শ্রীরামকৃষ্ণ-সৌধের মুখ্য স্থপতি

সেই থেকে শরৎ আমৃত্যু তিন দশক ধরে ‘পরের টাকা পরকে দিবি; তুই কি দিবি? তুই দিবি তোর হৃদয়, প্রাণ-মন, ভালবাসা’ মন্ত্রে এটিকে পরিণত করলেন বিশাল মহীরুহে।

Advertisement
দেবপ্রসাদ ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ২৩ জুন ২০১৯ ০০:৪৩
স্থিতপ্রজ্ঞ: শ্রীরামকৃষ্ণ-পার্ষদ স্বামী সারদানন্দ (১৮৬৫-১৯২৭)। ছবি: সম্পাদকীয় বিভাগ, উদ্বোধন

স্থিতপ্রজ্ঞ: শ্রীরামকৃষ্ণ-পার্ষদ স্বামী সারদানন্দ (১৮৬৫-১৯২৭)। ছবি: সম্পাদকীয় বিভাগ, উদ্বোধন

শ্রীরামকৃষ্ণের মুখে ‘শিবজ্ঞানে জীবসেবা’ শুনে নরেন্দ্রনাথ— ভবিষ্যতের স্বামী বিবেকানন্দ— এর মধ্যে দেখতে পেলেন ‘বহুজনসুখায় বহুজনহিতায়’ বেদান্তের প্রায়োগিক দিক। প্রায় চৌদ্দ বছর পর যখন এই ‘বীজ’টি তিনি প্রোথিত করলেন সুকর্ষিত ‘আত্মনো মোক্ষার্থং জগদ্ধিতায় চ’ ক্ষেত্রে, তখন স্বামী সারদানন্দ আমেরিকায় সাফল্যের সঙ্গে বেদান্ত প্রচারে ব্যস্ত। অচিরেই চারাগাছটির রক্ষা ও পুষ্টির ভার নেওয়ার জন্য ডেকে পাঠালেন ‘গুরুমহারাজ’কৃত ভার বহনের ক্ষমতার পরীক্ষায় সসম্মানে উত্তীর্ণ প্রিয় গুরুভাই ‘শরৎ’কে। সেই থেকে শরৎ আমৃত্যু তিন দশক ধরে ‘পরের টাকা পরকে দিবি; তুই কি দিবি? তুই দিবি তোর হৃদয়, প্রাণ-মন, ভালবাসা’ মন্ত্রে এটিকে পরিণত করলেন বিশাল মহীরুহে।

যে ভার বইতে পারে, বিধাতা বোধহয় তার উপর ভার চাপাতেই থাকেন। শ্রীমা তাঁকে শুধু তাঁর ‘ভারী’ বলেননি, বলেছিলেন, ‘শরৎটি আমার সর্বপ্রকারে পারে।’ রামকৃষ্ণ-সঙ্ঘের প্রথম সাধারণ সম্পাদক স্বামী সারদানন্দের উপর চাপতে থাকল সঙ্গিনীগণ-সহ সঙ্ঘজননী শ্রীমা ও তাঁর নানা সমস্যাসঙ্কুল পরিবারের সব দায়-দায়িত্ব। সঙ্গে যোগিন মার কন্যা গণুর অকাল মৃত্যুর পর তাঁর তিন নাবালক পুত্রের দায়িত্ব, তিন-চার খেপে মোট প্রায় ১৩-১৪ বছর সঙ্ঘের বাংলা মুখপত্র ‘উদ্বোধন’-এর সম্পাদনা, একক বা যুগ্ম ভাবে। এও যেন যথেষ্ট নয়— তিনি আপন প্রশস্ত স্কন্ধে তুলে নিলেন একে একে ‘উদ্বোধন’ পত্রিকার আর্থিক দায়িত্ব, কলকাতায় ও জয়রামবাটিতে শ্রীমায়ের নিজস্ব বসতবাটি নির্মাণ, ভগিনী ক্রিস্টিনকে স্বদেশে ফিরে যেতে হলে সম্প্রসারিত নিবেদিতা বিদ্যালয়ের দায়িত্ব, শ্রীমায়ের দেহান্তের পর বেলুড়ে ও জয়রামবাটীতে তাঁর মন্দির নির্মাণ, বেলুড়ে স্বামীজির মন্দিরের অসমাপ্ত কাজ সমাপন, প্রথম সঙ্ঘাধ্যক্ষ স্বামী ব্রহ্মানন্দের দেহান্তের পর তাঁর মন্দির নির্মাণ। তা ছাড়া ছিল পুস্তক ও প্রবন্ধ রচনা, বক্তৃতা, ইত্যাদি নানা কাজ। ১৯১৬-১৭ খ্রিস্টাব্দে রাজরোষ থেকে মঠ-মিশনকে রক্ষা করার ক্ষেত্রে তিনি প্রধান ভূমিকা নিয়েছিলেন। পূর্বাশ্রমের কর্তব্যও তিনি অবহেলা করেননি কখনও। রোগীর সেবা ছিল যেন তাঁর সহজাত কাজ। যখন মনে হল অন্তর্ধানের সময় আগতপ্রায়, সাধারণ সম্মেলন ডেকে আগামী দিনের সঙ্ঘ পরিচালকদের দিয়ে গেলেন পরিচালনার চাবিকাঠির হদিশ। ১৯২৬ সালে সেই প্রথম সঙ্ঘের মহাসম্মেলন আয়োজিত হয়। সেখানে শ্রীরামকৃষ্ণের জীবন ও বাণী, তার প্রচার, প্রসার ও সঙ্ঘ-পরিচালনার বিষয়গুলি গভীর ভাবে আলোচিত হয়।

