পুস্তক পরিচয় ১

বাংলা গানের স্বর্ণযুগকে স্পর্শ করা যায়

লতা মঙ্গেশকর তাঁকে চিহ্নিত করেন বিরলতম প্রতিভা হিসেবে। সুচিত্রা মিত্র বলেন: তিনি ‘রবীন্দ্রোত্তর যুগে শ্রেষ্ঠ পূর্ণাঙ্গ সংগীতকার...।’ সলিল চৌধুরী। এক ও অদ্বিতীয়। সংগীত সৃজনই তাঁর প্রধান ক্ষেত্র, তবে সাহিত্য-সংস্কৃতির বিভিন্ন শাখাতেই তাঁর কৃতি ছড়ানো।

Advertisement
স্বপন সোম
শেষ আপডেট: ১৯ মার্চ ২০১৬ ০০:০০

লতা মঙ্গেশকর তাঁকে চিহ্নিত করেন বিরলতম প্রতিভা হিসেবে। সুচিত্রা মিত্র বলেন: তিনি ‘রবীন্দ্রোত্তর যুগে শ্রেষ্ঠ পূর্ণাঙ্গ সংগীতকার...।’ সলিল চৌধুরী। এক ও অদ্বিতীয়। সংগীত সৃজনই তাঁর প্রধান ক্ষেত্র, তবে সাহিত্য-সংস্কৃতির বিভিন্ন শাখাতেই তাঁর কৃতি ছড়ানো। সংগীতবিষয়ক প্রবন্ধ তো লিখেইছেন, সেই সঙ্গে আত্মকথা, গল্প-নাটক-কবিতা। প্রতিভাদীপ্ত মানুষটির বৈচিত্রময় সৃষ্টি নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে দু’টি গ্রন্থ: সলিল চৌধুরী রচনাসংগ্রহ ১ (সম্পাদনা: সবিতা চৌধুরী, অন্তরা চৌধুরী, রণবীর নিয়োগী) এবং রচনাবলী/ সলিল চৌধুরী (সম্পাদনা: সমীরকুমার গুপ্ত)। প্রথমটিতে তাঁর বাংলা গান, পাঁচটি প্রবন্ধ, কয়েকজনের শ্রদ্ধাঞ্জলি আর দ্বিতীয়টিতে গল্প-নাটক-প্রবন্ধ-সাক্ষাৎকার-আত্মজীবনী।

নিছক গান লেখার জন্য নয়, কৈশোরে দক্ষিণ ২৪ পরগনার কৃষক আন্দোলনের প্রেক্ষিতে লিখেছিলেন প্রথম গান: ‘দেশ ভেসেছে বানের জলে’। ক্রমশ বামপন্থী আন্দোলন, ভারতীয় গণনাট্য সংঘের সঙ্গে যুক্ত হওয়া, গণসংগীত রচনায় জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র, হেমাঙ্গ বিশ্বাস, বিনয় রায়দের সহযাত্রী হওয়া। তবে জ্যোতিরিন্দ্রর ‘নবজীবনের গান’, হেমাঙ্গর ‘কাস্তেটারে দিও জোরে শান’-এর পাশে সলিল অন্য দিকে গেলেন বিষয়ে নয়, আঙ্গিকে। ছোটবেলা থেকে দেশিবিদেশি গান শুনে তৈরি হওয়া স্বতন্ত্র বোধ এখানে কাজ করেছে। ‘ও আলোর পথযাত্রী’-তে প্রাথমিক ক্লান্তি রূপান্তরিত হয় বলিষ্ঠ প্রতিজ্ঞায়, সেই ভাবেই সুর ও ছন্দবদল। হরতালের গান ‘ঢেউ উঠেছে কারা টুটছে’-তে যদি পাশ্চাত্য অনুষঙ্গ, ‘বিচারপতি তোমার বিচার’-এ কীর্তনের ঢং। একই গানে মেজর-মাইনর কর্ডের খেলা, তালফেরতা, ‘সা’ বদলে যাওয়া তাঁর সুর-আঙ্গিকের অন্যতম চরিত্রলক্ষণ যা চমক নয়, কথা-ভাবেরই অনুষঙ্গী। ‘গণসংগীতের বাণী ও সুরারোপ’, ‘সমকালীন বাংলা তথা ভারতীয় সংগীতে পাশ্চাত্য সংগীত পদ্ধতির প্রভাব’ প্রভৃতি প্রবন্ধ ও সাক্ষাৎকারে তাঁর সুররচনার খুঁটিনাটির হদিশ মিলবে।

