পুস্তক পরিচয় ১

জোড়াতালি দেওয়া অপরূপ বিচিত্র গালিচা

হি ন্দুদের দেবদেবী অগুনতি, তাঁদের চেহারা বহুবিচিত্র। মানুষ আর পশুর অবয়বের সন্ধিতে, ভয় ও বরাভয়ের যুগলসম্মিলনে সেই সব বিগ্রহ ভক্তের চোখে বিমূর্ত আধ্যাত্মিক কল্পনার ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য রূপ হতে পারে, কিন্তু ভিন সংস্কৃতির অধিবাসীদের কাছে তা প্রায়শ দুর্বোধ্য, এমনকী ভয়াবহ ঠেকে।

Advertisement
স্বপন চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ০০:০০
দ্য কলিফ্লাওয়ার, নিকোলা বার্কার। উইলিয়াম হাইনেমান, ১৬.৯৯ পাউন্ড

দ্য কলিফ্লাওয়ার, নিকোলা বার্কার। উইলিয়াম হাইনেমান, ১৬.৯৯ পাউন্ড

হিন্দুদের দেবদেবী অগুনতি, তাঁদের চেহারা বহুবিচিত্র। মানুষ আর পশুর অবয়বের সন্ধিতে, ভয় ও বরাভয়ের যুগলসম্মিলনে সেই সব বিগ্রহ ভক্তের চোখে বিমূর্ত আধ্যাত্মিক কল্পনার ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য রূপ হতে পারে, কিন্তু ভিন সংস্কৃতির অধিবাসীদের কাছে তা প্রায়শ দুর্বোধ্য, এমনকী ভয়াবহ ঠেকে। ধ্রুপদী গ্রিক ভাস্কর্যের অনুরাগী দার্শনিক হেগেল মনে করেছিলেন যে, হিন্দুরা নৈসর্গিক ও আধ্যাত্মিকের মধ্যে খানিকটা ফারাক করতে পেরেছিল, তবে পুরোটা নয়। নৈসর্গিক আদলগুলিকে অতিরঞ্জিত করে, হয়তো বা বিকৃত করে, হিন্দু মূর্তিকার জড় জিনিসে দেবত্ব আরোপ করতে সমর্থ হয়েছিল, এই পর্যন্ত।

১৮১৮ সাল থেকে প্রদত্ত শিল্পতত্ত্ব নিয়ে হেগেলের বক্তৃতামালা অনুলিখিত হয়ে প্রকাশিত হয় ১৮৩৫ সালে। তার ঠিক পরের বছর ফেব্রুয়ারি মাসে কামারপুকুর গ্রামে জন্ম হয় রামকৃষ্ণ পরমহংসের। আর ১৮৫৫ সালে দক্ষিণেশ্বরে ভবতারিণী কালিকার মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন রাসমণি, আর সেখানে পূজারি দাদার সহকারী হয়ে আসেন ভাই গদাধর ও ভাগ্নে হৃদয়রাম। এই দুই চরিত্র ধরে রাখেন উপন্যাসের সতত কেন্দ্রছুট আখ্যান।

Advertisement

দেবদেবীদের মধ্যে আবার কালীমূর্তির রহস্য রীতিমত গহন। ‘মাণ্ডূক্য উপনিষদ’-এ বর্ণিত অগ্নির সপ্তজিহ্বার মধ্যে কালী একটি। ‘দেবীমাহাত্ম্য’ ও ‘স্কন্দ পুরাণ’-এ তিনি চণ্ড-মুণ্ড-বিনাশিনী চামুণ্ডা, রক্তবীজ সংহারকর্ত্রী শোণিতপিপাসু ভয়াল শক্তি। কালীকে বেষ্টন করে থাকে কালের অনুষঙ্গ— ধ্বংস, রক্ত, করোটি, শ্মশান। একই সঙ্গে তিনি মহাকালের গুহ্য প্রজ্ঞার আধার। তাঁর মালার একান্নটি নৃমুণ্ড হল সংস্কৃত ভাষার একান্নটি বর্ণের প্রতীক, তাঁর হস্তের মেখলা ঐহিক কর্মের কর্তিত চিহ্ন, মানুষের অন্ধ অহং পরাভূত করে তাঁর খড়্গ, ঠিক বজ্রযানী কল্পনায় বোধিসত্ত্ব মঞ্জুশ্রীর তরবারির মতো। সৃষ্টি ছারখার করতে উদ্যত জঙ্গম মহাশক্তিকে নিরস্ত করছেন শবাসনে নিশ্চল সদাশিব— স্থিতি গতির এই বিপরীত রতির তাৎপর্য হজম করা মহামতি হেগেলের কম্মো ছিল না, বলা বোধ করি বাহুল্য।

