book review

রাজনীতির ক্রীড়াভূমিই হয়ে রইল দণ্ডকবন

সেই ছোট্ট মেয়ে— বুই, অরণ্যা— বড় হয়ে উঠছিল মালকানগিরিতে, দণ্ডকারণ্য ‘উন্নয়ন’ প্রকল্পে, সেখানেই তখন চাকরিরত তার বাবা-মা।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১১ জুন ২০২২ ০৬:৪১

দণ্ডিত বাঙালির দণ্ডকারণ্য: বিষাদবন

প্রজ্ঞা পারমিতা

Advertisement

৪৫০.০০

গাঙচিল

“জীবনে আর যাই করো, এমন কিছু কাউকে দেব বলবে না, যা তুমি দিতে পারবে না। কোনও ক্ষুধার্তকে আহার দেখাবে না কখনও যদি তুমি না দিতে চাও তাকে। আশা দেবে না, যে আশা বাস্তব করা অসম্ভব। এসব করাকে রাজনীতি করা বলে।”— মেয়েকে চিঠিতে লিখেছিলেন বাবা। সেই ছোট্ট মেয়ে— বুই, অরণ্যা— বড় হয়ে উঠছিল মালকানগিরিতে, দণ্ডকারণ্য ‘উন্নয়ন’ প্রকল্পে, সেখানেই তখন চাকরিরত তার বাবা-মা। বহু বছর পরে সেই মেয়ে ফিরে আসে ছোটবেলার ঠিকানায়, তার ভালবাসার মানুষ সমিধকে সঙ্গে নিয়ে, আর তাদের চলার পথে কথায় ভাবনায় কান্নাহাসিতে ফুটে ওঠে যে ‘বিষাদবন’ আর বনবাসী মানুষগুলির ইতিহাস, তা-ই উপজীব্য উপন্যাসধর্মী এই বইয়ের। লেখকের আত্মজীবনই এখানে প্রধান উৎস ও উপাত্ত: শৈশবচোখে দেখা দণ্ডকবন, শাল মহুয়া কেন্দুর জঙ্গল, তমসা নদী, পাথুরে জমিতে ফসল ফলানোর চেষ্টা করা উদ্বাস্তু ও রাজনীতি-প্রতারিত মানুষগুলি, যাঁদের বলা হয়েছিল এই তো ক’দিন, ক’টা বছর সামলে নাও, থাকো এখানে, আবার ফিরিয়ে নেব ধান-ফলানো নরম মাটির ঠাঁইয়ে— আশা আর আশাভঙ্গের কয়েক দশক ধরে পাথুরে কাঁকুরে জমিতে তাঁদের নতুন শিকড় বসানোর সাক্ষী লেখক। এই মানুষেরাই চলে গিয়েছিলেন মরিচঝাঁপি, রাষ্ট্রযন্ত্রের চরম আঘাত সয়ে ফের ফিরে এসেছিলেন অনেকে, দ্বিতীয় বার সর্বস্ব খুইয়ে— সেই ট্র্যাজেডিও ছায়া মেলে থাকে বইয়ে। আজকের ওড়িশা মধ্যপ্রদেশ ছত্তীসগঢ়ের ‘উন্নয়ন’-চকচকে মানচিত্রে সেই ‘পুনর্বাসন’ নামধারী ইতিহাস ক্রমে ধূসরিত, বিস্তর বদলে গিয়েছে সে দিনের ‘সেটলার’ জীবনের সহ-বাসী, সহভাগী জনজাতিবৃত্তও— বন্ডা, গোন্ড, শবর, কন্ধ, দিদায়ি, কয়া ‘আদিবাসী’রা। ক্রমবিস্মৃত এই মানুষেরাও চরিত্র হয়ে ফিরে ফিরে আসে এই আখ্যানে— বুইয়ের ছোটবেলার খেলার সঙ্গী, জনজাতি কিশোর ডোরা যৌবনে নিজের মেয়ের নাম রাখে ‘আর্না’, সে তো ‘অরণ্যা’রই কথ্যরূপ! দেশভাগের শিকার শরণার্থীদের মধ্যেও রয়েছে জাতি বর্ণ বর্গের অদৃশ্য পিরামিড, তার তরাইয়ে থাকা মানুষগুলিকে নিয়ে লেখাজোখা কই তত? এ বই আখ্যানধর্মিতার আঙ্গিকে এত কাল না-বলা কথাগুলো বলার চেষ্টা করে। তবু কেউ তো বললেন, কোনও ভাবে!

