এই ডিজিটাল যুগেও কোনও বই হাতে পেয়ে যে ছোটবেলার মতো মনে এতটা রোমাঞ্চ জাগবে, তা আগে ভাবিনি। মোটা, বাঁধানো বইটা হাতে ধরা মাত্র যেন সত্তরের দশকে ফেলে আসা কৈশোরের দিনগুলো ফিরে পেলাম; প্রচ্ছদ আর সূচিপত্র দেখেই পুরনো সেই সব ছবি জ্বলজ্বল করে উঠল— ফিরে এল প্রতি মাসের গোড়ায় ‘আনন্দমেলা’র নতুন সংখ্যা হাতে পাওয়ার অনাবিল আনন্দ অথবা জন্মদিনের উপহার হিসেবে পুরুলিয়া শহরের বুকে মানভূম বুক স্টোর-এর ভেতরে ঢুকে মালিকের ডেস্কের পিছনের তাক থেকে নতুন বই নিজে হাতে নামিয়ে আনার গা-শিরশিরে অনুভূতি। স্মৃতিগুলো এ ভাবে উসকে দেওয়ার জন্য লেখককে তাই প্রথমেই অজস্র ধন্যবাদ।
তবে, কোনও বই হাতে নিয়ে বা তার শুরুটা দেখে ভাল লাগলেই যে গোটা বইটা পড়ার অভিজ্ঞতাও সুখকর হবে, তেমন কোনও মানে নেই। বিশেষত বইটা যদি আয়তনে বেশ বড় হয়। এ ক্ষেত্রে কিন্তু লেখক একেবারেই নিরাশ করেননি। একনাগাড়ে প্রায় সাড়ে চারশো পাতা শেষ করতে মোটেই অসুবিধা হয় না; যেন কলকাতার দৈনিক ‘দ্য টেলিগ্রাফ’-এর জন্মলগ্নের সেই বিজ্ঞাপনী শব্দবন্ধ— ‘আনপুটডাউনেবল’। মনোগ্রাহী গল্পের মতো ঝরঝরে প্রবন্ধের সঙ্গে উপরি পাওনা সুন্দর পাতায় ছাপা ঝকঝকে ছবির ব্যবহার। এ জন্যে প্রকাশককেও সাধুবাদ দিতে হবে বইকী।
বইয়ের শিরোনামেই যেহেতু ইতিবৃত্ত শব্দটা রয়েছে, তাই আশা জাগে— অনেক কিছু এক মলাটে দেখতে ও পড়তে পারব। কিছুটা যেন নামী রেস্টুরেন্টে বুফে খেতে যাওয়ার মতো মনোভাব। তবে, বুফে খেতে যাওয়ার মুশকিলও আছে অবশ্য। এক, কোনটা ছেড়ে কোনটা খাব, সেই দ্বিধা। আর দুই, পরিশেষে হয় সব কিছু খেয়ে ‘আজ বেশি খেয়ে ফেললাম’ বলে বদহজমের আশঙ্কা, নতুবা সব না খেতে পেরে ‘সবই ছিল, তবু ঠিক যেন জমল না’— এ হেন মন-না-ভরা অতৃপ্তি নিয়ে বাড়ি ফিরে আসা।
এ বইও যেন ঠিক এই সমস্যাগুলোকেই মনে পড়িয়ে দিল। টেবিলে ছিল অনেক কিছুই, খেলামও প্রচুর, তবু যেন মন ভরল না— এমন অনুভূতি নিয়ে শেষ করলাম। প্রথমেই প্রশ্ন জাগে, কার জন্য বইটা লেখা? এই সময়ের কোনও জেলাশহরের কোনও এক কিশোরের কথা ভেবে, নাকি নস্টালজিয়ায় আক্রান্ত এক চুলে-পাক-ধরা মধ্যবয়সির জন্যে? মনে হল, লেখক বা প্রকাশক তাঁদের টার্গেট পাঠক স্থির করতে নিজেরাই হয়তো ধন্দে পড়েছেন। তাই, আলোচনা কখনও ছোটদের উপযোগী হালকা, কখনও বা প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য লেখা গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ।
তর্কের খাতিরে ধরে নেওয়া যাক, এ রকম একটা বই কৈশোরের জন্মদিনে উপহার দেওয়ার উপযোগী হিসেবেই তৈরি। তা হলে কিন্তু এই যুগের সারাক্ষণ ট্যাবলেটে গেম খেলে যাওয়া প্রজন্মের কথা ভেবে বইয়ের গৎ অনেকটাই বদলানো যেত। এই ইতিবৃত্তে গত শতকের ইতিহাস বেশি না দিয়ে হয়তো আধুনিক এবং বিদেশি উপাদানে বেশি গুরুত্ব দেওয়া উচিত ছিল। দুনিয়া বড্ড ছোট হয়ে গিয়েছে এখন— চল্লিশ বছর আগে আমাদের পাতে যা পড়ত, তার থেকে ঢের বেশি মেলে আজকের ডিজিটাল স্ক্রিনে। অগত্যা, লেখক ও প্রকাশককেও সজাগ হতে হবে বইকী। বিদেশে সম্প্রতি মার্ভেল কমিক্স তাদের সৃষ্ট সমস্ত চরিত্র নিয়ে এক এনসাইক্লোপিডিয়া প্রকাশ করেছে। তা থেকে এ হেন ইতিবৃত্ত কী ভাবে সাজানো যায় তার শিক্ষা নেওয়া সম্ভব।
তবে মানতেই হবে, দেশি প্রচেষ্টা আদৌ খাটো নয়, এত সুন্দর ছাপা, কাগজের গুণমান এবং বাঁধানো যে মন সত্যি ভরিয়ে দেয়। তবু বলব, এত ছবি বইতে, তবু কেন জানি মনে হল সেগুলো যেন মিশ খায়নি; পাতা ভরানোর কাজ করেই শুকনো মুখে দাঁড়িয়ে আছে। রঙিন ছবির ব্যবহার কেমন খাপছাড়া। তার মধ্যে একটাই বাংলা— সদাশিব, সেটাও মনে হল অন্যত্র হলে ভাল হত— কমিক্সে কৌতুকের সঙ্গে সদাশিবের কী যোগ?
