চিত্রকলা ও ভাস্কর্য১

শিল্পসাধনায় রূপান্তরিত শান্তিনিকেতন ঘরানা

সিমা-তে চলছে সুষেণ ঘোষের একক প্রদর্শনী। দেখে এসে লিখছেন মৃণাল ঘোষগণিত, বিজ্ঞান, দর্শন বা ললিতকলা — সকল সাধনার মধ্যেই যে সাধারণ ঐক্য রয়েছে, তা হল সত্যের সন্ধান। এই ‘সত্য’ বড় রহস্যময়। তার দিকে কেবলই অগ্রসর হতে হয়।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৯ নভেম্বর ২০১৬ ০০:০০
শিল্পী: সুষেণ ঘোষ

শিল্পী: সুষেণ ঘোষ

গণিত, বিজ্ঞান, দর্শন বা ললিতকলা — সকল সাধনার মধ্যেই যে সাধারণ ঐক্য রয়েছে, তা হল সত্যের সন্ধান। এই ‘সত্য’ বড় রহস্যময়। তার দিকে কেবলই অগ্রসর হতে হয়। কিন্তু সেই সাধনার কোনও সমাপ্তিবিন্দু নেই। প্রাণের বৈশিষ্ট্য যেমন ক্রমান্বিত হয়ে ওঠা, সত্যেরও তাই। নিউটনীয় বিজ্ঞান যে সত্যের আবিষ্কার করেছিল মাক্স প্লাংক বা আইনস্টাইন তাকে আরও উন্নত পর্যায়ে রূপান্তরিত করেছেন। আবার প্রত্যেকটি বিষয়ের সাধনাই পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কিত। গাণিতিক সত্যকে অনুধাবন করতেই চিত্রকলা এক সময় ‘সিঙ্গল-পয়েন্ট’ পার্সপেক্টিভ’-এর চর্চা করেছিল। পরবর্তী কালে বিংশ শতকে সেই সত্যের অভিজ্ঞান যখন পাল্টেছে, তখন স্বাভাবিকতা পরিহার করে পূর্ণ বিমূর্ততার দিকে অগ্রসর হয়েছে চিত্রকলা। লক্ষ্য ছিল এক দিকে গাণিতিক বা জ্যামিতিক নৈর্ব্যক্তিকতা, অন্য দিকে সাংগীতিক ছন্দে শিল্পকে অভিষিক্ত করে তোলা। এই ছন্দই আবার সমস্ত সৃজনাত্মক সাধনার প্রাণস্বরূপ।

সিমা-তে চলছে শান্তিনিকেতনের প্রখ্যাত ভাস্কর সুষেণ ঘোষের পূর্বাপর প্রদর্শনী। তিনি তাঁর ভাস্কর্যের মধ্যে এক দিতে যেমন গাণিতিক প্রজ্ঞাকে উন্মীলিত করতে চেয়েছেন, তেমনই সংহত করতে চেয়েছেন সংগীতের সুর ও ছন্দকে। এই প্রদর্শনীর শিরোনাম তাই ‘ফ্রোজেন মিউজিক’। প্রায় ছয় দশকের শিল্প সাধনায় তাঁর একান্ত নিজস্ব বিমূর্তায়ন পদ্ধতির দিকে তিনি এগিয়েছেন প্রকৃতির ছন্দকে রূপান্তরিত করতে করতেই। সেই সঙ্গে আত্মস্থ করছেন গণিত ও পদার্থবিদ্যার অন্তনির্হিত ছন্দ ও বিমূর্তায়ন প্রক্রিয়াকেও। ১৯৬০-এর দশকে প্রতিষ্ঠাপ্রাপ্ত এই শিল্পী শান্তিনিকেতনে উদ্ভাবিত শিল্পের প্রজ্ঞাকেই এক নতুন শিখরে উন্নীত করেছেন। ষাটের দশকে ভারতের আধুনিকতাবাদী চিত্র-ভাস্কর্যে নিরবয়বের যে চর্চা শুরু হয়েছিল পূর্ব-প্রজন্মের রামকিঙ্কর, গাইতোন্ডে, রাজা-র পর স্বামীনাথন, জেরাম প্যাটেল, নাসরিন মোহামেদি, সুকান্ত বসু, গণেশ হালুই প্রমুখ শিল্পী এই বিমূর্তায়নকে যে পথে সঞ্চালিত করেছেন, সুষেণ সেখানে নতুন মাত্রা এনেছেন গণিত ও জ্যামিতির প্রজ্ঞাকে সমন্বিত করে এবং তার সঙ্গে সাংগীতিক ছন্দকে মিলিয়ে। একজন নিবিষ্ট সংগীত-শিল্পীও তিনি। বাঁশি বাজান সমান তন্ময়তায়।