ধ্রুপদী আর্টের যিনি দ্রষ্টা, তিনি চেতনাকে যেমন নিসর্গ থেকে তফাতে রাখেন, শিল্পবস্তুকে দেখেন অখণ্ড সমঞ্জস এক নির্মাণ হিসাবে, ঠিক তেমনই শিল্পী নিজে খানিকটা ছাড়িয়ে নেন দিনযাপনের এলোমেলো অভিজ্ঞতার পাক থেকে। এ কারণে ফরাসি দার্শনিক মের্লো পঁতি ধ্রুপদী শিল্পের চাইতে ইম্প্রেশনিস্ট বর্ণশিল্পীদের পছন্দ করতেন বেশি, সেজানের ছবিতে রঙ ও রেখার টানাপড়েনের মধ্যে আঁকাড়া অভিজ্ঞতার জানান টের পেতেন তিনি।

সামাজিক আচরণে কঠোর ও গুহ্য সাধনায় কঠোর, জড় প্রয়োজন ও লোকরীতি সম্পর্কে বিচক্ষণ অথচ ইন্দ্রিয়সুখে নিস্পৃহ, জ্ঞানমার্গবিমুখ তথাপি প্রজ্ঞাবান, পরমহংসের জীবন নিয়ে উপন্যাস লিখতে বসলে ধ্রুপদী ঔচিত্য অগোছালো হয়ে পড়ার বিপদই বেশি। বরঞ্চ এ কাজে ভারতীয় রসশাস্ত্রের আটটি রসের কোনওটিকেই বাদ দেওয়া চলবে না, বীভৎস রসও নয়, লেখক দেনওনি। বরঞ্চ অনুবর্তী ভাষ্যকারদের জুড়ে দেওয়া শান্ত, ভক্তি ও বাৎসল্য রসেরও শরণ নিয়েছেন। আখ্যানটির তাই কোনও পাকা বসত নেই; নায়কের আস্তিক্য এক পরম আশ্রয় হলেও তাঁর জীবনবৃত্তান্ত বাধ্যত নিরাশ্রয়। নিকোলা বার্কার ভারতীয় নন, তিনি এ যাবৎ ভারতবর্ষে পা রাখেননি। তাঁর তথ্যসূত্র ‘কথামৃত’ ছাড়াও স্বামী সারদানন্দ, স্বামী চেতনানন্দ, লেক্স হিক্সন, ক্রিস্টোফার ইশারউড, এলিজাবেথ হার্ডিং প্রমুখের রামকৃষ্ণ ও দক্ষিণেশ্বর মন্দির সম্পর্কিত নানা ইংরেজি বই।

হালের উপন্যাসের আপাত-অসংলগ্ন, বহুরৈখিক বৃত্তান্ত এই সূত্রগুলির মধ্যেই মজুত ছিল। কোথাও টুকরো-টুকরো কাহিনি, সংলাপ ও মঞ্চ নির্দেশ, কোথাও ‘কথামৃত’, কোথাও রামপ্রসাদ, কোথাও ডিকেন্স থেকে উদ্ধৃতি, কখনও বা গান ও হাইকু, কখনও নেপথ্যে ব্রামসের চার নম্বর সিম্ফনি কখনও সলোমনের পরমগীতের পংক্তি— এ সমস্ত জুড়ে-ফুঁড়ে ঔপন্যাসিক রচনা করেছেন এক রহস্যময় ‘পাসটিস’, জোড়াতালি দেওয়া এক অপরূপ বিচিত্র অথচ সাহিত্যতত্ত্বের অর্থে ‘কমিক’ গালিচা। এর দু’দিক যেন আগলে রেখেছে প্রথম পর্বে ভাগ্নে হৃদয়রামের সতর্ক যত্ন তথা উত্তমপুরুষে বিবৃত কথা, দ্বিতীয় পর্বে নরেন্দ্রনাথ ও গুরুভাইদের অবিশ্বাস থেকে শিষ্যত্বে উত্তরণ। প্রথম পর্বে গদাধরের ক্রমিক সাধনা, ভক্তি, বেদান্ত, তন্ত্রে দীক্ষা; দ্বিতীয় পর্বে ঈশ্বরোপলব্ধির চরম পর্যায়ে উপনতি। ঘটনাবলি বেশির ভাগ সূত্রগ্রন্থ থেকে নেওয়া, যদিও দু’চারটি ক্ষেত্রে ঔপন্যাসিক তাঁর হকের চালটি চেলে বানিয়ে গল্প ফেঁদেছেন। একটি জায়গায় লওরা বার্থোলোমিউ নামের এক পত্রলেখিকা দক্ষিণেশ্বর দর্শনের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছে। ‘লওরা’ শব্দটি এসেছে ‘লউরেল’ থেকে, নামটিতে রয়েছে পুরস্কৃত বিজেতার আভাস। ছল-চিঠি শেষ হচ্ছে ‘অথার’ শব্দটির মানে নিয়ে কয়েকটি প্রশ্নে। তিনি কি ‘কোলাজিস্ট’? স্থপতি? ‘কলোনাইজার’? ‘প্লেজিয়ারাইজার’? গল্প (‘ফিকশান’) নির্মাতা? হয়তো এ সবই। হঠাৎ খেয়াল হয় লেখকের নিজের নাম এসেছে গ্রিক ‘নিকস’ মূলটি থেকে, যার অর্থ জয়। ‘নিকোলা’ লাতিন ভাষায় লোকজয়ী বোঝাতে ব্যবহার করা হয়। চিঠিটি আবার ছাপা হয়েছে হাতের লেখার আদলে। হরফের চেহারার শব্দার্থগত সংকেত ব্যবহার করা হয়েছে বইয়ের অন্যত্র, প্রয়োজনে শব্দের বদলে ছাপা হয়েছে মোবাইল ফোনের টেক্সটের চিত্রসংকেত বা ইমোটিকন।

