পুস্তক পরিচয় ২

যে ভাবে এক বামপন্থী ছাত্রনেতার জন্ম হয়

এ বছর মার্চ মাসের গোড়ায় মারাত্মক চমকে দিয়েছিল ছেলেটা। তত দিনে গোটা দেশ তাকে চিনে ফেলেছে— জেএনইউ-এর ছাত্রনেতা কানহাইয়া কুমার। প্রথমে পুলিশ হেফাজত, তার পর তিহার জেলে দিন কুড়ি বন্দিদশার পর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ফিরেছে সে।

Advertisement
অমিতাভ গুপ্ত
শেষ আপডেট: ১২ নভেম্বর ২০১৬ ০০:০০

এ বছর মার্চ মাসের গোড়ায় মারাত্মক চমকে দিয়েছিল ছেলেটা। তত দিনে গোটা দেশ তাকে চিনে ফেলেছে— জেএনইউ-এর ছাত্রনেতা কানহাইয়া কুমার। প্রথমে পুলিশ হেফাজত, তার পর তিহার জেলে দিন কুড়ি বন্দিদশার পর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ফিরেছে সে। তার পর সেই এক ঘণ্টার ভাষণ, এবং সেখানেই চমক। টেলিভিশনের পর্দায় তার ভাষণ শুনতে শুনতে ভাবছিলাম, এই ছেলেটা কী ভাবে প্রধানমন্ত্রীর চোখে চোখ রেখে একের পর এক আক্রমণ শানিয়ে যেতে পারে? কী ভাবে এক সাধারণ ছাত্রনেতা হয়ে ওঠে রাষ্ট্রপ্রধানের প্রত্যক্ষ প্রতিস্পর্ধী?

ফ্রম বিহার টু তিহার-এ কানহাইয়া নিজেই সেই প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন। বিহারের বেগুসরাইয়ের এক অকিঞ্চিৎকর গ্রামে দরিদ্র পরিবারে জন্ম থেকে বড় হয়ে ওঠা, বঞ্চনা, অপমান, দুবাইয়ে এয়ার কন্ডিশনার সারাবার চাকরি করতে যাওয়ার পরিকল্পনা থেকে দেশের অন্যতম সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা— কানহাইয়ার যাত্রাপথই আসলে সেই প্রশ্নের উত্তর। কোনও গরিব পরিবারের মেধাবী ছেলেকে যে বাধাগুলোকে ডিঙিয়েই এগিয়ে চলতে হয়, কানহাইয়াও সেই গল্প বলেছেন। সঙ্গে বলেছেন, প্রতিটি অভিজ্ঞতা তাঁকে কী শিখিয়ে গিয়েছে। শিক্ষা-স্বাস্থ্য বেসরকারি হাতে চলে যাওয়া মানে গরিবের, দলিত-অনগ্রসরদের এই পরিষেবাগুলো থেকে বঞ্চিত করা, উন্নয়ন অর্থনীতির কোনও বই থেকে এই কথা শিখতে হয়নি কানহাইয়াকে। অভিজ্ঞতা তাঁকে শিখিয়েছে। দিল্লির বিহারি মজদুরদের বস্তিতেও কী ভাবে স্থানীয় আর বহিরাগতদের লড়াইয়ের আগুনে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ সেঁকে নেওয়া যায়, কানহাইয়া দেখেছেন। একটি বুদ্ধিমান বালক কী ভাবে সমাজের বিভিন্ন ঘাত-প্রতিঘাতে পাল্টাতে পাল্টাতে শেষ অবধি কানহাইয়া কুমার হয়ে ওঠে, ফ্রম বিহার টু তিহার আসলে সেই আখ্যান।