Advertisement

সলিল চৌধুরী রচনাসংগ্রহ ১, সম্পা: সবিতা চৌধুরী, অন্তরা চৌধুরী, রণবীর নিয়োগী। দে’জ, ৬৫০.০০

রচনাবলী/ সলিল চৌধুরী, সম্পা: সমীরকুমার গুপ্ত। মিলেমিশে, ৫০০.০০

১৯৪৯-এ বাংলা গানের মূল ধারায় তথা পেশাদারি জগতে সলিলের প্রবেশ হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে ‘কোনও এক গাঁয়ের বধূ’-র কথা শুনিয়ে। আধুনিক গানে দিক্‌বদল ঘটল। দুঃখের বিষয়, ‘গাঁয়ের বধূ’, তারপর ‘রানার’, ‘পাল্কির গান’ সুনজরে দেখেনি গণনাট্য সংঘ। সংঘের এই গোঁড়ামি নিয়ে সলিলের সঙ্গত ক্ষোভ চাপা থাকেনি বিভিন্ন প্রবন্ধ ও সাক্ষাৎকারে। আবার গণনাট্য সংঘের আবহেই যে তাঁর ভিত্তি গড়ে উঠেছিল, সে কথা জানাতেও ভোলেননি। বাংলা, তারপর মুম্বই, দক্ষিণী সংগীতজগতে যুক্ত হয়েছেন, কিন্তু কখনওই রুচিহীনতায় আক্রান্ত হননি। সংগ্রামী চেতনা বিসর্জন দেননি, তাই ১৯৮১-তেও লিখতে পারেন: ‘এ জীবন বেশ চলছে’ কিংবা ‘আর দূর নেই দিগন্তের’।

‘হেমন্তবাবু আর লতা যদি না থাকতেন, তা হলে মানুষ সলিল চৌধুরীকে চিনত না’— সলিলের এমত মন্তব্য নিশ্চয়ই গ্রহণযোগ্য। পাশাপাশি সন্ধ্যা শ্যামল দ্বিজেন উৎপলা প্রতিমা ধনঞ্জয় সবিতা মান্না মাধুরী দেবব্রত প্রমুখের কথাও মনে পড়ে তাঁর গানের রূপায়ণে। সলিলের আধুনিক গানের ব্যাপ্তি অনেক— শুধু প্রেম নয়, জীবনসম্পৃক্ত নানা অনুভব উঠে এসেছে। অন্যের কবিতায় সুরারোপে সচেতন ভাবেই সলিলের নির্বাচন সুকান্তর ‘রানার’, ‘অবাক পৃথিবী’, সত্যেন দত্তর ‘পাল্কি চলে’। প্রেমের গানের পাশাপাশি নিজে লেখেন ‘প্রান্তরের গান আমার’, ‘নাও গান ভরে নাও’ বা ‘এবার আমি আমার থেকে’। ঝড়ের কাছে ঠিকানা রেখে-যাওয়া এই শিল্পীমানুষটির একমাত্র বাসনা: ‘ধরণীর পথে পথে ধূলি হয়ে রয়ে যাব’— এমনটা সলিলই লিখতে পারেন। তাঁর ছোটদের গানেও সমাজ সচেতনতার ইশারা আছে। তবুও দু-একটা কথা। কিছু কিছু শব্দবন্ধ যেমন— সজনী, মগন, গহন, মনোবীণা প্রভৃতি বারবার ব্যবহৃত, এই সীমাবদ্ধতা অনভিপ্রেত। কোনও কোনও সময় জোর করে মেলানো হয় পঙ্‌ক্তি। যথা— ‘আর কিছু না’-তে ‘সান্ত্বনা’-র সঙ্গে মিল দিতে গিয়ে লেখেন ‘শতগুণা’ (শতগুণ বোঝাতে)। কথায় সাধু-চলিত গুরুচণ্ডালী দোষের কথাও উঠেছে। তবে গানের সুর শিল্পীর গায়ন, কথার সঙ্গে এতটাই সম্পৃক্ত যে সাধু-চলিতের ওই মিশেল কানেই বাজে না। বেসিক গানের তুলনায় বাংলা ছবিতে সলিলের কাজ কম। তবু ‘একদিন রাত্রে’, ‘গঙ্গা’ প্রভৃতি ছবিতে মুন্সিয়ানাটা বুঝিয়ে দিতে পারেন। অবশ্য ছবিতে গানের চেয়ে আবহসংগীতই তাঁর কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ— তারই পরিচায়ক আলোচ্য গ্রন্থের দুটি প্রবন্ধ: ‘চলচ্চিত্রে আবহ সংগীত’ ও ‘চলচ্চিত্রে আবহ সংগীতের ভূমিকা’। যে কোনও গানেই উপযোগী যন্ত্রায়োজনের ব্যাপারে সলিল বিশেষ মনোযোগী। হরেক যন্ত্র-জানা সলিল নিজেই যন্ত্রানুষঙ্গ রচনা করেন, যার রূপায়ণ কঠিন, কিন্তু শুনলে ভোলা যায় না।

