পুস্তক পরিচয় ১

প্রচলিত ধারণার গণ্ডি ছাড়িয়ে বহুস্বর

এই সংবাদপত্র ও এবিপি গোষ্ঠীর প্রধান সম্পাদক অভীক সরকারের সপ্ততিতম জন্মবৎসরে প্রকাশিত সম্মানগ্রন্থটিতে কিন্তু কোথাও চাটুবাক্য ও ঢক্কানিনাদের লেশমাত্র নেই। বরং আছে বিষয়ের বৈচিত্র। অভীকবাবু নিজে প্রকাশনা জগতের মহীরুহ।

Advertisement
সুমিত মিত্র
শেষ আপডেট: ২৩ জানুয়ারি ২০১৬ ০০:০১
অনরিস কজা/ এসেজ ইন অনর অব অভীক সরকার। সম্পাদনা: জন ম্যাকিনসন। অ্যালেন লেন, ২০.০০ পাউন্ড

অনরিস কজা/ এসেজ ইন অনর অব অভীক সরকার। সম্পাদনা: জন ম্যাকিনসন। অ্যালেন লেন, ২০.০০ পাউন্ড

ফেস্টশ্রিফ্‌ট (Festschrift) শব্দটি জার্মান। অর্থ, কোনও সম্মানিত ব্যক্তিকে জীবনের এক বিশেষ সন্ধিলগ্নে তাঁর ঘনিষ্ঠ বিদগ্ধমণ্ডলীর রচিত এক প্রবন্ধমালার মাধ্যমে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন। কারও কারও ক্ষেত্রে একাধিক সম্মানগ্রন্থও হতে পারে। মার্কিনবাসী ভারতীয় অর্থনীতিবিদ জগদীশ ভগবতীর ফেস্টশ্রিফ্‌ট প্রকাশিত হয়েছে ছয়-ছয়টি। তাঁর প্রশস্তি করতে গিয়ে অর্থনীতিবিদ পল স্যামুয়েলসন লিখেছেন, ভগবতীর রচনার মধ্যে তিনি এমন বৈচিত্র ও গভীরতা খুঁজে পেয়েছেন, যা হাইড্ন-এর সংগীতের সমতুল্য।

এই সংবাদপত্র ও এবিপি গোষ্ঠীর প্রধান সম্পাদক অভীক সরকারের সপ্ততিতম জন্মবৎসরে প্রকাশিত সম্মানগ্রন্থটিতে কিন্তু কোথাও চাটুবাক্য ও ঢক্কানিনাদের লেশমাত্র নেই। বরং আছে বিষয়ের বৈচিত্র। অভীকবাবু নিজে প্রকাশনা জগতের মহীরুহ। তাঁর সম্মানগ্রন্থে ওই ব্যবসায়ের কয়েক জন দিকপাল থাকবেন, তা স্বাভাবিক। কিন্তু আরও অনেকে আছেন লেখক তালিকায়, যাঁরা ভিন্ন গ্রহের বাসিন্দা। যেমন শিল্প-ইতিহাসবেত্তা প্রতাপাদিত্য পাল, অক্সফোর্ডে প্রাচ্য ধর্মশাস্ত্রের স্পলডিং অধ্যাপক অ্যালেক্সিস স্যান্ডার্সন, লন্ডনের কিংস কলেজের আণবিক জৈব পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক ব্রায়ান সাটন। যেমন রামকৃষ্ণ মিশন বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিতের অধ্যাপক মহান মহারাজ। তিনি পিএইচ ডি করেছেন ক্যালিফোর্নিয়ার বার্কলে থেকে। মহারাজ কয়েক বছর আগে ভারতে শান্তিস্বরূপ ভাটনগর পুরস্কারটি পেয়েছিলেন, ওটিই ভারতে ৪৫-অনূর্ধ্বদের জন্য বিজ্ঞানের সর্বোচ্চ পুরস্কার।

