ই-টাকার সঠিক ব্যবহার কিন্তু ডিজিটাল ওয়ালেটের সীমাবদ্ধতা পেরিয়ে জীবনকে অনেক সহজ করে দিতে পারে। প্রতীকী ছবি।
কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী বাজেট প্রস্তাবে ডিজিটাল টাকায় সিলমোহর দিয়ে দিয়েছেন। শীর্ষ ব্যাঙ্কও এই প্রস্তাব রূপায়ণে কোমর বেঁধে লেগে পড়েছে। এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা।
ঘটনাক্রম সাজালে মনে হতেই পারে যে ডিজিটাল টাকা যেন শুধু ফোনের মুঠোতে ভরার প্রতীক্ষায়। তাই উপরের অনুচ্ছেদের শেষ বাক্যটি লেখা। কিন্তু যদি সব ঠিকঠাক করে এই প্রস্তাবকে রূপায়ণ করতে হয়, তা হলে হয়ত ডিজিটাল টাকা ফোনে ভরার থেকে আমরা এখনও অনেক কদম পিছিয়েই। তবে সাম্প্রতিক ইতিহাস সাক্ষী, কোনও প্রকল্প রূপায়ণের প্রস্তাব কেন্দ্রীয় মন্ত্রীদের কাছ থেকে এলেই তা আগে রূপায়ণ করে তারপর তার ত্রুটি সংশোধনের প্রবণতা বাড়ছেই। তাতে নাগরিকের স্বার্থ যতই ক্ষুণ্ণ হোক না কেন।
তবে যবেই আসুক না কেন, ডিজিটাল টাকা আসছেই এ নিয়ে কোনও সংশয় নেই। আমাদের মনে তাই স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠছে ভিম বা ইউপিআই নির্ভর নানান ওয়ালেট থেকে এর পার্থক্য কি? এই মুহূর্তে কোনও শীর্ষ ব্যাঙ্ক পরিচালিত সংশ্লিষ্ট দেশের ডিজিটাল মুদ্রা বলে হাতের কাছে আছে একমাত্র নাইজেরিয়ার ইনাইরা। ভারতের মতো অন্য যে সব দেশ এ নিয়ে কাজ শুরু করেছে তাদের মধ্যে অবশ্যই আছে চিন। তাই ইনাইরাকে ধরেই না হয় এগোনো যাক।
প্রথমেই মাথায় রাখতে হবে চরিত্রগত ভাবে এটি মুদ্রা এবং ওয়ালেটে সঞ্চিত থাকা আপনার আয়ের অংশ নয়। তাই চরিত্রগত ভাবেই এর গঠন এক অর্থে মালিকানাহীন। ব্যাপারটা বোঝার জন্য একটা সহজ উদাহরণ নেওয়া যাক। আপনার পকেট থেকে যদি একটা ১০ টাকার নোট পড়ে যায় আর অন্য কেউ তা কুড়িয়ে পায়, আপনি কি প্রমাণ করতে পারবেন যে সেটা আপনার? বা আপনি তাঁকে দেননি? কিন্তু আপনি যদি ওয়ালেট থেকে কাউকে টাকা পাঠান, তার একটা ইতিহাস কিন্তু থাকবে। এবং কেউ যদি আপনার পাসওয়ার্ড চুরি করেন সেখান থেকে টাকা সরান তা কিন্তু খুঁজে বার করা সম্ভব। কিন্তু আপনার পকেট থেকে টাকা নিয়ে গেলে তা যে আপনার, তা প্রমাণ করার কোনও রাস্তাই নেই যদি না কেউ সেই চৌর্যকর্মটি কেউ দেখে ফেলে।
