বিষাদের গভীরতা ছুঁয়ে যায়

খণ্ডিত বাংলার প্রতীক এক বাংলা মাকে কল্পনা করে নিয়েছিলেন ঋত্বিক, যে মাতৃরূপটি ওঁর ছবিতে আদিমাতার এক রূপকল্প হয়ে ফিরে আসে বার বার। দেশভাগের বেদনার ভাষা কি আজও তৈরি হয়েছে? তবে ঋত্বিকের ছবি নিঃসন্দেহে বিষাদের সেই অতলান্ত গভীরতাকে ছুঁতে পেরেছে অনেক বারই।

Advertisement
তানভীর মোকাম্মেল
শেষ আপডেট: ২০ অগস্ট ২০১৭ ০২:২৯
মাতৃরূপ: ‘মা’র মতোই আবার পালিয়ে যাবি না তো রে দিদি?’ ঋত্বিক ঘটকের ‘সুবর্ণরেখা’ ছবিতে মাধবী মুখোপাধ্যায় ও অভী ভট্টাচার্য

মাতৃরূপ: ‘মা’র মতোই আবার পালিয়ে যাবি না তো রে দিদি?’ ঋত্বিক ঘটকের ‘সুবর্ণরেখা’ ছবিতে মাধবী মুখোপাধ্যায় ও অভী ভট্টাচার্য

ইলিউমিনেটিং অ্যাগনি ঋত্বিক

লেখক: দেবযানী হালদার

Advertisement

৯৯৫.০০

ড্রিমজ মুভিজ অ্যান্ড এন্টারটেনমেন্ট

আত্মধ্বংসী কিছু প্রবণতা ছিল ঋত্বিক ঘটকের মধ্যে। এই সব নিয়ে গালগল্পও কম হয়নি! কিন্তু ঋত্বিক ঘটকের ছবিগুলি নিয়ে গভীর মননশীল আলোচনা সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়, আশিস রাজাধ্যক্ষ এরকম দু’একজন ব্যতিক্রমী গবেষকের কলমে ছাড়া খুব বেশি তেমন চোখে পড়ে না। সম্প্রতি ইংরেজিতে লেখা সে রকম একটি বই ইলিউমিনেটিং অ্যাগনি ঋত্বিক হাতে এল।

একান্ত নিজস্ব এক সিনেমা ভাষা ছিল ঋত্বিকের। ঋত্বিকের ছবি দেখলে মনে হয়, হলিউড বলে যেন কখনও কিছু ছিল না! নাটকীয় সংলাপ, চরিত্রদের মঞ্চ-নাটকীয় শরীরী ভাষা, উচ্চকিত অভিনয়, আপতিক ঘটনার অতিব্যবহার, এসব বৈশিষ্ট্য ওঁর ওপর গণনাট্যের দিনগুলির প্রভাব ছাড়াও যা তুলে ধরে, তা হচ্ছে, পশ্চিমী সিনেমার প্রভাব বলয় থেকে নিজেকে সম্পূর্ণ মুক্ত রেখেছিলেন ঋত্বিক। আবার একই সঙ্গে ইউরো-মার্কিন সিনেমার সর্বশেষ চালচলন সম্পর্কে ঋত্বিকের মতো ওয়াকিবহাল পরিচালকই বা ভারতে ক’জন ছিলেন! ঋত্বিক ঘটক যখন পুনে ফিল্ম ইনস্টিটিউটের শিক্ষক তখন এ ব্যাপারে কুমার সাহনি, মণি কল বা আদুর গোপালকৃষ্ণনের কাছ থেকে শোনা নানা কথা সেই সাক্ষ্য দেয়। পশ্চিমী চলচ্চিত্রভাষাকে পরিহার করা তাই অজ্ঞতাপ্রসূত কিছু ছিল না। ঋত্বিকের দিক থেকে তা ছিল এক সচেতন প্রয়াসই। যাঁরা শিল্প-সংস্কৃতিতে উত্তর-উপনিবেশ বিষয়টি নিয়ে চর্চা করেন, ঋত্বিকের সিনেমা-শৈলীতে চিন্তার অনেক খোরাকই তাঁরা পাবেন। একটা প্রতিতুলনা টানা যায়। কুরোসাওয়া জাপানি, আবার আন্তর্জাতিকও। কিন্তু ওজু একান্তই জাপানি। ওজুকে সঠিক ভাবে বুঝতে জাপানি শিল্প-সংস্কৃতির ঐতিহ্য সম্পর্কে ধারণা থাকতে হয়। ঋত্বিক ঘটকও যেন তেমনই আমাদের একান্তই বাঙালি এক শিল্পী যাঁর বিষয়বস্তু, গল্প বলার ধরন, বাংলা ভাষার নাটকীয় প্রকাশভঙ্গি অনুযায়ী নাটকীয় সংলাপ, বাংলা মঞ্চ-নাটকের ধারায় উচ্চকিত অভিনয়রীতি, এমন কী ওজুর লো ক্যামেরা অ্যাঙ্গেলের মতো নিজের আলাদা ক্যামেরা অ্যাঙ্গেল— ঋত্বিকের ছবির ওয়াইড অ্যাঙ্গেল লেন্সের শটগুলো স্মরণ করুন, এ সবই এক বাঙালি চলচ্চিত্র পরিচালকের একান্ত নিজস্ব চলচ্চিত্রভাষার প্রকাশ। তাই ঋত্বিকের শিল্পউৎসকে খুঁজতে হবে পশ্চিমী চলচ্চিত্রভাষায় নয়, সেটা খুঁজতে হবে বাংলার লোকজ ঐতিহ্য ও শিল্পমাধ্যমগুলির মাঝে, সে বিষয়টির উপর বইটির লেখক খুব সঠিক ভাবেই জোর দিয়েছেন।

