পুস্তক পরিচয় ২

নবির জীবনের ঘটনা নিয়ে সুলিখিত কাহিনি

দেশজ মুসলমান তার পূর্বপুরুষের সব রকম বিশ্বাস-সংস্কার আচার-আচরণ পরিহার করার পরে যে সাংস্কৃতিক জীবন বরণ করে নেয় তাকে আহমদ শরীফ বলেছেন ‘মানস-প্রবাস’।

Advertisement
মিলন দত্ত
শেষ আপডেট: ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ০০:০০
তখন মাক্কা-মাদীনায়। আবদুল আযীয আল আমান। হরফ প্রকাশনী, ৩৫০.০০

তখন মাক্কা-মাদীনায়। আবদুল আযীয আল আমান। হরফ প্রকাশনী, ৩৫০.০০

দেশজ মুসলমান তার পূর্বপুরুষের সব রকম বিশ্বাস-সংস্কার আচার-আচরণ পরিহার করার পরে যে সাংস্কৃতিক জীবন বরণ করে নেয় তাকে আহমদ শরীফ বলেছেন ‘মানস-প্রবাস’। বলেছেন, ‘বাঙালি মুসলিমরা বিদেশী ধর্ম বরণ করে স্বদেশেই মানস-প্রবাস অনুভব করেছে।’ বাঙালি মুসলমান সেই মানস-প্রবাস কাটিয়ে পুরোপুরি স্বদেশ প্রত্যাগমন করতে পেরেছে, তা জোর দিয়ে বলা যাবে না। বিশ্বে যিনি ইসলাম প্রতিষ্ঠা করেছেন সেই মুহাম্মদের যাপিত জীবন থেকে শিক্ষা নিলে বাঙালি মুসলমানকে বোধহয় এই সংকটের মধ্যে পড়তে হত না। ইসলাম প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে আল্লার রসুল কিন্তু আরবের ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতি ত্যাগ করেননি। তিনি বরং আরব ঐতিহ্যের প্রতি একশো শতাংশ শ্রদ্ধাবান ছিলেন।

মুহাম্মদের মৃত্যুর পরে বহু দিন পর্যন্ত আরবি ভাষা ও সংস্কৃতি ছিল ইসলামের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য। ইসলামের আদিপর্বে মুসলিমরা বৃহত্তর আরবের কোনও ভূখণ্ড হোক বা উত্তর আফ্রিকার কোনও দেশ দখল করে ইসলামের সঙ্গে আরবি ভাষা এবং সংস্কৃতিকেও সে দেশে প্রতিষ্ঠা করেছে। বাংলায় ইসলাম এসেছে আরও পরে, সেখানে তেমন কিছু হয়নি। তবু বাঙালি মুসলমানের ‘মানস-প্রবাস’ ঘটেছে। সে ইসলামের সঙ্গে আরব-ইরানেও সমর্পিতচিত্ত থেকেছে।

Advertisement

বাঙালি মুসলমানের মধ্যে যখন শিক্ষা এবং মননের চর্চা শুরু হল তখন আরবি-ফার্সি লাঞ্ছিত বাংলা ভাষায় বিস্তর ধর্মচর্চা করলেও শিশুতোষ কোনও পাঠ সে সন্তানের হাতে তুলে দিতে পারেনি। বাংলার ঐতিহ্য, সংস্কৃতি বা তার মাটি থেকে আহরণ করা কোনও কিছু শিশুকে দেওয়া যায়নি। ভীতিপ্রদ জাহান্নাম আর জান্নাতের বর্ণনা ছাড়া বিশেষ কিছু তার ধর্মীয় সংস্কৃতির কাছ থেকে সে পায়নি। আর পেয়েছিল কিছু ‌পারসিক কাহিনি। এই সাংস্কৃতিক সঙ্কটের মধ্যে দিয়েই বিশ্বাসী মুসলমানকে আজও যেতে হয়। মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ১৩২৩ বঙ্গাব্দে লিখেছিলেন, ‘মক্তবে ও মুসলমান বালিকা বিদ্যালয়েও আমাদিগের শিশুগণকে হিন্দুর লিখিত পুস্তক পড়িতে হয়, তদপেক্ষা আর কি কলঙ্কের কথা আছে? আমরা কি এতই মূর্খ যে তাহাদের জন্য পুস্তক রচনা করিতে পারি না?’ তাঁর মতে, ‘এখান হইতেই তাহার সর্বনাশের বীজ বপিত হয়।’

কিছু চেষ্টা হয়েছে, কিন্তু তা টেকসই হয়নি। এমনকী মীর মোশাররফ হোসেন এই ‘সর্বনাশ’ থেকে সমাজকে বাঁচাতে মুসলমান শিশুর জন্য দু’খণ্ডে প্রাইমার রচনা করেছিলেন। মান অত্যন্ত দুর্বল হলেও সেই ধারায় আজও মুসলমান শিশুর জন্য কিছু কিছু প্রাইমার তৈরি হয়। তবে মুসলমান সমাজে শিশুশিক্ষার মূল ধারায় তা পৌঁছতে পারে না। সাহিত্যের দিক থেকেও তা নিম্ন মানের। আবদুল আযীয আল আমানের এই বইটি সে দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ। নবির জীবনের নানা ঘটনা নিয়ে লেখক রচনা করেছেন ৯৪টি গল্প। গল্পগুলি সুলিখিত, সুপাঠ্য এবং এমন একটি গদ্য ভাষার সাহায্য তিনি নিয়েছেন যে প্রত্যেকটি কাহিনিই পড়তে হয় মুগ্ধ হয়ে। তাঁর গদ্যের গুণেই সপ্তম শতকের আরবে আল্লার রসুলের জীবন থেকে নেওয়া গল্পগুলো বাংলার রসে সিঞ্চিত হয়ে ওঠে। সিরাত সাহিত্যের ধারায় এ বই অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য সংযোজন। নবির জীবন নিয়ে রচিত সাহিত্যই মূলত ‘সিরাত সাহিত্য’। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে সিরাত সাহিত্যের তেমন উল্লেখ অবশ্য নেই। সাহিত্য গুণে অনেক সময় না উতরোলেও বাংলায় সিরাত সাহিত্যের তালিকা খুব ছোট নয়।

