পুস্তক পরিচয় ২

পুরনো মমতা-মানবিকতা মেদুর করে

নরেন্দ্রনাথ মিত্রের (১৯১৬-’৭৫) জন্মশতবর্ষ খুব একটা টের পাওয়া গেল না। এমনটাই স্বাভাবিক। একান্ত স্বাভাবিক আর সভ্য রুচিবোধ ছিল তাঁর শৈলীর ভূষণ।

Advertisement
রুশতী সেন
শেষ আপডেট: ১৯ মার্চ ২০১৬ ০০:০০
হৃদয়চর্চা, নরেন্দ্রনাথ মিত্র। সম্পা: অভিজিৎ মিত্র। কারিগর, ৩৫০.০০

হৃদয়চর্চা, নরেন্দ্রনাথ মিত্র। সম্পা: অভিজিৎ মিত্র। কারিগর, ৩৫০.০০

নরেন্দ্রনাথ মিত্রের (১৯১৬-’৭৫) জন্মশতবর্ষ খুব একটা টের পাওয়া গেল না। এমনটাই স্বাভাবিক। একান্ত স্বাভাবিক আর সভ্য রুচিবোধ ছিল তাঁর শৈলীর ভূষণ। সেই শৈলীতে স্থিত থেকেই বহু বিচিত্র বিষয়কে তিনি অনায়াসে সার্থক ছোটগল্প করে তুলতেন। তাঁর লিখনপদ্ধতি থেকে লেখক-মানস, সব কিছু থেকেই আজকের পাঠকের দুস্তর ব্যবধান। সেই মনটাই আজ প্রায় বেপাত্তা, যে বন্ধুত্ব নিয়ে, পাড়া-পড়শি, আড়ি-ভাব, কারণে-অকারণে মানুষে-মানুষে সহমত-অসহমত নিয়ে ভাবে, বিচলিত হয়। সে দিক থেকে আলোচ্য প্রবন্ধসংকলনটি এক গুরুত্বপূর্ণ নথি। সংকলিত সত্তরটি নিবন্ধে তেমন এক মনের হদিশ মেলে। মধ্যবিত্ত দিনযাপনের ঠিক-ভুল, দুঃখ-সুখ, সাংসারিক-সামাজিক দায়বদ্ধতার খণ্ড-বিখণ্ড বেশ খোলামেলা ভাবেই ছড়িয়ে আছে এখানে। বোঝা যায়, নিজের সৃজন প্রসঙ্গে লেখকের আত্মবিশ্বাস যথেষ্ট, কিন্তু সে বিশ্বাস আত্মরতিতে আচ্ছন্ন নয়। তাই ‘নিজের কথা’ নিবন্ধে অসফল গল্পলেখককে নিয়ে তাঁর সহানুভূতির অন্ত নেই। সঙ্গে সঙ্গে নিজের অজানা অনাগত ভবিষ্যৎ প্রসঙ্গে সতর্কতাও আছে। ‘ভালো লাগা না-লাগা’, ‘লেখক পাঠক প্রসঙ্গ’ বা ‘সাহিত্যপ্রসঙ্গ’র মতো লেখায় আপাতসরল কথকতার সূত্রে বেরিয়ে আসে জরুরি চিন্তার খোরাক। বইপড়ায় আগ্রহ হারানো গ্রন্থাগারকর্মী আর জীবনভর বই বেচে শেষজীবনে নিবিষ্ট পাঠক হয়ে ওঠা ব্যবসায়ীকে পাশাপাশি সাজিয়ে নরেন্দ্রনাথ জটিল প্রশ্ন তুলেছেন, উত্তরের জন্য ব্যগ্র হননি। দুরূহ প্রশ্নের নিশ্চিত উত্তর বাতলানোই যে প্রাবন্ধিকের কাজ, এই ভুল ধারণাটা ভাঙবার মতো উপকরণ এখানে আছে।