Advertisement

কানহাইয়া এমন কিছু প্রশ্ন খুলে রেখেছেন, যা বামপন্থীদের কেতাবে পাওয়া মুশকিল। শুধু শ্রেণি নয়, শুধু অর্থনীতি নয়, ভারতের শোষক-শোষিতের গল্পটা বুঝতে হলে যে জাতপাতের দিকে তাকাতেই হবে, কিছু দিন আগেও কোনও পেশাদার বামপন্থী এই কথাটা লিখে উঠতে পারতেন না। কানহাইয়া একটা মোক্ষম কথা বুঝে ফেলেছেন— শিক্ষিত লোকরা আম আদমির সমস্যা নিয়েও যখন কথা বলেন, তখনও তাঁদের মুখের ভাষা আম আদমির নাগালের অনেক বাইরেই থেকে যায়। সমস্যা আসলে আমাদের, এই শিক্ষিত শ্রেণির— আমরা মানুষের কাছে পৌঁছতেই পারি না, আর সেই ফাঁক গলে বিজেপি ঢুকে পড়ে ঘরে ঘরে। জেএনইউ-এর বেসরকারি নিরাপত্তারক্ষীদের বেতনবৃদ্ধির জন্য আন্দোলন করতে সংগঠিত করেছিলেন তাঁরা। কেন তাঁদের দাবি জেএনইউ কর্তৃপক্ষের কাছেই পেশ করতে হবে, কেন সিকিয়োরিটি এজেন্সির কাছে নয়, এই কথাটা কী ভাবে বুঝিয়ে বলেছিলেন তিনি, লিখেছেন কানহাইয়া। ভবিষ্যতে তিনি বড় নেতা হবেন কি না, ভবিষ্যৎই জানে, কিন্তু বাম রাজনীতি যদি তাঁর থেকে এই বুঝিয়ে বলার ধরনটুকু শিখতে পারে, মস্ত কাজ হবে।

তবে, খামতিও আছে। একটু ব্যক্তিগত প্রসঙ্গে যাই। কানহাইয়ার প্রায় এক দশক আগে আমি জেএনইউ-এর ছাত্র ছিলাম। সঙ্ঘ পরিবারের ছাত্র সংগঠন অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদ ক্যাম্পাস-রাজনীতিতে তখনও ছিল, কিন্তু বিশেষ কেউ প্রকাশ্যে তাদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখত না। পরের দশ বছরে কী ভাবে বদলে গেল ছবিটা? কী ভাবে ক্রমশ বাড়তে থাকল এবিভিপি-র ভোট? উত্তরটা হল, ভারতে বাম রাজনীতির মজবুততম দুর্গ জেএনইউ-তেও বামপন্থীরা ছাত্রদের কাছে নিজেদের রাজনীতি নিয়ে যেতে পারেনি। ছাত্রদের একটা বড় অংশ ক্রমে ‘অ-রাজনৈতিক’ হয়ে উঠেছে। গুজরাতের গণহত্যার নায়কদের যে কোনও ভাবেই সমর্থন করা যায় না, এই কথাটা দশ বছর আগের জেএনইউ যতখানি সর্বজনীন ভাবে বুঝত, আজকের জেএনইউ বোঝে না। অ-রাজনীতিই এই বোঝার পথ বন্ধ করে দিয়েছে। বামপন্থী ছাত্র রাজনীতির ব্যর্থতা, জেএনইউ ক্যাম্পাসেও এই অ-রাজনীতির অভ্যুত্থান ঠেকানো যায়নি।

২০০২ সালের ১০ অগস্ট ক্যাম্পাসে এসেছিলেন বিশ্ব হিন্দু পরিষদের অশোক সিঙ্ঘল। বামপন্থী ছাত্ররা প্রতিবাদ করে, কালো পতাকা দেখায়। পাল্টা আক্রমণ করে এবিভিপি, একেবারে ইট-লাঠি হাতে। জেএনইউ আগে কখনও সেই হিংস্রতা দেখেনি। সে দিনও কিন্তু ক্যাম্পাসে পুলিশ ডেকে আনা হয়নি। এসএফআই-এআইএসএফ ছাত্র ইউনিয়নই পরিস্থিতি সামাল দিয়েছিল। নর্থ গেট পেরিয়ে ক্যাম্পাসে পুলিশ ঢুকত না। আজ ক্যাম্পাসের ভিতরে যখন-তখন পুলিশের উপস্থিতিতে ছাত্ররা অভ্যস্ত হয়ে উঠছে কেন, কানহাইয়া সেই প্রশ্ন করেননি। করলে, ফের সেই অ-রাজনীতির রমরমার কথা আসত।

১১ ফেব্রুয়ারি গ্রেফতার হওয়ার পরের তিন সপ্তাহ কী কী হল, কানহাইয়া লিখেছেন। কিন্তু, সেই কাহিনি এই বইয়ের মূল আকর্ষণ নয়। এটা আসলে তাঁর প্রধানমন্ত্রীর প্রতিস্পর্ধী হয়ে ওঠার ইতিহাস। পঁচিশ বছরের ইতিহাস।

ফ্রম বিহার টু তিহার। কানহাইয়া কুমার। জাগরনট, ২৫০.০০

আরও পড়ুন
Advertisement