আট দশকের অমরেন্দ্র: তাঁরসৃষ্টির পথ

সম্পা: কালীকৃষ্ণ গুহ, মহাশ্বেতা সমাজদার, মৈত্রেয়ী নাগ

৫৫০.০০

অভিযান পাবলিশার্স

আশি বছর পূর্ণ করেছেন সম্পাদক অমরেন্দ্র চক্রবর্তী। সেই উপলক্ষে প্রকাশিত হয়েছে এই সম্মাননাগ্রন্থ। প্রায় ৫০০ পাতায় সঙ্কলিত হয়েছে বিয়াল্লিশ জন লেখকের নতুন-পুরনো প্রবন্ধ। প্রথম প্রবন্ধেই অমরেন্দ্র-র সঙ্গে তাঁর আলাপের দিনগুলি নিয়ে নানা অজানা কথা জানিয়েছেন শঙ্খ ঘোষ, প্রয়াণের কিছু দিন আগেই। বইটিতে পুনঃপ্রকাশিত হয়েছে লীলা মজুমদার, মহাশ্বেতা দেবী, সুভাষ মুখোপাধ্যায় প্রমুখের লেখা। তাঁদের আলোচনায় অমরেন্দ্র-র পত্রিকা প্রকাশ, ভ্রমণসাহিত্যিক হয়ে ওঠার কথা ও হীরু ডাকাত, শাদা ঘোড়া প্রভৃতি শিশুসাহিত্য রচনার প্রসঙ্গ রয়েছে। বইটির প্রকাশ উপলক্ষে নতুন করে কলম ধরেছেন অমিয় দেব, জহর সরকার, পবিত্র সরকার, নীলাঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ। বিশ্লেষণ করেছেন তাঁর লেখা বিষাদ গাথা বা জিপসি রাত উপন্যাস এবং বড়দের জন্য রচিত নানা ছোট গল্প, কবিতা। আফ্রিকার বৃষ্টি অরণ্যে অমরেন্দ্র-র ছবি ও তথ্যচিত্র তোলার বিশদ বিবরণ দিয়েছেন উজ্জ্বল চক্রবর্তী। বাবাকে নিয়ে নানা গল্প শুনিয়েছেন দুই আত্মজাও। শেষে অমরেন্দ্র-র বিভিন্ন বইয়ের অংশসংগ্রহ এবং গ্রন্থপঞ্জি। প্রচ্ছদেও তাঁরই তুলি-কলা।

এমনি

সুতনুকা গিরি১

৬৫.০০

সোম পাবলিশিং

একদা পর্বতমালা-সিন্ধু পেরিয়ে ‘শিশিরবিন্দু’ দেখার কথা বলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। রসজ্ঞ পাঠক জানবেন, সে কথা কেবল ভ্রমণ-প্রসঙ্গ নয়, তা আসলে জীবনদর্শন। আমাদের রোজকার পথ চলাও এমন ভাবেই অলক্ষ্যে হয়ে থাকে, তা নেহাতই দিনগত পাপক্ষয়। কিন্তু তারও কি কোনও গুরুত্ব নেই? তাতেও কি নেই দেখার মতো কিছুই? তা কি স্রেফ ‘এমনি’? আলোচ্য বইয়ে লেখক লিখছেন, “শোনা হয়নি দিদিমার কথা, তাঁর মায়ের কথা, তাঁর মায়ের কথা... এমনিদের গল্পে না আছে রোমাঞ্চ, না আছে একসেপশনাল কোনও আরাধ্য জীবনের বিবৃতি।” তবুও প্রত্যেক ‘এমনি’রই নিশ্চয়ই কখনও না কখনও নিজের মুখে আয়না ধরার সাধ জাগে। সে বলতে চায় তার রোজদিনের টুকো টুকরো গল্পগুলি— ঢেঁকিতে পাড় দেওয়ার গল্প, কাঁথায় নকশা তোলার গল্প, বকুলফুলের সঙ্গে মনের কথা বলার গল্প, বাস ট্রাম পেরিয়ে অফিস যাওয়ার গল্প, অফিস আর সংসার সামলানোর গল্প, কফি শপে পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেওয়ার গল্প। কোনও এক এমনির মুখে আয়না ধরে এ ভাবেই সাধারণ দৈনন্দিনতার কাহিনি বুনে চলেন লেখক, একেবারে আটপৌরে ঢঙে। তাঁর কখনও মনে হয়, হয়তো এই গল্পের কানাকড়িও দাম নেই। কিন্তু সত্যিই কি নেই? চার পাশ চোখ মেলে দেখতে না শিখলে কি ভাবতে শেখা যায়? নিজেকে চেনাটাও কি দরকার নয়? তা-ই যে কবির ‘শিশিরবিন্দু’।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তেফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ

আরও পড়ুন
Advertisement