আখ্যানের বিন্যাস পূর্বাপর মেনে সাজানো হয়নি, আগেই বলেছি। কলকাতার জোব চার্নক থেকে কলকাতার মা (এখন সন্ত) টেরিজা, সতেরো শতক থেকে বিশ শতক, ১৮৩৬-এ দ্বারকানাথ ঠাকুরের সঙ্গে রাসমণির সাক্ষাতের কৌতুকপ্রদ বৃত্তান্ত থেকে ১৯৬০ নাগাদ এক মার্কিন রূপান্তরকামীর গভীর ঈশ্বরোপলব্ধি— ইতিহাসের খোলা অলিন্দে অবাধে চরে বেড়িয়েছে কাহিনি তার আপন যুক্তির বেগে। ‘যুক্তি’ শব্দটি ব্যবহার করলাম ভেবেচিন্তে, যুক্তির জোর আর ‘যুক্তিবাদ’-এর জবরদস্তি এক জিনিস নয়, এই বিচারে।

দুটি প্রসঙ্গের উল্লেখ এক্ষুনি করেছি— কালের বিন্যাস ও লিঙ্গ-পরিচয়ের ভূমিকা। সময়ের ফোকর দিয়ে কাহিনির যাওয়া-আসা এক ধরনের বিভ্রম সৃষ্টি করে। কানে শোনা ধ্বনি, চোখে দেখা ছবি, মানসপটে ইতিবৃত্তের পরম্পরার মাঝামাঝি শিল্পবস্তুটির ঠাঁই যেন এক মায়াবী আবছা ভেদরেখায়, যা প্রপঞ্চবাদী দার্শনিক হুসের্ল-এর ভাষায় ‘গ্রেন্‌জহ্বাল’ বা ‘লিমিট কেস’। আঙ্গিকটি রামকৃষ্ণের চেতনার নানান প্রান্তিক ভাবের উপস্থাপনায় দিব্যি কাজে লেগে যায়, তা সে চেনা কলেবর ত্যাগ বা ভাবসমাধি যা-ই হোক না কেন। পাঠকের নজর যেন সেই কলিফ্লাওয়ার (কালী/কলি+ফ্লাওয়ার) ব্র্যান্ডের অতি ক্ষুদ্র ক্যামেরা যা ছোট ঘর বাতাসি পাখির গলায় বেঁধে দিলে আমরা শুধু দক্ষিণেশ্বরের মন্দিরের অভ্যন্তর ও তার হাতায় গজিয়ে ওঠা সব কোঠা-কুটির-নাটমন্দির নয়, ইতিহাসের আপাত ভাবে অনির্দিষ্ট ওড়াউড়িও দেখতে পাব।

