডালগুলি সরলরেখায় বা বক্ররেখায় সেই পত্রপুঞ্জের উপর দিয়ে প্রসারিত হয়ে যায়। ঘন সবুজের ভিতর ছড়িয়ে পড়ে মগ্ন লালিমার আভা। তার পরই পত্রপুঞ্জের সামান্য অবকাশের ভিতর দিয়ে ভেসে আসে এক ঝলক স্বর্ণাভ আলো। অন্য একটি ছবিতে পাতারা হয়তো নৈর্ব্যক্তিক নির্লিপ্ততায় পরস্পরের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ছড়িয়ে থাকে। সহসা যেন তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে সূর্যোদয়ের এক ঝলক লালাভ আলো। এই আলো ভেদ করে প্রেক্ষাপটে ব্যাপ্ত হয়ে থাকে আকাশের মগ্ন নীলিমা। কোথাও শুভ্র শূন্যতাকেই যেন বাঙ্ময় করে তুলতে চায়।

আসলে এইভাবে শিল্পী দৃশ্যের অন্তরালবর্তী দৃশ্যাতীত বিমূর্ততার ছন্দকেই অনুধাবন করতে চান। পিট মন্ড্রিয়ান অরণ্য আঁকতে আঁকতে এক দিন প্রকৃতিকে অতিক্রম করে নিজস্ব প্রকৃতি রচনা করেছিলেন। শ্যামলবরণ এখনও দৃশ্যের মধ্যেই দৃশ্যাতীতের রহস্য সন্ধান করছেন।

আরও পড়ুন
Advertisement