Advertisement

শান্তিনিকেতনের প্রজ্ঞাই কেমন করে রূপান্তরিত হয়েছে তাঁর শিল্প-সাধনায়, সেটা অনুধাবন করতে আমরা দেখতে পারি তাঁর দুটি লিথোগ্রাফ করা ছবি। শিরোনামহীন দুটি ছবির একটি ১৯৭০-৭৫-এ, অন্যটি ১৯৯৩-তে করা। দুটি ছবিতেই রয়েছে শান্তিনিকেতনের বা বীরভূমের বিস্তীর্ণ শূন্য প্রান্তরে আকাশের দিকে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকা অজস্র তালগাছ। কিন্তু সম্পূর্ণই বিমূর্তায়িত। এ রকম তালগাছের নিসর্গ আঁকতেন বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়। সেই দর্শনকেই সুষেণ রূপান্তরিত করেছেন বিমূর্তায়নের দিকে। নন্দলাল বসু ও রামকিঙ্করের ছন্দের দর্শনকেও নিজের মতো করে রূপান্তরিত করেছেন তিনি।

১৯৬৩-তে কলাভবনের শিল্পশিক্ষা সমাপ্ত করে সেখানেই তিনি শিক্ষকতায় নিযুক্ত হন। ১৯৭০-এ তিনি লন্ডনে যান গোল্ডস্মিথ কলেজে উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য। শান্তিনিকেতনে অর্জিত তাঁর প্রজ্ঞায় নতুন মাত্রা যুক্ত হয় পাশ্চাত্যের আধুনিকতাবাদী বিমূর্ত ভাস্কর্যের সংস্পর্শে এসে। বাংকুজি বা বারবারা হেপওয়ার্থ-এর ভাইটালিস্টিক বা জীবন্ময় বিমূর্তায়ন নয় অথবা টাটলিন বা মালেভিচ-এ যান্ত্রিক বিমূর্তায়নও নয়, তাঁর ভাস্কর্যে সুষেণ আনতে চান এক নতুন প্রজ্ঞা, যাতে এই বাংলার প্রকৃতিই এক বিশ্বগত স্থাপত্য বা জ্যামিতিক প্রজ্ঞায় উন্মীলিত হয়। এর অন্যতম শ্রেষ্ঠ দৃষ্টান্ত ১৯৯৩-এ করা ‘কম্পোজিশন’ শীর্ষক একটি ব্রোঞ্জ। আকাশচুম্বী পিরামিড-সদৃশ ত্রিকোণাকার স্থাপত্য যেন একটি পদ্মফুলের মতো অজস্র পাপড়ি মেলে দাঁড়িয়ে আছে। অথচ তাতে স্থাপত্য নেই, পদ্ম নেই, পাঁপড়ি নেই। এ সমস্তের অনুপস্থিতির উপস্থিতি গড়ে তুলেছে এক সংহত, ছন্দিত সুর। এই হল তাঁর ভাস্কর্যের বৈশিষ্ট্য। ১৯৭০-৭৫-এর ‘এলিভেটেড’ শীর্ষক ব্রোঞ্জ ব্রোঞ্জটি দেখলে বোঝা যায় কেমন করে মানুষের অবয়ব বিমূর্তায়িত হচ্ছে, এ পথেই আরও কিছু দূর গিয়ে গড়ে ওঠে ১৯৮৫-র টেরাকোটা ‘ফিগার’। কয়েকটি ‘সিলিন্ডার’-এর সমন্বয়ে উপবিষ্ট এক মানুষ। ভারতীয় লৌকিকের মধ্যেও তিনি দেখেন সংগীতময় গাণিতিকতা।

প্রদর্শনী চলছে

সিমা: • সুষেণ ঘোষ আজ শেষ।

অ্যাকাডেমি: • বিশ্বনাথ দে, কৌশিক মণ্ডল প্রমুখ২৩ পর্যন্ত।

• অমিত চক্রবর্তী ২৩ পর্যন্ত।

বিড়লা অ্যাকাডেমি: • আর্ট অব ইনফিনিটি ২২ থেকে ২৭ পর্যন্ত।

গ্যালারি গোল্ড: • যুগলবন্দি ২৩ পর্যন্ত।

আরও পড়ুন
Advertisement