সলিল চৌধুরী ও হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, ১৯৮৮।

বিজ্ঞাপনের গান বাদে তাঁর প্রায় সব বাংলা গান আলোচ্য প্রথম গ্রন্থটিতে সংকলিত। সঙ্গে যাবতীয় তথ্য: রেকর্ড নং, প্রকাশকাল, শিল্পীর নাম, একাধিক বার রেকর্ড হলে তার কথা, পাঠভেদ— এ সবই বিশেষ প্রশংসনীয়। কিন্তু গানগুলির বিন্যাস বড্ডই এলোমেলো— আগের গান পরে, পরের গান আগে। অধিকাংশই তো রেকর্ডের গান, তাই রেকর্ডের প্রকাশকাল অনুসারেই সাজানো যেত। ‘গণসংগীত’ পর্যায়ের শুরুর গানটি হওয়া উচিত ছিল— ‘দেশ ভেসেছে বানের জলে’— সলিলের প্রথম গান। ‘ছায়াছবির গান’-এ প্রথমেই আশ্চর্যজনক ভাবে ১৯৮৫-র ‘দেবিকা’-র গান! চলচ্চিত্রের মুক্তিকাল অনুযায়ী সাজালে যথার্থ হত। দু-একটি তথ্যগত অসম্পূর্ণতাও লক্ষণীয়। হেমন্তর একদা-বিখ্যাত বেসিক ‘পথ হারাব বলেই এবার’ অনেক পরে ‘প্রতিজ্ঞা’ (১৯৮৫) ছবিতে যেশুদাসকে দিয়ে গাইয়েছিলেন সলিল— এ তথ্য অনুপস্থিত। ‘চলছে আজ চলবে কাল’-এর রচনাকাল দেওয়া হয়েছে ১৮৯৬— তা ছাড়া প্রথম লাইনেও ভুল— এ নিশ্চয় মুদ্রণ প্রমাদ। রেকর্ড-না-হওয়া গানের তথ্য প্রদানে ‘উপলব্ধ নয়’ এমন অদ্ভুত বিজ্ঞাপনী ভাষা ব্যবহৃত, রেকর্ড হয়নি বললেই তো চলত।