লিঙ্গ-পরিচয়ের অনিশ্চয়তাও পাঠকের এই অভিজ্ঞতায় অপরিহার্য। রামকৃষ্ণ তান্ত্রিক ও বৈষ্ণব মার্গ অনুশীলন করেছিলেন। দুটির মধ্যেই দ্বৈতবাদের ভেদচিন্তার নিরসনের সাধনা লক্ষ করেছেন লেখক। পরিণতিতে কালী ও মহাদেবের যুগলমূর্তির মতোই তিনি হয়ে ওঠেন একাধারে ধ্বংস ও সৃষ্টি, প্রকৃতি ও পুরুষ, গতি ও স্থিতি, এবং— বিশ্বাসীর বোধে— মানুষ ও দেবতা। প্রায় হঠাৎই গল্পের এক মোক্ষম জায়গায় চলে আসে খ্রিস্টান সন্ত সারা লা কালি-র কথা। দক্ষিণ ফ্রান্সে মে মাসে তাঁর পরব উপলক্ষে সমাগম হয় তীর্থযাত্রীর, ভারতীয় যাযাবরদের সঙ্গে ইউরোপে আসা এই কৃষ্ণাঙ্গী সন্তের বিসর্জনও হয় কালিকার বিগ্রহের মতো। ‘Who is Black Sara?’ প্রশ্নের উত্তর রয়েছে পরিচ্ছেদের শেষ পঙ্‌ক্তিতে। তিনি আদি ও অন্ত, ‘Sara la Kali is the Pair of Opposites.’ ঘরছুট ইতিবৃত্তের জুটে যায় যাযাবরদের সন্ত, উচ্ছিন্নের আশ্রয়।

ঋগ্‌বেদের দশম মণ্ডলের ১১৪ সংখ্যক সূক্তে বলা হচ্ছে যে, ঋষিরা এক সত্যকে বিবিধ রূপে বন্দনা করে থাকেন। রামকৃষ্ণ সংঘ সংঘগুরুর চিন্তা শঙ্করভাষ্য-নির্ভর অদ্বৈত বেদান্তের পটভূমিতেই ব্যাখ্যা করে থাকে। অথচ আধুনিকতাবাদের শেষ পর্যায়ে এবং আজকের ইউরোপীয় ভাষার উপন্যাস, তা সে আফ্রিকা-এশিয়াতেই লেখা হোক বা দুই আমেরিকায়, কিছুটা উল্টো পথে হাঁটছে। এখন আদি ঐক্যই মায়া, চরাচরব্যাপী নাছোড় অনৈক্যই আসলে দর্শন ও ভাষার প্রাথমিক প্রকল্প। অদ্বৈতের তাগিদ ও বহুধার বেয়াড়া স্রোতের এই সংঘাত কাহিনি নির্মাণে নিপুণ হাতে কাজে লাগিয়েছেন বার্কার, রামকৃষ্ণের জীবনও হয়ে উঠেছে সেই অসমাধ্য ধাঁধার প্রতিরূপ।

হয়তো সেই কারণেই বিলেত ও দক্ষিণ আফ্রিকায় জীবন কাটানো বার্কারের পক্ষে এই উপন্যাস লেখা সহজ হয়েছিল। ভারতীয় লেখক উপন্যাসটি লিখলে সামাজিক জমি আর একটু জমাট হত। বাংলার নবজাগরণ ইত্যাদি দশ-হাত ফেরতা কয়েকটি শব্দবন্ধ থাকলেও গিরিশ ঘোষ, প্রতাপ মজুমদার, কেশব সেন প্রমুখের বিক্ষিপ্ত উল্লেখ ছাড়া আর কিছু শাঁস পাই না। বিদ্যাসাগর, বঙ্কিম, বিনোদিনীর কথা নেই, রবীন্দ্রনাথ তো দূরস্থান। অথচ আমাদের আধুনিক শিল্প-সাহিত্য-ইতিহাস রামকৃষ্ণ নামক বেখাপ্পা আলোড়নটিকে তাদের পরিপাটি বর্গীকৃত খোপগুলিতে ঠিক আঁটাতে পারেনি। অগভীর নাটক, গদগদ পালা আর চলচ্চিত্রে অপচয় হল এত ঠাঁই নাড়িয়ে দেওয়া বিষয়ের।

‘তান্ত্রিক’ জ্যামিতিতে ফুলকপি এঁকে তার কেন্দ্রে কালীর অবয়ব, বোঁটায় রামকৃষ্ণের প্রতিকৃতি এবং ফুলকপির ফুলে ছিন্ন হাত-পা বসিয়ে তৈরি হয়েছে জ্যাকেট। এই কুশ্রী প্রচ্ছদ থেকে বইটিকে যত দ্রুত উদ্ধার করা যায় ততই মঙ্গল।

আরও পড়ুন
Advertisement