ই-টাকা বা ডিজিটাল টাকার ক্ষেত্রেও তার ব্যবহারিক চরিত্রও নিত্য ব্যবহৃত টাকার মতোই হওয়া উচিত। কিন্তু তা হবে কিনা তা জানার এখনও কোনও উপায় নেই। উপায় নেই কারণ, সরকার বা শীর্ষ ব্যাঙ্ক এনিয়ে কোনও উচ্চবাচ্য এখনও করেনি। অর্থমন্ত্রক থেকে এই টাকার ব্যাপারে প্রযুক্তির সিদ্ধান্ত শীর্ষব্যাঙ্কের উপরই ছেড়ে দিয়েছে। তবে আধার-এর বিশ্বকর্মা এবং ভারতের অন্যতম তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থা ইনফোসিসের সহ প্রতিষ্ঠাতা নন্দন নিলেকানি সম্প্রতি একটি সাক্ষাৎকারে বলেছেন ই-টাকা প্রযুক্তিগত রূপ ছাড়া বাকি সব অর্থেই প্রথাগত টাকার প্রতিলিপি হওয়াই বাঞ্ছনীয়।
তিনি যা বলছেন তা হল, আমরা যখন মিষ্টির দোকানে গিয়ে রসগোল্লা কিনে টাকা দিয়ে থাকি তা সরকারের খাতায় লেখা হয়ে যায় না। হ্যাঁ। ক্রেডিট বা ডেবিট কার্ডে দাম চোকালে তার তথ্য অবশ্যই নথিভুক্ত হবে। কিন্তু সেটাই তো কার্ডের চরিত্র। কিন্তু নগদের চরিত্রটাই হল নাম-গোত্রহীন লেনদেন। আর আপনার দেওয়া নোটের নম্বরও কেউ জানতে পারে না। আমরা কি নিজেরাই মাথায় রাখি এই নম্বর?
নিলেকানি প্রযুক্তি বিশারদ। তিনি কথা ভেবেই বলেছেন। তাঁর বক্তব্যের সারমর্ম হল এই লেনদেনের চরিত্র যে হেতু টাকার মতো সর্বজনীন হবে তাই তা নগদ লেনদেনের চরিত্র মেনে যেন অধরাই থেকে যায়।
তাই কোথাও গিয়ে নিন্দুকেরা বলছেন নগদ লেনদেনের উপর নজরদারি করার জন্যই সরকার হয়ত এই পথে হাঁটছেন। কিন্তু তা নিন্দুকের কথা। ই-টাকার সঠিক ব্যবহার কিন্তু ডিজিটাল ওয়ালেটের সীমাবদ্ধতা পেরিয়ে জীবনকে অনেক সহজ করে দিতে পারে।
এই প্রসঙ্গ ধরেই আফ্রিকায় ফেরা যাক। দৈনন্দিন সমস্যা সামলাতেই কিন্তু প্রযুক্তির উদ্ভাবন হয়। যেমন ওয়ালেটের জনক এম পেসার ব্যবহার। কেনিয়ায় একটা সমস্যা খুবই পীড়াদায়ক হয়ে উঠেছিল। টাকা ছিনতাই হয়ে যাওয়ার ভয়, অন্যদিকে প্রত্যন্ত অঞ্চলে ব্যাঙ্কবিহীন প্রান্তরে কর্মরত শ্রমিক হাতে দুষ্টু লোকেদের হাত এড়িয়ে টাকা পৌঁছে দেওয়ার চ্যালেঞ্জ এবং তা সেই চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করার জন্য সশস্ত্র রক্ষী শুধু নয়, আকাশপথে নগদ পাঠানোর খরচও বাধ সাধছিল প্রকল্প রূপায়ণে। আর এই সমস্যার সমাধানেই এম পেসার উদ্ভাবন। ক্রেতা ও বিক্রেতার এম পেসার অ্যাকাউন্ট থাকলেই পরস্পরের মধ্যে লেনদেন করা সম্ভব হয়ে উঠল, সংস্থারা কর্মীদের মাস মাইনে পাঠাতে শুরু করল এম পেসায়। রক্ষী আর নগদ পরিবহণের খরচ কমল।