সুলিখিত ভূমিকাসমৃদ্ধ আলোচ্য দ্বিতীয় গ্রন্থটিতে সংকলিত প্রবন্ধাবলি-সাক্ষাৎকারে সলিলের সংগীতচিন্তা সম্যক রূপেই প্রকাশিত যার মূল কথা— কোনও গোঁড়ামি না রেখে যে কোনও সংগীতকেই আত্মীকরণ করে কাজে লাগানো যায়। সমকাল, সমাজ, রাজনীতি সম্পর্কেও তাঁর অনুসন্ধিৎসু মনের পরিচয় মেলে বিভিন্ন প্রবন্ধ-সাক্ষাৎকারে। তবে তাঁর সব বক্তব্যই প্রশ্নাতীত নয়। এক সাক্ষাৎকারে হেমাঙ্গ বিশ্বাসের প্রসঙ্গে সলিল বলেন যে, প্রচলিত লোকসংগীতে উনি কথা বসিয়েছেন, ‘বলতে পারবে না যে এটা হেমাঙ্গদার নিজস্ব সৃষ্ট সুর’ (পৃ. ৪৬৩)। হেমাঙ্গর মৌলিক সৃষ্টি হিসেবে একটি গানের উল্লেখই যথেষ্ট: ‘শঙ্খচিলের গান’। রবীন্দ্রনাথই তাঁর মূল প্রেরণা— এ কথা সলিল একাধিক জায়গায় বললেও, উপরোক্ত ওই সাক্ষাৎকারেই চট্জলদি মন্তব্য করেন: ‘রবীন্দ্রনাথের মতো আমি রুপোর চামচে মুখে নিয়ে জন্মাইনি’ (পৃ. ৪৭৪)— এ সলিলকে মানায় না। একটি সাক্ষাৎকারে লতার বাংলা আধুনিক গানের প্রথম রেকর্ড হিসেবে উল্লেখ করেন ‘না যেয়ো না’ (পৃ. ৪৩২)। লতার প্রথম বেসিক পবিত্র মিত্রের কথায় সতীনাথ মুখোপাধ্যায়ের সুরে ‘আকাশ প্রদীপ জ্বলে’ ও ‘কত নিশি গেছে’, ১৯৫৭-তে। ‘অনুষ্টুপ’ (১৪০৩)-এ প্রকাশিত অনুরাধা রায়ের নেওয়া সাক্ষাৎকারটি এখানে যথাযথ মুদ্রিত হয়নি। শুরুতে সলিলের কিছু কথা ছিল, যা বাদ পড়েছে। প্রবন্ধ হিসেবে মুদ্রিত ‘আমি রাগের ঠাট’, ‘জর্জদার জন্য গান গেয়েছিলেন হেমন্তদা’ কিংবা ‘আমি হেমন্ত আর গণনাট্যের সেই দিনগুলি এবং কিছু স্মৃতি’ স্মৃতিচারণ অংশে থাকলে ঠিক হত। ‘সাক্ষাৎকার’ অংশে মুদ্রিত দেবাশিস দাশগুপ্তের ‘ঝড়ের ঠিকানা’ আদৌ কোনও সাক্ষাৎকার নয়, একটি সাংগীতিক মূল্যায়ন।

সলিল একসময় কিছু নাটক ও গল্প লিখেছিলেন, যার মধ্যে তাঁর সৃষ্টিশীলতা ও সমাজ সচেতনতার পরিচয় মেলে। নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় ঠিকই লিখেছিলেন: ‘...‘ড্রেসিং টেবিল’ নামে... অসাধারণ গল্পটির লেখক সলিল চৌধুরীকে বাংলা কথাসাহিত্য হারিয়েছে।’ সলিলের ‘জীবন উজ্জীবন’ নামে প্রকাশিত অসম্পূর্ণ আত্মজীবনীটি সুরচিত। দু-একটি ব্যক্তিগত ঘটনার সাহসী উন্মোচন বিস্মিত করে।

এক যুগন্ধর স্রষ্টা ও বাংলা গানের এক সুবর্ণ সময়কে যেন ছোঁয়া যায় বই দুটির মধ্য দিয়ে। এ বার সলিলের গানের স্বরলিপি প্রকাশে সকলে একটু উদ্‌যোগ নিন না!

আরও পড়ুন
Advertisement