খণ্ডিত বাংলার প্রতীক এক বাংলা মাকে কল্পনা করে নিয়েছিলেন ঋত্বিক, যে মাতৃরূপটি ওঁর ছবিতে আদিমাতার এক রূপকল্প হয়ে ফিরে আসে বার বার। মার্কসবাদের পাশাপাশি ইয়ুং-এর যৌথ নিশ্চেতনার ধারণাও ততদিনে ঋত্বিকের বিশ্ববীক্ষায় গভীর ভাবে প্রোথিত হয়ে গিয়েছে। সেই আদিমাতার আবার দুই রূপ। কখনও দেখি তার কল্যাণী জগদ্ধাত্রী রূপ— ‘তিতাস একটি নদীর নাম’, কখনও বা ধ্বংসের কালী— ‘সুবর্ণরেখা’।

নারীকে রক্ত-মাংসের মানুষ হিসেবে না দেখে পুরাণের চরিত্রের প্রতীক হিসেবে দেখবার যে প্রবণতা, যা অনেকটাই পুরুষ-কল্পনা, তাতে পুরুষের ইচ্ছাপূরণ ও পিতৃতন্ত্রের আয়ু বাড়ে বটে, কিন্তু নারীর দৈনন্দিন বেদনার বারমাস্যা তাতে কিছু কমে না। ঋত্বিক আদিমাতার রূপকে নারীর পৌরাণিকীকরণ ঘটিয়েছেন বটে, তবে ঋত্বিকই আবার সেই শিল্পী যিনি সবচেয়ে সার্থক ভাবে দেশভাগ পরবর্তী নিম্ন-মধ্যবিত্ত বাঙালি নারীর তীব্র ও কঠোর জীবনসংগ্রামটাকে তুলে ধরতে পেরেছিলেন। একজন ঋত্বিক ঘটকের পক্ষেই সম্ভব ছিল ‘মেঘে ঢাকা তারা’-র নীতা চরিত্রটিকে পর্দায় ওই রকম জীবন্ত ভাবে তুলে আনা। সেই সংবেদ ও প্রখর বাস্তববোধ ওঁর ছিল। পুরুষতান্ত্রিক মূল্যবোধগুলোর বিরুদ্ধে ঘরে ঘরে বাঙালি নারীর যে প্রতি দিনের সংগ্রাম, ঋত্বিকের ছবিগুলি থেকে তা তুলে ধরে লেখক ঋত্বিক-চর্চার দিগন্তকে প্রসারিত করেছেন। এটি এ বইয়ের এক মূল্যবান দিক। আসলে এই বইতে এমন কিছু নেই যা আমরা অতীতে কখনও ভাবিনি বা ঋত্বিক-বিশেষজ্ঞরা বিভিন্ন সময়ে উল্লেখ করেননি বা ইঙ্গিত দেননি। কিন্তু দেবযানী হালদার ঋত্বিকের আটটি ছবি, নাটকগুলি ও সমস্ত লেখালিখি ঘেঁটে যে ব্যাপক পরিশ্রমে দুই মলাটের মাঝে সে সব বিষয়কে আমাদের সামনে উপস্থিত করেছেন তা খুবই প্রশংসনীয়।

দেশভাগের বেদনার ভাষা কি আজও তৈরি হয়েছে? তবে ঋত্বিকের ছবি নিঃসন্দেহে বিষাদের সেই অতলান্ত গভীরতাকে ছুঁতে পেরেছে অনেক বারই। নিজে যন্ত্রণায় আকীর্ণ নীলকণ্ঠ এক একক শিল্পী হয়েও সমষ্টির প্রতিবাদী চেতনার প্রতি আস্থাটা ঋত্বিক অবিচল রেখেছিলেন আজীবন। ‘সুবর্ণরেখা’-তে জন্মভূমি থেকে উৎপাটিত হয়ে উদ্বাস্তু শিবিরে গড়ে তোলা হয়েছিল ‘নবজীবন কলোনী’। সে যৌথতার আদর্শ থেকে নিজের একক সুখের অন্বেষায় চলে যাওয়া ঈশ্বর চরিত্রটার করুণ পরিণতি এবং পরবর্তী প্রজন্মের জন্যে তার নতুন বাড়ির সন্ধান, মানব জীবনের গোটা চক্রটাকেই যেন ধারণ করলেন ঋত্বিক। পালানোর পথ নেই। লড়াই করেই বাঁচতে হবে। অভিজ্ঞতার উপলব্ধি অপাপবিদ্ধ মননের কাছে কখনওই ধরা দেয় না। দেশভাগের আদিপাপের উপলব্ধি যখন সকল বাঙালির চেতনাকে স্পর্শ করবে, ঋত্বিক ঘটক নামের এই অসামান্য সিনেমা-শিল্পীর আজন্ম এষণা সেদিন সার্থক হবে। দেবযানী হালদারের বইটি সেই হার-না-মানা ঋত্বিককে তাঁর সমগ্র কর্মকাণ্ড, বিশ্ববীক্ষা ও যন্ত্রণা নিয়ে ধরার এক ঋদ্ধ পরিশ্রমী প্রয়াস।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
আরও পড়ুন
Advertisement