এ বার নাইজিরিয়া এগিয়ে গেল এক কদম। ইতিমধ্যে ব্লকচেন প্রযুক্তি হাতের মুঠোয়। ভাবুন সেই সময়ের কথা। যখন মাইনে মিলত নগদে। মাস পয়লা অফিসের ক্যাশ কাউন্টারে দাঁড়িয়ে খাতায় সই করে নগদ মাইনে নিয়ে বাড়ি ফিরতেন বাবুরা। গিন্নিরা তা থেকে টাকা সরিয়ে রাখতেন দুর্দিনের জন্য। সহজ করে বললে এবার ই-মুদ্রাও সেই ভাবেই কাজ করবে। কম্পিউটারে একটা লেজার থাকবে। সেই লেজার হিসাব রাখবে টাকার ভান্ডারের। যে ভাবে কাজ করে শীর্ষ ব্যাঙ্কের কোষাগার। এবং বৈদ্যুতিন প্রযুক্তিতেই সেই টাকা আপনার আমার মোবাইলে এমন ভাবে গুঁজে দেওয়া সম্ভব যাতে যে দিল সে জানল আপনাকে দিয়েছে, কিন্তু আর কেউ জানল না আপনার হাতে ঠিক কোন ই-মুদ্রা এল। আবার উল্টোটাও সম্ভব। প্রতিটি লেনদেনেই সরকারের নজরদারি সম্ভব। সিগারেট কিনলে কোথা থেকে কিনলেন। কত টাকা খরচ করলেন ইত্যাদি। নিলেকানি এটাই যাতে না হয় তা দেখতে বলেছেন।
ই-মুদ্রার ক্ষেত্রে সুবিধা হল প্রত্যন্ত অঞ্চলেও নগদ পৌঁছনোর ঝক্কি আর খরচ থাকল না। শুধু মোবাইল নম্বরটাই যথেষ্ট। মোবাইলের অধিকারীর পাসওয়ার্ড হয়ে থাকল আলমারির চাবি হয়ে। আর ব্যাঙ্কে অ্যাকাউন্ট খোলার ঝক্কিও থাকল না। সরকারি অনুদান পাঠাতে ব্যাঙ্কের উপর নির্ভর করতে হল না। নোট ছাপানোর খরচও কমে গেল। জাল নোটের ঝামেলাও থাকল না। নাইজেরিয়া এই সুযোগটারই সদ্ব্যবহার করতে চাইছে ওয়ালেটের সংস্থা নির্ভরতা এড়িয়ে।
আমরাও বোধহয় তাই চাইছি। কিন্তু ঠিক কী ভাবে তা এখনও স্পষ্ট নয়। নাইজেরিয়া এই রাস্তায় হেঁটেছে ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থায় হ্যাকিং-এ ব্যতিব্যস্ত হয়ে। ছ’মাসও হয়নি নাইজেরিয়ায় এই মুদ্রা চালু হওয়ার পর। তাই নাইজেরিয়ার অভিজ্ঞতার উপর ভিত্তি করে এই ব্যবস্থার সুরক্ষা নিয়ে কোনও আলোচনা করার জায়গাও তৈরি হয়নি। তবে ধারণার জায়গা থেকে বলা যায়, পকেটে ম্যানিব্যাগ নিতে ভুলে গেলে আর চিন্তা থাকবে না। মোবাইলে ই-টাকা থাকবে। উল্টোদিকের মানুষটার মোবাইল থাকলেই আপনি লেনদেন করতে পারবেন ব্যাঙ্কের উপর নির্ভর না করেই। কিন্তু সত্যিই কি পারবেন? তা বলবে শীর্ষ ব্যাঙ্ক। পারবেন কি সরকারের নজরাদারি ছাড়াই সন্তানের জন্য চকোলেট কিনতে? তা জানার জন্য আমাদের আরও অপেক্ষা করতে হবে।