সীতা সরকার ১৯৫০ থেকে ১৯৫৫-র মধ্যে বর্ডার পারাপার করেছেন পাঁচবার। সীতাদেবী এখানে সোদপুর অঞ্চলের সংসারকর্ত্রী। এখন তাঁর বিরাশি বছর বয়সেও নিজের দেশ কিশোরগঞ্জ-ময়মনসিংহ ছাড়া আর কিছুই ভাবতে পারেন না। ‘তখন যারা এ দেশ থেকে ও দেশ যেত তাদের মধ্যে হিন্দুদের সংখ্যা স্বাভাবিক ভাবেই ছিল কম। যদিও বা হিন্দুরা যায় তারা পুরুষেরাই। আমাকে তাই জামাইবাবু বললেন, শাঁখা খুলতে হবে, সিঁদুর মুছতে হবে। কিন্তু হিন্দুর ঘরের মেয়ে হয়ে সিঁদুর মুছি কীভাবে, স্বামী বেঁচে থাকতে শাঁখা খুলব কীভাবে?’ লিখেছেন তিনি আত্মস্মৃতিতে। এ রকমই আরও স্মৃতির ক্ষরণ পুঞ্জিত হয়েছে বর্ডার/ বাংলা ভাগের দেওয়াল-এ (গাঙচিল। ৪৫০.০০)। সম্পাদক অধীর বিশ্বাস বইটি নির্মাণেও মনোযোগ দিয়েছেন এ ধরনের স্মৃতিকথন, সাক্ষাৎকার, প্রতিবেদনে। কারণ, তাঁর মনে হয়েছে ‘এই বর্ডার আমাদের জীবন-জীবিকায়, আমাদের বেঁচে থাকার প্রতিটি অনুষঙ্গে, আমাদের সত্যমিথ্যায়, আমাদের নীতিবোধ, আমাদের ধর্মবোধে তুমুল ঝড় তুলে একেবারে আলাদা ভিন্ন প্রকারের এক প্রজাতিতে পরিণত করে গেছে—।’ আত্মস্মৃতির সূত্রেই ঠাঁই পেয়েছে তরুণ সান্যালের ‘বাঙাল বামুন-এর বর্ডার’, হাসান আজিজুল হকের ‘মধ্য-প্রান্তরে আঁধি-লাগা’, অমর মিত্রের ‘ছিটমহল, স্বাধীনতার বর্ষপূর্তি’, সাধন চট্টোপাধ্যায়ের ‘বাঁ-ঠ্যাং ইন্ডিয়া, ডান-ঠ্যাং বাংলাদেশে’, বা নিত্যপ্রিয় ঘোষের ‘উদ্বাস্তু— উদ্বাস্তু না হয়েও’, তাতে লিখছেন তিনি: ‘পাকশিতে আমরা ছিলাম আট বছর। পদ্মানদীর উপরে সাড়া ব্রিজ তৈরির জন্যে গড়ে উঠেছিল পাকশির রেলওয়ে কলোনি। আধুনিক জীবনযাত্রার সব উপকরণই ছিল।... মনে আছে, আমরা পাকশি ছাড়ি ভোরবেলায়, আলো ফোটার আগে। পাকশির স্টেশনটা ছিল সাব স্টেশন, আসল স্টেশন ছিল ঈশ্বরদি। একটা ছোট পাইলটকার যাওয়া আসা করত সারাদিন পাকশি-ঈশ্বরদি, ঈশ্বরদি-পাকশি। কিন্তু ভোরবেলায় চুপিসাড়ে আমরা পাকশি ছাড়লাম কেন জানি না।’ আছে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রকার তানভীর মোকাম্মেলেরও সাক্ষাৎকার, তাতে দেশভাগ নিয়ে তাঁর নির্মীয়মান ‘সীমান্তরেখা’র প্রসঙ্গে তিনি জানিয়েছেন ‘আমি বাংলাদেশের ইতিহাসের যত গভীরে ঢুকছি ততই অনুভব করতে পারছি যে, ১৯৪৭-এর দেশভাগ ছিল এক নিয়ামক ঘটনা। বাংলা অতীতেও বিভক্ত থেকেছে— রাঢ়, সমতট, হরিকেল ইত্যাদি। কিন্তু সাতচল্লিশের মতো চূড়ান্ত ও নির্ধারক ভাগ অতীতে আর কখনওই হয়নি। কখনও লাগানো হয়নি কাঁটাতারের বেড়া। র্যাডক্লিফের বাংলা ভাগ সত্যি সত্যিই যেন বাংলা ও বাঙালির উঠান দিয়ে একটা কাঁটাতার টেনে দিল। বাংলাভাগের প্রায় সত্তর বছর পার হতে চলেছে। এখন সময় এসেছে বাংলাভাগের প্রভাব, এর রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দিকগুলো নতুন করে বুঝতে চাওয়া।’