Advertisement

মিডিয়া জগৎ থেকে যাঁরা লিখেছেন, তাঁরা সকলেই খ্যাতিমান। স্যর হ্যারল্ড ইভান্স ছিলেন ‘সানডে টাইমস’-এর প্রাণপুরুষ। স্যর ডেভিড বেল বর্তমানে ‘দি ইকনমিস্ট’ পত্রিকার ডিরেক্টর। এই দুই প্রকাশনাই যখন ছিল ১৭৭ বছর বয়সি পিয়ার্সন গ্রুপের ছত্রতলে, তখন স্যর ডেভিড ছিলেন পিয়ার্সনের অন্যতম ডিরেক্টর। সম্মানগ্রন্থের আর এক লেখিকা ডেম মার্জোরি স্কার্ডিনো দীর্ঘ ষোলো বছর পিয়ার্সনের শীর্ষ কর্মাধ্যক্ষ ছিলেন। অভীকবাবুর সঙ্গে পিয়ার্সনের সংযোজনসেতুটি পেঙ্গুইন প্রকাশনা সংস্থার মাধ্যমে। ভারতীয় প্রকাশনা জগতে পেঙ্গুইন বুকস-এর আবির্ভাব তাঁর হাত ধরে, তিনিই ছিলেন পেঙ্গুইন ইন্ডিয়া-র চেয়ারম্যান। তাঁর সম্মানগ্রন্থটি প্রকাশ করেছে পেঙ্গুইন। ভূমিকা লিখেছেন জন ম্যাকিনসন। তিনি পেঙ্গুইনের বর্তমান অবতার পেঙ্গুইন র‌্যানডম হাউস-এর চেয়ারম্যান।

ম্যাকিনসনের লেখা ভূমিকা থেকে অভীকবাবুর স্বভাব সম্পর্কে কিছুটা আন্দাজ পাওয়া যায়। এটাও বলা যায় যে, ম্যাকিনসনের ধারণাটি অভীকবাবুর দেশি সহকর্মী ও বন্ধুদের ধারণার চেয়ে তেমন ভিন্ন নয়। ম্যাকিনসন সম্ভবত একটু দুষ্টুমি করেই একটি উদ্ধৃতি ব্যবহার করেছেন নিকোলাস কোলরিজ-এর ‘পেপার টাইগার্স’ বইটি থেকেই। ঊনবিংশ শতকের বিখ্যাত কবির সাত পুরুষের বংশধর কোলরিজ এখন লন্ডনের ভিক্টোরিয়া অ্যান্ড অ্যালবার্ট মিউজিয়ম-এর চেয়ারম্যান। তিনি লিখেছেন, ‘অভীক সরকার হচ্ছেন ভারতের সব থেকে কেতাদুরস্ত (সফিস্টিকেটেড) সংবাদপত্র মালিক।’ এর পর অভীকবাবুর রুচি ও পছন্দের একটি সংক্ষিপ্ত ও মনোজ্ঞ বিবরণ দিয়ে নিকোলাস দেখিয়েছেন, তিনি স্ব-ভাবেই শ্রেষ্ঠত্বের সন্ধানী. এমন এক জনের জন্য যাঁরা কলম ধরেছেন, তাঁরা শ্রেষ্ঠতা অর্জন করেছেন নিজেদের জীবনেও।

ম্যাকিনসন লিখেছেন, ‘অভীক হ্যাজ আ পয়েন্ট অব ভিউ— আ স্পিরিটেড, ইন্টেলিজেন্ট অ্যান্ড আনঅ্যাম্বিগিউয়াস পয়েন্ট অব ভিউ— অন প্রিটি মাচ এভরিথিং’। ওই ‘পয়েন্ট অব ভিউ’টিই অভীকবাবুর বৈশিষ্ট্য। রাজনীতি থেকে ফুটবল, অর্থনীতি থেকে সাহিত্য, ফ্যাশন, সিনেমা— জীবনের সর্বক্ষেত্রেই তিনি একটি দৃষ্টিকোণ গ্রহণ করার পক্ষপাতী। সম্পাদকজীবনের শুরু থেকে এটিই অভীকবাবুর মূল্যবোধ। এই মূল্যবোধটি তিনি সম্ভবত অর্জন করেছিলেন তাঁর তরুণ বয়সে র, অর্থাৎ ষাটের দশকের ইংল্যান্ডে, যখন তিনি সাংবাদিকতায় হাতেখড়ি নিচ্ছিলেন সানডে টাইমস-এ হ্যারল্ড ইভান্স-এর কাছে। এই সংকলনে ইভান্স যে প্রবন্ধটি লিখেছেন, তা সেই মূল্যবোধ এবং তার ক্রমশ বিকাশ সম্পর্কে। তিনি ছিলেন সেই সাংবাদিক-সম্পাদকদের এক জন, যাঁরা কলমকে ব্যবহার করতেন নিরপেক্ষতার হাতিয়ার হিসেবে। কিন্তু সাংবাদিকতার সারস্বত আঙিনার কর্তৃত্বভার এক দিন চলে গেল বাণিজ্যলক্ষ্মীর হাতে। ‘টাইমস’ বিক্রি হয়ে গেল অস্ট্রেলীয় মিডিয়া সম্রাট রুপার্ট মারডক-এর কাছে। টাইমস-এর শতাব্দীপ্রাচীন উচ্চশির আভিজাত্যকে বিনা শর্তে আত্মসমর্পণ করতে হল ‘আয়রন লেডি’ মার্গারেট থ্যাচারের কাছে।