কখনও বা সন্দেহ জাগে, সত্যিই নিবন্ধ তো, না কি আসলে ছোটগল্পই? ‘সুনীল ভাদুড়ী’ লেখাটিতে অসুস্থ সুনীল যখন তার প্রিয় লেখকের কাছে নিয়মিত অর্থসাহায্যের আর্জি জানায়, ব্যাপারটা লেখকের পরিবার-পরিজনের স্বভাবতই পছন্দ হয় না। যেদিন সুনীলের শবদেহের আভরণ হিসেবে ফুলের মালা দিয়ে আসেন, সেদিন তাঁর বাড়ির লোক বলেন, তিনি ভালই করেছেন। ঠিক-ভুল, ন্যায়-অন্যায়ের ব্যাপার নয় এটা। সাধারণ্যের মনস্তত্ত্বের স্বতঃস্ফূর্ত বিন্যাস পরম ঋজুতায় বিছিয়ে দিতে পারেন বলেই টুকরো স্মৃতিকে ছোটগল্প বলেও পড়া যায়। ‘মাটির মানুষ’ কেদার চৌকিদারও যেন নরেন্দ্রনাথের গল্পেরই চরিত্র। ‘সুখ-দুঃখের কথা’য় বাসের সেই স্বাস্থ্যহীন, রূপে রিক্ত সহযাত্রিণী তাঁর এক বা একাধিক গল্পের মুহূর্তে মিশে আছেন! নিজের সাহিত্যিক পরিচয় জাহির করবার কোনও বাড়তি উদ্যোগ থেকে নিবন্ধগুলি আশ্চর্যরকম মুক্ত। সেই মুক্তির পরিসরই বইটি অনায়াসে পড়বার সহায় হয়।

Advertisement

রবীন্দ্রনাথ প্রসঙ্গে পাঁচটি প্রবন্ধে খুঁজে পাওয়া যায় পূজার ছলে তাঁকে ভুলে থাকার প্রবণতা, যা নাকি সময়ের তালে ভক্তের উদ্যোগ-আয়োজনের অগভীর আধিক্যেতায় বেড়েছে বই কমেনি। ‘ব্যথার পাঁচালি’ পড়তে পড়তে মনে প্রশ্ন জাগে, বিভূতিভূষণের অপু’কে কি অত অনিবার্য ভাবে নিজের ভিতরে খুঁজে পায় আজকের শহুরে এমনকী গ্রামীণ বাল্য? শরৎচন্দ্র, তারাশংকর, মানিক, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, স্বর্ণকমল ভট্টাচার্য, নরেন্দ্র-রাধারানি দেব, আশাপূর্ণা দেবী, প্রমথনাথ বিশী থেকে সচিত্র ভারত-এর নরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, উল্টোরথ-প্রসাদ-এর গিরীন্দ্র সিংহ, যুগান্তর-এর দক্ষিণারঞ্জন বসু বা শান্তিরঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়— যাঁর কথাই লিখেছেন নরেন্দ্রনাথ, সর্বত্রই পাঠক-শ্রোতা-দর্শক হিসেবে স্মৃতিকথকের সূক্ষ্ম অনুভূতিটাই মুখ্য। ওই সূক্ষ্মতা যে সৃজনশীল লেখকের একচেটিয়া, এমন কোনও বজ্র আঁটুনির মোহ নেই তাতে। যখন তিনি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়ে লেখেন ‘একটি নাম আর কয়েকটি বই’, তখনকার আন্তরিকতা এতটুকু টাল খায় না ‘আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়’-এর বিন্যাসে কিংবা ‘সমারসেট মম’-এর গ্রন্থনায়।