রৌদ্রদগ্ধ মরুভূমির বর্ণনা করতে গিয়ে আবদুল আযীয লিখছেন, ‘নীল আকাশ বেয়ে সূর্য উপরে ওঠে। মরুর বালু তীক্ষ্ণ হয়। তপ্ত হয়। খড়পোড়া ভাপের মত ওপরটা লকলক করে।’ মরুভূমির দাবদাহের সঙ্গে বাঙালি পাঠকের পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য ‘খড়পোড়া ভাপ’-এর চেয়ে উত্তম চিত্রকল্প আর কীই বা হতে পারে। কাহিনিতে আছে মুহাম্মদের জীবনের নানা ঘটনা, উপদেশ আর পরামর্শ। এগুলি আহরণ করা হয়েছে হাদিস থেকে। সবকটি গল্পই এক ধরনের নীতিকথা। এ ছাড়া নবির মানবিক গুণে মুগ্ধ হয়ে ইসলামে দীক্ষা নেওয়ার কাহিনিও রয়েছে কয়েকটি।

হাদিস হল মুহাম্মদের নথিভুক্ত আদেশ, নির্দেশ, কথা ও কাজ। রসুলের মৃত্যুর প্রায় একশো বছর পর থেকে হাদিস সংকলনের কাজ শুরু হয়। প্রায় আড়াইশো বছর ধরে তা সংকলিত হয়েছে। নবির যাঁরা সঙ্গী বা তাঁকে যাঁরা দেখেছেন তাঁদের প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ সূত্র যোগ করে হাদিস সংকলিত হয়েছে। কোরানের অনেক আয়াতের ব্যাখ্যা করতে হাদিসের শরণাপন্ন হতে হয়। ব্যক্তি মুহাম্মদকে জানার জন্যও হাদিস একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এই হাদিসই আবদুল আযীযের এই গ্রন্থের উৎস।

প্রখ্যাত ‘হরফ প্রকাশনী’র প্রতিষ্ঠাতা আবদুল আযীয আল আমান বাংলা প্রকাশনা জগতে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব। নিষ্ঠাবান মুসলমান আযীয সাহেবের ছিল সব ধর্মের প্রতি সমদৃষ্টি। বেদ, গীতা, ভাগবত, ধম্মপদের অনুবাদ বাঙালির কাছে সুলভ করেছেন তিনি। সম্পাদনা করেছেন সাহিত্য পত্রিকা। গল্প, উপন্যাস এবং কাব্যগ্রন্থের রচয়িতা। এই গ্রন্থটি ১৯৬৯ থেকে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত রচিত তাঁর ছ’টি বইয়ের সংগ্রহ। দেশি, তৎসম এবং আরবি শব্দের সুষম ব্যবহারে তরতরে একটা গদ্য তিনি রচনা করেছেন যা রসুলের জীবনকাহিনি বয়ানের অনবদ্য মাধ্যম হয়ে উঠেছে। ছোট বড় সবার ভাল লাগার মতো। বইয়ের পরিশিষ্ট অংশটি মূল্যবান। কাহিনির সূত্র মূল হাদিসগুলো উদ্ধার করা হয়েছে পরিশিষ্টে। ব্যক্তি মুহাম্মদকে জানতে বইটি দরকারি।

কিন্তু এ বইয়ে বিদেশি শব্দে বাংলা বানান বিধির কোনও শর্তই মানা হয়নি। উলটে লেখকের পুত্র মুনীর বইয়ের ভূমিকায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন, ‘প্রথম শ্রেণীর দৈনিকগুলিতে প্রায়শই দেখা যায় উর্দু-আরবি-ফার্সি শব্দের বানানের বিকার— ‘নামায’কে ‘নমাজ’, ‘হাজরাত মুহাম্মাদ’কে ‘হজরত মহম্মদ’, ‘মুহাররাম’কে ‘মহরম’।’ বানানবিধি অগ্রাহ্য করে ইসলামি শব্দে এমনিতেই ‘ঈ’ এবং ‘ঊ’-র ছড়াছড়ি, ইসলামি শব্দের উচ্চারণও আজ পর্যন্ত প্রমিতকরণের চেষ্টা হয়নি। নবির নামেরও নানা রকম উচ্চারণ এবং বানান— মহম্মদ, মুহম্মদ, মুহাম্মদ, মাহাম্মদ, মোহম্মদ, মোহাম্মদ ইত্যাদি। ইসলামি শব্দের প্রমিতকরণ প্রয়োজন। কে নেবে সেই দায়িত্ব!

আরও পড়ুন
Advertisement