গাঙচিল থেকেই ঝর্ণা বসুর সম্পাদনায় বেরিয়েছে হৃদয়ের টুকরোয় গাঁথা/ দেশভাগ ও একাত্তরের স্মৃতি (৩৫০.০০)। লেখক-লেখিকারা প্রত্যেকেই প্রত্যক্ষ বিপন্নতার শিকার, তাঁদের শিকড়হারা অস্তিত্বের জবানবন্দি যেন এই রচনাদি। তাঁদের সংগঠন ‘বাগেরহাট সমিতি’র আগ্রহ আর উদ্যোগেই বেরিয়েছে বইটি। ‘মুক্তিযুদ্ধের ন’মাস অনবরত যুদ্ধ চলেছিল। এ যুদ্ধে গেরিলা পদ্ধতি যেমন অনুসরণ করা হয়েছিল, তেমনি হয়েছিল সম্মুখ যুদ্ধ। আর সাতকোটি বাঙালি এই যুদ্ধকে মানসিক ভাবে সমর্থন করায় প্রত্যেকেই ছিল মুক্তিযোদ্ধা।... মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে কেউ হারিয়েছেন বাবা, কেউ স্বামী, কেউ অত্যন্ত নিকট জন। এই গ্রন্থে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাকে কলমের আঁচড়ে তুলে ধরেছেন তাঁদেরই ক’জন।’ শুরুতেই জানিয়েছেন সম্পাদক। এ বইয়ের শেষ রচনাটির শিরোনাম ‘বিপন্ন অস্তিত্ব’, লিখেছেন সোনারপুর নিবাসী অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক হৃষিকেশ হালদার, তাতে তিনি খেয়াল করিয়ে দিয়েছেন আমাদের ‘একজন উদ্বাস্তুর দেশ হারানোর দুঃখ আশ্রয় নেওয়া দেশের মানুষ বুঝতে চায় না, বুঝতে পারে না। পূর্ববঙ্গের ভদ্রলোক উদ্বাস্তুরা কলকাতা শহর বা অন্যান্য শহরাঞ্চলগুলিতে নিজেদের ঠাঁই করে নিতে পেরেছে। সেই সব জায়গায় বা কলোনিগুলিতে নিম্নবর্গীয় হিন্দুদের ঠাঁই মেলেনি।’
১৯৫০-এ বরিশাল দাঙ্গায় বিপর্যস্ত হয়ে দেশ ছাড়েন অধীশচন্দ্র সাহা। এ-বঙ্গ নিবাসী অবসরপ্রাপ্ত এই অধ্যাপক তাঁর চির-পরবাসী/ দাঙ্গায় দেশত্যাগ-এ (গাঙচিল। ২৫০.০০) যে সব ঘটনা বা চরিত্র এঁকেছেন, তা সত্যি। বরিশালের জনজীবন, সেই জীবনের আর্থ-সামাজিক রাজনৈতিক বা ধর্মীয় পালাবদলের কথার সঙ্গে লিখেছেন আদর্শ দেশপ্রাণ মনীষীদের কথাও। আহত মন নিয়ে আজ তাঁর উপলব্ধি: ‘‘ভারতীয় রাজনীতিতে ‘হিন্দু মুসলিম ভাই ভাই’, ‘আমরা একই মায়ের দুটি সন্তান’, ‘আমরা একই বৃন্তে দুটি ফুল’ এসব গানে বা কবিতায় বাংলার সমাজ-সাহিত্য যতই সমাদৃত হোক রাজনীতিতে মায়া মরীচিকা মাত্র। ধর্মের ভিত্তিতেই ভারত খণ্ডিত হয়েছে।... স্বামীজি পরধর্মের প্রতি সহিষ্ণুতা ও শ্রদ্ধাকে হিন্দুর আদর্শ ধর্ম বলেছেন। যখন শিকড়ের বৃথা সন্ধান করতে গিয়ে ভাবি এভাবে ভিটেমাটি ছেড়ে নেহরু-লিয়াকৎ চুক্তির মোহে পড়ে দেশত্যাগ করার চেয়ে ধর্মত্যাগ করে দেশজননীর কোলে থেকে যাওয়াই বুঝি ভালো ছিল।’’