প্যারিস প্রবাসী এই বাংলার শিল্পী শক্তি বর্মন ৮০ বছর বয়সে পদার্পণ করলেন। সে উপলক্ষে শিল্পীর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য কলকাতার অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টসের উদ্যোগে অ্যাকাডেমির সব কটি গ্যালারি জুড়ে সম্প্রতি আয়োজিত হল তাঁর ছবি ও ভাস্কর্যের বিরাট প্রদর্শনী। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অ্যাকাডেমি কর্তৃপক্ষ জানিয়েছিলেন এই প্রদর্শনীর সুচারু উপস্থাপনার জন্য শিল্পীর ইচ্ছাক্রমে আলোর ব্যবস্থা সহ গ্যালারির সামগ্রিক পরিস্থিতির আমূল সংস্কার করা হয়েছে। এবং এটা সম্ভব হয়েছে শিল্পীরই আর্থিক অনুদানে। এজন্য সেদিন ভিড়ে উপচে পড়া উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সমস্ত দর্শক শিল্পীর প্রতি অকুণ্ঠ কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন।
শক্তি বর্মনের কাজে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য ধ্রুপদী মনন ও শৈলীর অসামান্য সমন্বয় দেখা যায়। এক দিকে অজন্তার আলোকিত আদর্শায়িত রূপের তাণ্ডব বৈভব আর এক দিকে ইতালির ফ্রেসকোর পার্থিব অথচ অলৌকিক সৌন্দযর্, ফরাসি শিল্প আদর্শের সূক্ষাতিসূক্ষ্ম ব্যঞ্জনা--বিশ্বের দুই প্রান্তের শৈল্পিক তন্ময়তা সমন্বিত হয়েছে তাঁর কাজে। ১৯৬০-এর দশকে প্রতিষ্ঠা-প্রাপ্ত শিল্পী তিনি। এই বাংলায় ষাটের দশকের শিল্পীদের মধ্যে এই সমন্বয় প্রবণতা খুবই স্বাভাবিক ছিল। তবে অন্যান্য অনেক শিল্পী যখন জোর দিয়েছেন সমাজ বাস্তবতার উপর, প্রতিবাদী চেতনার উপর, শক্তি বর্মন তখন বাস্তবকে রূপকথায় রূপান্তরিত করে সন্ধান করেছেন চেতনার উত্তরণের অলৌকিক আলো। বাস্তবের ভাঙন ও শূন্যতাকে অতিক্রম করে জীবন যে পূর্ণতার সন্ধান করে, তারই ধ্যানে মগ্ন থাকতে চেয়েছেন এই শিল্পী। সামগ্রিক ক্ষয় ও সংকীর্ণতার বিরুদ্ধে এটাকেই বলা যায় তাঁর আত্মগত প্রতিবাদ।
শক্তি বর্মনের ছবি অবয়বী। নিপুণভাবে আদর্শায়িত স্বাভাবিকতাবাদী। ভারতীয় পৌরাণিক আখ্যানের মধ্যে তাঁর অনায়াস সঞ্চরণ। সেই আখ্যানের সঙ্গে অসামান্য ঋদ্ধতায় তিনি মিলিয়ে নেন পাশ্চাত্যের পুরাণকল্পকে। ‘নোয়ার আর্ক’ তাঁর অনেক ছবিতেই বিশেষ এক প্রতীক বা ‘মোটিফ’ হিসেবে উঠে এসেছে। পাশাপাশি আমাদের দেশের দুর্গা, লক্ষ্মী, সরস্বতী, গণেশকেও তিনি শ্রদ্ধা ও প্রীতিতে দৈনন্দিনতার সঙ্গে মিলিয়ে নিয়েছেন। অনেক সময়ই তাঁর রচনা হয়ে ওঠে আত্মজৈবনিক। তাঁর নিজের উপস্থিতি যেমন শনাক্ত করা যায়, তেমনি চিনে নেওয়া যায় তাঁর পারিবারিক মানুষজন ও পরিবেশকেও। এই বাস্তবকেই তিনি পুরাণকল্পে উন্নীত করেন, আবার পুরাণকল্পকে বিন্যস্ত করে দেন জীবনের ভূমিতে। স্বর্গকে এই যে মর্তের সঙ্গে, জীবনের সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়া, এটাই তাঁর শিল্পসিদ্ধির প্রধান এক মাত্রা। এ জীবন নষ্ট হয়ে যাওয়ার জন্য নয়, আঁধার লিপ্ততা এর একমাত্র পরিণাম নয়। এর বাইরেও রয়ে গেছে সার্থকতার অনন্য সম্ভাবনা। এই বাণীই তাঁর সুদীর্ঘ ৬০ বছরের শিল্পীজীবনে তিনি ধীরে ধীরে উন্মীলিত করেছেন।
এই প্রদর্শনীতে তাঁর প্রথম জীবনের কিছু ছবি ছিল। কলকাতার গভর্নমেন্ট আর্ট কলেজ থেকে পাশ করার পর তিনি প্যারিসে যান। তখন পাশ্চাত্য চিত্র আঙ্গিককে যে সহজ ছন্দে আয়ত্ত করতে চেষ্টা করেছেন, তাঁর কিছু দৃষ্টান্ত আজও আমাদের মুগ্ধ করে। উল্লেখ করতে হয় ১৯৫৯-এর তেলরঙে আঁকা ‘লেডি উইথ মিরর’ ও ১৯৬৭-র ‘ফ্লুটিস্ট’ ছবি দুটি। তাঁর পরবর্তী রূপ ও প্রকরণ বিন্যাসের সম্ভাবনা ধীরে ধীরে উন্মীলিত হয়েছে এই পর্যায় থেকে।
বর্ণের বহুমাত্রিক বিচ্ছুরণ তাঁর প্রকরণের একটি অবিচ্ছেদ্য বৈশিষ্ট্য। দ্বিতীয় ছবিটিতে এর প্রাথমিক পদপাত দেখতে পাই আমরা। তবে এই প্রদর্শনীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক তাঁর ভাস্কর্য। ছবির ভিতর তার যে বিশ্বদৃষ্টি উন্মোচিত হয়েছে এরই ত্রিমাত্রিক রূপ। ‘সেট আউট টুওয়ার্ডস দ্য স্কাই’ বিশেষ উল্লেখযোগ্য। এক মানবী দাঁড়িয়ে আছে। তাঁর মাথার উপরে শঙ্খের শিরস্ত্রাণ। সেই শঙ্খের উপর পক্ষীরূপা আর এক মানবী। তার পিঠের উপর এক হাতের ভর রেখে পা-দুটি উপরের দিকে তুলে সার্কাসে খেলা দেখানোর ভঙ্গিতে অবস্থান করছে যেন কোন বিদূষক। তার পায়ের উপর উপবিষ্ট একটি বানর বা হনুমান। তার মাথার উপর বসে থাকা পাখিটি আকাশের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। জীবন এভাবেই উঠে যাচ্ছে পৃথিবী থেকে আকাশের দিকে। লৌকিক ভূমিতে দাঁড়িয়ে অলৌকিকের জন্য এই অভীপ্সাই তাঁর সৃষ্টির বৈশিষ্ট্য।