Advertisement

আধ্যাত্মিক সাধনা— যে উদ্দেশ্যে এই সচ্ছল ব্রাহ্মণ পরিবারের ডাক্তারি ছাত্রটি এসেছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণের কাছে— তিনি কখনও অবহেলা করেননি। তাঁর নিজের উক্তিই প্রমাণ করে যে তিনি অভীষ্ট ‘সর্বভূতে ব্রহ্মদর্শন’ লাভ করেছিলেন। প্রামাণিক বলে স্বীকৃত ও গুণিজন সমাদৃত তাঁর রচিত ‘শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণলীলাপ্রসঙ্গ’তে তিনি শ্রীরামকৃষ্ণের নানা আধ্যাত্মিক অনুভূতি শাস্ত্রের আলোকে ব্যাখ্যা করেছেন। জিজ্ঞাসিত হয়ে একজন শিষ্যস্থানীয়কে বলেছিলেন যে, তিনি এমন কিছুই লেখেননি যা তিনি নিজে উপলব্ধি করেননি। আবার, শ্রীরামকৃষ্ণের সাক্ষাৎ শিষ্যগণের মধ্যে তিনিই একমাত্র যিনি আনুষ্ঠানিক ভাবে কৌল দীক্ষা নিয়ে তন্ত্রসাধনা করেছিলেন। যার ফল— অনবদ্য গ্রন্থ ‘ভারতে শক্তিপূজা’।

এমনই এক অসাধারণ ব্যক্তির সার্ধশতজন্মবর্ষ পূর্তিকে স্মরণীয় করে রাখার প্রয়াসে সঙ্কলিত হয় বর্তমান আলোচ্য ‘স্বামী সারদানন্দ/ এক অনন্য জীবন’ গ্রন্থখানি। গ্রন্থের ভূমিকায় বর্তমান সঙ্ঘাধ্যক্ষ স্বামী স্মরণানন্দ লিখছেন: ‘‘স্বামী সারদানন্দ ছিলেন একাধারে শ্রীরামকৃষ্ণ-আদর্শের সার্থক রূপকার, শাস্ত্রজ্ঞ, অধ্যাত্মজীবনের পথপ্রদর্শক, নিপুণ সঙ্ঘ-পরিচালক, অক্লান্ত কর্মী, পত্র-সাহিত্যে বিশিষ্ট লেখক; আর তাঁর ছিল অফুরন্ত সহনশীলতা, দীন-দুঃখী-অত্যাচারিতের জন্য গভীর সহমর্মিতা, অবাঞ্ছিত-বিতাড়িত-ব্রাত্য মানুষের জন্য সমবেদনা, সর্বোপরি অভিমানশূন্যতা ও তীব্র কর্মের মধ্যেও পূর্ণ নিরাসক্তি। এছাড়া জাগতিক বিভিন্ন বিষয়ে ছিল তাঁর গভীর জ্ঞান, যা দেখে বিস্মিত হতে হয়।’’ আবার, ‘‘ধ্যানপ্রিয়তা তাঁর আজীবনের সঙ্গী। নীলকণ্ঠ পাহাড়ে পথ হারিয়ে তিনি দল থেকে বিচ্ছিন্ন। শ্বাপদসঙ্কুল অরণ্যে এক পাথরের ওপর কেটে গেল সারারাত। সে-ধ্যান এত গভীর ছিল যে, পরদিন তুরীয়ানন্দজী তাঁকে খুঁজে পেয়ে ডাকাডাকি করে তবে তাঁর ধ্যান ভাঙাতে পারলেন!’’

ছয়টি অংশে বিন্যস্ত গ্রন্থখানির প্রথম ‘স্বামী সারদানন্দ-প্রসঙ্গে’ অংশে আছে মোট কুড়িটি প্রবন্ধ। বিশিষ্ট সন্ন্যাসী, সন্ন্যাসিনী ও লেখকরা তাঁকে দেখতে চেয়েছেন বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে। স্বামী পূর্ণাত্মানন্দ স্বামী সারদানন্দের মন্ত্রশিষ্য দ্বাদশ সঙ্ঘাধ্যক্ষ স্বামী ভূতেশানন্দের মধ্যে দেখেছেন তাঁর গুরুর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, স্বামী বিমলাত্মানন্দ ও স্বামী দিব্যসুধানন্দ আলোচনা করেছেন গুরুভাইদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক, প্রব্রাজিকা ভাস্বরপ্রাণা উপস্থিত করেছেন তাঁর মাতৃভাব, প্রব্রাজিকা সত্যব্রতপ্রাণা ও প্রব্রাজিকা বেদান্তপ্রাণা যথাক্রমে শ্রীসারদা মঠ স্থাপনে তাঁর পরিকল্পনা ও রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ ভাবান্দোলনে তাঁর ভূমিকা। নিশীথ রায়চৌধুরী, রমাপ্রসন্ন ভট্টাচার্য ও পারমিতা বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন কোন দৃষ্টিতে তাঁকে দেখেছিলেন নিবেদিতা, শ্রীরামকৃষ্ণের পুরুষ ও মহিলা ভক্তরা।

