ওরা তিনজন একই সঙ্গে প্রদর্শনী করেন বরাবর। কিন্তু তাঁদের ঐক্যবদ্ধতাকে কোনও দলগত নামে অভিহিত করেননি কখনও। প্রদীপ চৌধুরী, প্রদীপ মজুমদার ও চিন্ময় চক্রবর্তী। তিনজনই বিভিন্ন পেশায় যুক্ত এবং নিজস্ব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত। ছবির প্রতি আকর্ষণই তাঁদের ঐক্যবদ্ধ করেছে। কোনও প্রাতিষ্ঠানিক শিল্পশিক্ষা নেই কারওই। এই জীবন ও প্রবহমান শিল্প পরম্পরাই তাঁদের অনুপ্রাণিত করেছে। তাঁদের প্রকাশভঙ্গিতে প্রাথমিক কিছু মিলও আছে। তিনজনেরই ঝোঁক নিরবয়ব ছবির দিকে। কিন্তু উৎসে আছে এই জীবন ও প্রকৃতি। এরই রূপান্তরণের মধ্য দিয়ে তাঁরা ছবির প্রাণকেন্দ্রটিকে ছুঁতে চান। স্ট্রাকচার নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা আছে তিনজনের ছবিতে। আছে সুস্থিত ধ্রুপদী বোধকে অনুধাবনের প্রয়াস। এ রকম দু-একটি ঐক্যবিন্দু থেকে তাঁরা তিনজন রূপের তিনটি স্বতন্ত্র ধারায় নিজেদের প্রকাশ করেন।
মরিস ডেনিস (১৮৭০-১৯৪৩) ছিলেন পোস্ট-ইম্প্রেশনিস্ট যুগের প্রখ্যাত একজন ফরাসি শিল্পী। চিত্রগঠনের একটি সংজ্ঞা দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, একটি নির্দিষ্ট পরিসরকে রং ও রেখায় ভরিয়ে তুলে নান্দনিক ভারসাম্যে সুস্থিত করা, এই হল একটি ছবি গড়ে তোলার পরম লক্ষ্য। আখ্যান, নাটকীয়তা, জীবনদর্শন— এ সব আসে পরে- রচনার ওই নান্দনিক সংহতির ভিত্তির উপর। প্রকৃতি-নিরপেক্ষ বিমূর্ত ছবিতে বিশ্বাস করতেন না পিকাসো। আমাদের দেশে হুসেনও চাননি অবয়ব থেকে সম্পূর্ণ মুক্তি। তবু অবয়ব ভাঙতে ভাঙতে একদিন চেনার সীমার বাইরে চলে গেল। ১৯১০ সালে ক্যানদিনস্কি অবয়ব-বিযুক্ত যে ছবি শুরু করেছিলেন, পরবর্তী শতাধিক বছরে তা নানা ধারা উপধারায় বিকশিত হচ্ছে। প্রকৃতিকে সুপ্ত রেখে রেখায় বা রেখাবিহীন বর্ণে শিল্পী তাঁর আবেগকে উৎসারিত করেছেন। আবার আবেগকে সংবৃত করে জ্যামিতিক নৈর্ব্যক্তিকতায় দৃশ্যতার স্বতন্ত্র দর্শন তৈরি করেছেন। আমাদের দেশে বিমূর্ততার শিল্পীদের মধ্যে এই দুটি অভিমুখের এক দিকে রয়েছেন গাইতোন্ডে ও রামকুমার, অন্য দিকে এস এইচ রাজা ও নাসরিন মোহামোদি। সোমনাথ হোরের সাদার উপর সাদা পাল্পপ্রিন্ট ‘ক্ষত’-র বিমূর্ত প্রতীক হয়ে ওঠে। অন্য দিকে প্রকৃতির ছন্দিত স্পন্দনেরই বিমূর্ত ভাষ্য গড়ে তোলেন গণেশ হালুই।
আলোচ্য প্রদর্শনীতে তিনজন শিল্পীর যে বিমূর্ততা তাতে প্রকৃতির স্পন্দন রয়েছে পরিপূর্ণ মাত্রায়। জীবনের প্রতি দায়বোধও আছে। আবেগ ও নিরাবেগ মননের ভারসাম্য তৈরির চেষ্টা করেছেন তিনজন তিন ভাবে।
প্রদীপ চৌধুরীর ছবিতে প্রকৃতির কিছু অবশেষ সব সময়ই থেকেছে। কিন্তু তাকে চেনা সীমার বাইরে নিয়ে গেছেন। ‘ফ্লোটিং ইয়েলো’ ছবিতে সূর্যাস্তের রক্তিম আবহে ভাসছে যে ভাঙা চাঁদের মতো অর্ধবৃত্তাকার প্রতিমাকল্প, তা হয়ে ওঠে নিসর্গেরই অসংজ্ঞায়িত স্মারক। ‘ব্রোকেন পিসেস অফ এ উডেন হর্স’ ছবিতে সৌন্দর্যের সঙ্গে ধ্বংস বা বিপর্যয়ের যেন এক নীরব সংলাপ এখানে।
শিল্পী: প্রদীপ মজুমদার
প্রদীপ মজুমদারের কিছু ছবিতে নিসর্গের অবশেষ আছে। বুনোটের কারুকাজে তার অন্তনির্হিত জ্যামিতিটিকে বের করে আনতে চান তিনি। ক্রমে এই নিসর্গের আভাস বিলুপ্ত হয়ে তার জ্যামিতিক টানাপড়েনই প্রাধান্য পেতে থাকে। এই ভাবে আবার তিনি আলোর উদ্ভাসের দিকেও চলে যান। একটি ছবিতে দেখা যাচ্ছে হলুদ আর কমলা আলোর বিচ্ছুরিত সংলাপ। তার মধ্যেই কিছু সংবৃত জ্যামিতিক পরিসরের আভাস প্রকৃতি মুগ্ধতার এক বিমূর্ত ভাষা যেন তৈরি করতে চেয়েছেন শিল্পী।
চিন্ময় চক্রবর্তীর বিমূর্ততাও প্রকৃতি থেকেই রূপান্তরিত। কিন্তু পূর্বোক্ত দুজনের তুলনায় প্রকৃতির অবশেষ অনেকটাই বিলুপ্ত হয়েছে তাঁর ছবিতে। অভিব্যক্তি ও গাঠনিকতার মেলবন্ধন ঘটেছে তাঁর রচনায়। আবেগ আর নৈর্বক্তিক নিরাবেগের মধ্যে ভারসাম্য স্থাপনের চেষ্টা করেছেন। সেখান থেকেই উৎসারিত হয়েছে কিছু সমস্যা। মগ্নতা থেকে বিচ্যুত হয়েছেন। ফলে একক প্রতিমাকল্পগুলো পরস্পরের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছে। বিমূর্ত ছবিতে এই সূক্ষ্ম ব্যঞ্জনাগুণে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।