থ্যাচার ব্রিটেনে তাঁর প্রধানমন্ত্রিত্বকালে পশ্চিমী রাজনীতির অভিমুখ পালটে দেন, রাষ্ট্রনির্ভরতা থেকে আত্মনির্ভরতার দিকে। মার্ডক হয়তো সেই অভিমুখ পরিবর্তনকে স্বাগত জানিয়েছিলেন। কিন্তু মার্ডক তো সাংবাদিক নন, ‘মিডিয়া মুঘল’। ইভান্স তাঁর পেশার স্বাধীনতায় এই হস্তক্ষেপ মেনে নিতে পারেননি। তাঁর আক্ষেপ কিন্তু আজ ইতিহাস। প্রায় এক দশকব্যাপী ইউনিয়ন-মালিক সংঘর্ষের পর আজ টাইমস শুধু ফ্লিট স্ট্রিট থেকে পূর্ব লন্ডনের অধুনা সম্ভ্রান্ত ডক অঞ্চলেই সরে যায়নি, চিড় খেয়েছে সাংবাদিকদের আত্মাভিমানও।

মালিক ও সম্পাদকের পরিবর্তমান সম্পর্কের সুচিন্তিত বিশ্লেষণ করেছেন স্যর ডেভিড বেল। ‘দি ইকনমিস্ট’ পত্রিকার নন-একজিকিউটিভ ডিরেক্টর স্যর ডেভিড ছিলেন সেই কালে মিডিয়া ও প্রকাশনা জগতের স্তম্ভস্বরূপ পিয়ার্সন কোম্পানির ডিরেক্টর। তখন পিয়ার্সনের ওই ছত্রতলে ছিল একাধিক বিশ্বনন্দিত প্রতিষ্ঠান: দি ইকনমিস্ট, দ্য ফিনানশিয়াল টাইমস (এফটি), পেঙ্গুইন। বেল
এফটি-র চেয়ারম্যান ছিলেন বেশ কিছু দিন। হাতবদল হয়ে দি ইকনমিস্ট-এর বর্তমান স্বত্বাধিকারীদের অন্যতম হল ইতালির আগানেল্লি পরিবার, ফিয়াট গাড়ির নির্মাতা। বেল আশ্বস্ত করেছেন, ইকনমিস্টের উপর কখনও আসেনি মালিকপক্ষ থেকে চাপ। তিনি জানিয়েছেন এফটি-র একটি কৌতূহলোদ্দীপক ঘটনা। সলমন রুশদির ‘সেটানিক ভার্সেস’ নিয়ে হইচই যখন তুঙ্গে, তখন এফটি তাঁর লেখার স্বাধীনতা রক্ষার আইনি খরচ বাবদ অনেক মিলিয়ন পাউন্ড ব্যয় করে, যদিও বইটির মান সম্পর্কে এই প্রতিষ্ঠানের মতামত ছিল উহ্য। তবে তার পরোক্ষ কারণ হয়তো এই যে, বইটি পেঙ্গুইনের প্রকাশনা, এবং ইরানের আয়াতোল্লা খোমেইনির ফতোয়া ছিল প্রকাশনার স্বাধীনতার উপর প্রথম কুঠারাঘাত।