বিভিন্ন পরিচ্ছেদের নামগুলো খাসা— এটাসেটামিক্স নামকরণ সার্থক! নানা লেখক ও শিল্পীর জীবনী উল্লেখযোগ্য, তবে তাঁদের নিয়ে আলাদা পরিচ্ছেদ করলে ভাল হত না? বিদেশি কমিক্স তো আমরা বাংলায় অনুবাদে পড়েছি। রয়, টিনটিন, বেতালের সব কাহিনি যাঁরা অনুবাদ করে আমাদের ছোটবেলা ভরিয়ে দিয়েছেন, তাঁদের সম্বন্ধে জানলে ভাল লাগত। আমি যে টিনটিনের বই মুখস্থ করেছি, তার লেখক তো নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী। তাঁর কৃতিত্ব তো হার্জের থেকেও বেশি। নামটা জেনেবুঝেই হার্জ লিখলাম, লেখকের মতো অ্যার্জে নয়। ফরাসি উচ্চারণ আমাদের জিভে যখন ঠিক আসে না, তখন তাকে বাংলা হরফে বদ্ধ না করাই বোধ করি শ্রেয়। তা হলে তো টিনটিনকে ত্যাঁতা বলতে হয়। প্রসঙ্গত, কুট্টুসের নাম যে আসলে স্নোয়ি, সেটাও উল্লেখ করা হয়নি।
পেলাম অনেক কিছুই, তবু খেতে পেলে শুতে চাওয়া বাঙালি নিশ্চয় জানতে চাইবে কী কী আর বাদ গেল? প্রথমেই মনে হয় কমিক্সের অর্থনীতি। ‘ব্যবসা’ শব্দটা সম্বন্ধে আমাদের অনেকেরই এখনও অদ্ভুত শুচিবায়ু আছে— যেন, অনৈতিক কোনও কাজ। কোনও কোনও অতিমাত্রিক জাতীয়তাবাদী প্রায়শই বলেন, বেসরকারি হাতে জাতীয় সম্পদ তুলে দেওয়া একেবারেই ঠিক নয়— ‘বেসরকারি’ শব্দটা আবার তাঁদের কাছে ‘বিদেশি’র সমার্থক। ফলে আমাদের ভাগের মা ‘হেরিটেজ’ প্রদর্শন বা সংরক্ষণের গঙ্গা পান না। বিদেশে চিত্রটা ঠিক উল্টো। ডিজনিল্যান্ডের কথা বাদ দিলাম, বেলজিয়ামে টিনটিন যে ভাবে প্রদর্শিত হয়, তার কণামাত্র নারায়ণ দেবনাথ কল্পনা করতে পারবেন না। বিদেশের মিউজিয়ামে সারা বছর ধরে নানা স্থায়ী-অস্থায়ী প্রদর্শনী চলে, পরিবারের সকলে উপভোগ করতে পারেন। শিল্প-সংস্কৃতি নিয়ে ব্যবসা চলবে না— এই দাবিতে আমাদের দেশে ঐতিহাসিক স্মারক সব ঘরবন্ধ থাকে। লেখক এই বন্ধ ঘর নিয়ে মুখ খুলতে চাননি।
বাঙালির সঙ্গে বিশ্বের তফাত আরও দুই জায়গায়। প্রথম হল, সিনেমা। বড় ত্রিমাত্রিক পর্দা জুড়ে মার্ভেলের ‘আমেরিকান হিরো’রা একসঙ্গে অন্যায়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে চলেছে অথবা ব্যাটম্যান আর সুপারম্যান তাদের মা-র নাম এক হওয়ার কারণে এক অন্যকে মারতে চলেছে, এমন ঘটনা আমাদের কমিক্সে নেই। ইতিবৃত্তেও তাই চলচ্চিত্রের স্থান হয়নি। টিনটিন থেকে স্পাইডারম্যান নিয়েই কিন্তু সিনেমা হয়েছে— সেটা নিয়ে অবশ্যই লেখা যেত। চিত্ররঙ্গ ছাড়া আর বাদ গেল ব্যঙ্গচিত্র— কার্টুন। কার্টুন সম্বন্ধে লিখতে গেলে কি রাজনীতির ছোঁয়া লাগত? রাজনীতি অবশ্য একটা লেখায় মুখ দেখিয়েছে, ‘প্রোপাগান্ডার প্রেক্ষাপটে’। তবে বিলেতের ‘টাইমস’ থেকে ঘরের ‘এবেলা’র মতো সংবাদপত্রগুলি ব্যঙ্গচিত্র কী ভাবে ব্যবহার করে, তার উল্লেখ ও ইতিহাস হাতে পেলে ভাল লাগত।
পরিশেষে বলি, ছোটদের হাতে তুলে দেওয়ার পক্ষে কি বইয়ের দাম একটু বেশি হয়ে গেল? অবশ্য, কলকাতায় আজকাল ভাল রেস্টুরেন্টে বুফে খেতে বসলে মোটের উপর এই রকমই দাম পড়ছে— ড্রিংকস আলাদা!
কমিক্স ইতিবৃত্ত। কৌশিক মজুমদার। লালমাটি, ৮০০.০০