জ্ঞাতিকুটুম্ব বন্ধু পড়শি পাড়া পরিবার পরিজন আদর্শ হৃদয় সব ধারণাই সময়ের গতিতে বদলেছে এবং বদলাচ্ছে। পরিবর্তনমুখর এই আবহে নরেন্দ্রনাথের ধরতাই কিংবা চলন আজকের আখ্যানকারের মননে কিংবা লিখনে খোঁজা অসংগত। এমনকী কাকে বা কাদের বলা যেতে পারে তাঁর প্রত্যক্ষ উত্তরসূরি, তা নিয়েও অনিশ্চয়তা। সুরসাধক বুন্দু খাঁর মতো আলটপকা প্রশ্ন যদি করে বসেন আজকের কোনও শিল্পী, তবে কি তিনি আর খোলা পাবেন সরকারি প্রচারমাধ্যমের অর্গল? ১৯৬৩-তে ‘শিল্পীর স্বাধীনতা’ লিখতে-লিখতেই নরেন্দ্রনাথ যেন বুঝছিলেন, শিল্পী-সাহিত্যিক-সংস্কৃতিকর্মীদের ইমান কিংবা স্বাধীনতার সংজ্ঞা ওলটপালট হয়ে যাচ্ছে। নরেন্দ্রনাথ মিত্রের তুল্য অতখানি আপাতসাধারণ গদ্য, আবার অতখানি আপাত-হেলায় দৈনন্দিনের উদ্বৃত্তটুকু সাহিত্যের জন্য আহরণ, অতখানি অনায়াসপাঠ্য আবার বিনয়ী নিম্নকণ্ঠ আত্মসমালোচনা (‘আত্মসমালোচনা’, ‘কেন নাটক লিখি না’ বা ‘নরেন্দ্রনাথ মিত্র’ যার প্রত্যক্ষ নিদর্শন) আজ কি আর চোখে পড়ে? নিজের সৃজনক্ষমতায় বিপুল তৃপ্তি আর নিজের প্রাপ্তি নিয়ে প্রবল অসন্তোষই বোধহয় আজকের শিল্পী-স্বাধীনতার সবচেয়ে বড়সড় অংশ।

মনে পড়ে চেনামহল উপন্যাসে মামাতো-পিসতুতো ভাইবোন বিজু-প্রীতির প্রণয়ের চরম মুহূর্ত। একসঙ্গে বাঁচতে পারবে না বলে একসঙ্গে মরবার সিদ্ধান্ত নিয়েছে তারা। প্রীতির বিয়ের দিনে কনে-দেখা আলোর বিকেলে বিষের শিশি প্রীতির হাতে দেওয়ার কথা বিজুর। প্রীতির বাড়ানো হাতে একমুঠো সাদা ফুল দিয়ে বলেছিল বিজু— আর কিছু না-ই বা দিলাম। প্রীতি জোর করেই নিয়েছিল বিষের শিশি, কিন্তু খেতে পারেনি তা, রাতভর দামাল বরের সাহসী ভালবাসার তাড়নায়। প্রীতির তুলনায় অনেক শান্ত, অনেক ভিতু বিজু কিন্তু সে রাত্রে শেষ করে দিয়েছিল নিজেকে। সাদা ফুলের প্রতীকে, ‘আর কিছু না-ই বা দিলাম’-এর প্রতিমায় এক আশ্চর্য মুহূর্ত নির্মাণ করেছিলেন নরেন্দ্রনাথ মিত্র। গত শতকের বিশ-তিরিশের বছরগুলিতে নিম্নবিত্ত বাঙালি জীবনের ঘেরে যত অনুশাসন-বিভ্রান্তি, যত ক্লেদ-অপচয়, যত বিচ্যুতি-ভীরুতা, তার ব্যক্ত-অব্যক্তকে মন্থন করে দুঃসাহসী তবু পরাজিত সেই জীবনমুহূর্ত মূর্ত হয়েছিল বাংলা সাহিত্যে। নরেন্দ্রনাথ মিত্রের চেনামহল-এর আবর্ত আজ অতীত। কিন্তু স্বাধীনতা-স্বাধীনতা খেলায় মাতোয়ারা এক প্রবল পরাধীন আর চরম পর্যুদস্ত জীবনের শরিক কি নয় আজকের নিম্নবিত্ত যৌবন? সেই যৌবনের যাপন জুড়ে বিভ্রান্তি-বিবেচনার বেহিসেব-হিসেবের, পরাজয়ের কিংবা জয়ের, মৃত্যুর অথবা বেঁচে থাকার মুহূর্ত নির্মাণে সাহিত্যিক মমতা তো আজও পরম কাঙ্ক্ষিত! হৃদয়চর্চা নামের এই সার্থকনামা সংকলনটি পড়তে পড়তে পাঠকের সে আকাঙ্ক্ষা বাড়ে। ফেলে আসা সময়ের জটিলতর উত্তরাধিকার দেহে-মনে বইতে-বইতে পুরনো মমতা-মানবিকতার জন্য মেদুর হই আমরা। বাতিলের জন্য অভাববোধ নিরর্থক। তবু সে নিরর্থের মায়া বড় মায়া! আর কে বলতে পারে, নিরর্থের অন্তরেই নতুন অর্থের আবাহন মিশে আছে কি না!

আরও পড়ুন
Advertisement