তবে বই প্রকাশনার জগতে বিপ্লবের কারণ হয়তো অন্য, তা হল প্রযুক্তি। মানুষ বই পড়ছে বটে, কিন্তু তা ল্যাপটপ, আইপ্যাড বা কিন্ডল যন্ত্রের পর্দায়, এমনকী মোবাইল ফোনেও। অবশ্য তা ছাপা বইকে জাদুঘরে পাঠিয়ে দেয়নি। এই হল ডেম মার্জোরি স্কার্ডিনো-র বক্তব্য। ডেম মার্জোরি ষোলোটি বছর একনাগাড়ে ছিলেন পিয়ার্সনের মুখ্য কার্যকর্তা। তাঁর মতে, ‘কলেজ স্ট্রিটের উত্তরোত্তর শ্রীবৃদ্ধি’ হতেই থাকবে। হয়তো তাই, কিন্তু একদা প্রকাশনা ব্যবসায়ের ডাকসাইটে নেত্রী হওয়া সত্ত্বেও তিনি পরিষ্কার করেননি— কী ভাবে বই ছাপা ও বইয়ের দোকান পরিচালনার খরচ সামলে ভবিষ্যতের প্রকাশকেরা পেরে উঠবেন ই-বুকের সঙ্গে।

মিডিয়া জগতের বাইরে থেকে আসা কয়েকটি লেখা মনোগ্রাহী। যেমন প্রতাপাদিত্য পাল দক্ষিণ এশিয়ার শিল্পসংগ্রহ ও তার পরিচালনায় বিশ্ববিশ্রুত বিশেষজ্ঞ। লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ এশিয়া ও আফ্রিকা বিষয়ক চর্চার কেন্দ্র ‘সোয়াস’-এ তাঁর নামে এশীয় শিল্পসামগ্রী প্রদর্শনবিদ্যার একটি চেয়ার আছে। তিনি লিখেছেন বস্টন মিউজিয়মে তাঁর পূর্বসূরি আনন্দ কুমারস্বামীর একটি অনবদ্য প্রোফাইল। অতুলনীয় কিছু রেখাচিত্র ও পুরনো চিঠিপত্র ও গল্পের সম্ভারে লেখাটি বিংশ শতকের শুরুতে ‘দক্ষিণের বারান্দা’-র শিল্পীত্রয়ীর যুগটিকে জীবন্ত করে তোলে। অপর দিকে জৈব পদার্থবিদ ব্রায়ান সাটন লিখেছেন, ডিএনএ-র নির্মাণে পরিচিত চারটি উপাদানের বাইরে অন্য উপাদানের ব্যবহার সম্ভব। অর্থাৎ, ভবিষ্যতে ‘জীবন’ শব্দটির ভাবান্তর ও অর্থান্তর মোটেই সম্ভাব্যতার সীমাবহির্ভূত নয়। অক্সফোর্ডের সংস্কৃত পণ্ডিত স্যান্ডার্সনের প্রবন্ধটি সুদীর্ঘ হলেও চিত্তাকর্ষক। বৈদিকোত্তর ভারত সম্পর্কে প্রচলিত ধারণা হল, তখন অর্থোডক্সি-র চাইতে বেশি ছিল অর্থোপ্র্যাক্সি: নীতিনিষ্ঠা নয়, আচারনিষ্ঠা। স্যান্ডার্সন কিন্তু তাঁর দৃষ্টান্তসমৃদ্ধ প্রবন্ধে দেখিয়েছেন, প্রাচীন ভারত ছিল এক নিরন্তর যুদ্ধক্ষেত্র, যেখানে ধর্মবিশ্বাসই ছিল যুদ্ধের কারণ।

অর্থাৎ, প্রচলিত ধারণা ধাক্কা খেতে চলেছে বইটিতে এত লেখকের এত কণ্ঠস্বরে। মনে হতে পারত, তাঁর প্রধান সম্পাদকের কক্ষ থেকে নিপুণ কন্ডাকটরের মতো অভীকবাবু নিজেই এই অর্কেস্ট্রার রূপকার। কিন্তু তা কী করে হবে? বইটি তো তাঁরই ফেস্টশ্রিফ্‌ট। তবে অভীকবাবুকে যাঁরা সম্পাদক হিসেবে চেনেন, তাঁরা স্বীকার করবেন, ব্যাটন ছাড়বার মানুষ তিনি নন। যেমন শুভ্রশ্মশ্রুতে আঙুল চালিয়ে তিনি আলোচনা করেন— কাল সকালের কাগজে লেখা হবে কোন স্টোরিটা, পরিবেশিত হবে কোন অভিমত, কী দৃষ্টিকোণ থেকে, কোন স্টাইলে। সভা ভাঙবার পর হাতে গুঁজে দেবেন কোনও এক প্রবন্ধ। ‘পড়ে দেখো, বুঝতে সুবিধা হবে।’

আরও পড়ুন
Advertisement