‘স্বামী সারদানন্দ-স্মরণে, মননে ও বিশ্লেষণে’ নামাঙ্কিত দ্বিতীয় অংশে আছে দশটি প্রবন্ধ। স্বামী আত্মপ্রিয়ানন্দ [মূল ইংরাজিতে, ভাষান্তর সুমনা সাহার] আলোচনা করেছেন স্বামী সারদানন্দের দৃষ্টিতে মানুষ। শৌটীর কিশোর চট্টোপাধ্যায় বিচার করেছেন রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ সাহিত্যে ‘লীলাপ্রসঙ্গ’-এর স্থান, স্বামী চৈতন্যানন্দ তাঁকে দেখেছেন বিবেকানন্দ-বাণীর মূর্ত বিগ্রহরূপে, গীতশ্রী বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিশ্লেষণে তিনি প্রধানত আমেরিকায় বেদান্ত-প্রচারে স্বামীজির সফল উত্তরসূরি, শিবতোষ বাগচীর রচনায় ধরা পড়ে তাঁর বিজ্ঞানচেতনা।

পরের অংশে রাধারমণ চক্রবর্তী, অরিজিৎ সরকার, মধুমিতা সেন ও শেখ মকবুল ইসলাম আলোচনা করেছেন ‘সমাজ, ইতিহাস ও অর্থনীতি’তে সারদানন্দের ভাবনা। ‘শিক্ষা, সাহিত্য, শিল্প, সংস্কৃতি ও ধর্ম’ বিভাগে এগারোটি প্রবন্ধে স্বামী সুপর্ণানন্দ আলোচনা করেন তাঁর শিক্ষাচিন্তা, অরুণ ঘোষ তাঁর শিল্পভাবনা, তপনকুমার ঘোষ দেখিয়েছেন তাঁর ইংরেজি প্রবন্ধাদিতে ভাষাশৈলী কোন উচ্চস্তরে পৌঁছেছিল, স্বামী একচিত্তানন্দের বিষয় সারদানন্দের সঙ্গীতে বিবেকানন্দের প্রভাব। তাঁর ‘মাতৃসাধনা’ এবং ‘বেদান্তচিন্তা’ নিয়ে লিখেছেন যথাক্রমে স্বামী বলভদ্রানন্দ ও প্রব্রাজিকা আপ্তকামপ্রাণা।

‘অন্য চোখে অন্য রূপে’ বিভাগে তেরোটি রচনা। স্বামী চন্দ্রকান্তানন্দ আলোচনা করেছেন তাঁর পত্রাবলি, স্বামী সন্দর্শনানন্দের বিষয় বিদেশিদের দৃষ্টিতে, স্বামী তাপহরানন্দের— অধস্তন কর্মীদের সঙ্গে তাঁর ব্যবহার। প্রব্রাজিকা নির্বাণপ্রাণা এবং সুমনা সাহা পৃথক ভাবে লিখেছেন তাঁর ব্যক্তিত্ব প্রসঙ্গে। বাগবাজারে ‘মায়ের বাড়ি’র ভৌগোলিক, ঐতিহাসিক ও আর্থিক পটভূমি বিশ্লেষণ করেছেন তড়িৎকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়।

শেষ ‘বিবিধ’ বিভাগে আছে স্বামী সারদানন্দের ইংরেজি রচনার অনুবাদ; স্বামী দিব্যবিভানন্দকৃত সাতটি ও অপূর্ব পাল-কৃত পাঁচটি। ভাষা ও ভাবের এমন সুন্দর সামঞ্জস্য যে অনুবাদ মনেই হয় না। নিশীথ রায়চৌধুরীর প্রস্তুত করা সারদানন্দের জীবনপঞ্জি প্রশংসনীয়।

স্বামী চৈতন্যানন্দের সম্পাদনা ও উপস্থাপনা এক কথায় চমৎকার। মুদ্রণ ত্রুটির প্রায় অনুপস্থিতি উদ্বোধন কার্যালয়ের ঐতিহ্যানুগ। গ্রন্থখানি রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ সাহিত্যে নিঃসন্দেহে একটি মূল্যবান সংযোজন।

এবার শুধু খবর পড়া নয়, খবর দেখাও।সাবস্ক্রাইব করুনআমাদেরYouTube Channel - এ।

আরও পড়ুন
Advertisement