সুরুল রাজবাড়ি
বিশ্বভারতী ক্যাম্পাসের অধিকাংশ জমির মালিকানা এক সময়ে ছিল এই পরিবারেরই। তাঁদের সঙ্গে হৃদ্যতার সুবাদে কিনে নেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। বীরভূমের সেই সুরুল রাজবাড়ির সরকারদের পুজো এ বার ২৮৯ বছরে পা দিল।
অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি। বর্ধমানের ছোট নীলপুরের ঘোষবাড়ির ছেলে ভরতচন্দ্র স্ত্রী বিমলা দেবীকে নিয়ে চলে আসেন সুরুলে। সন্তানলাভের আশায় গুরু বাসুদেব ভট্টাচার্যের বাড়িতে আশ্রয় নেন দু’জনে। সুরুল ছিল বৈষ্ণব ধর্মগুরু বাসুদেবের শ্রীপাট। গুরুদেবের নির্দেশেই ভরতচন্দ্র থেকে যান সুরুলে। আর বর্ধমানে ফিরে যাননি। তাঁর পুত্র কৃষ্ণহরি ও তাঁর ছেলেরা সেই সময়ে ফরাসি ও ইংরেজ কুঠিয়ালদের সঙ্গে ব্যবসা করে পরিবারের শ্রীবৃদ্ধি করেন। তাঁর আমলেই নির্মিত হয় পঞ্চরত্ন মন্দির। পরবর্তীকালে অবশ্য সম্পত্তি ও প্রতিপত্তির দৌড়ে তাঁকে টেক্কা দিয়েছিলেন নাতি শ্রীনিবাস। পাঁচ খিলানের একটি ঠাকুরদালান নির্মাণ করিয়েছিলেন তিনি। সে যুগে খরচ পড়েছিল আঠারো হাজার টাকা!
ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, সুরুলের স্থানীয় বাণিজ্যকুঠিতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রেসিডেন্ট জন চিপ সাহেবের সঙ্গে ব্যবসা করে সম্পদ বৃদ্ধি করেছিল সরকার পরিবার। জাহাজের পাল তৈরি হত যে কাপড় দিয়ে, সেই কাপড়, নীল, চিনির ব্যবসা ছিল তাঁদের। কৃষ্ণহরির মৃত্যুর পরে তাঁর তিন ছেলে যাদবেন্দ্র, মাধবেন্দ্র ও কালীচরণের মধ্যে সম্পত্তি নিয়ে সমস্যা এতটাই তুঙ্গে ওঠে যে, জমিদারি ভাগ হয়ে গিয়েছিল। যাদবেন্দ্র ও কালীচরণ একসঙ্গে থাকেন আদি বাড়িতে। লোকমুখে তাঁরা ‘বড় তরফ’। পাশেই বাড়ি করে আলাদা হয়ে যান মাধবেন্দ্র। তিনি ‘ছোট তরফ’-এর প্রতিষ্ঠাতা।
বড় তরফের উত্তরসূরি স্মৃতিকবি সরকার। বাড়ির প্রাচীন পুজো সম্পর্কে বললেন, " সপ্তমীর সকালে দোলা নিয়ে পুকুর ঘাটে ঘট ভরতে যাওয়ার সময় থেকেই শুরু হয়ে যায় পুজোর জাঁকজমক। চলে আগমনীর গান। জমিদারবাড়িতে দোলা ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে ঢোল, বাঁশির বাজনার সঙ্গে তাল মিলিয়ে মন্দিরের সামনের দোতলা বারান্দা থেকে গুড়ের তৈরি 'সিড়ির নাড়ু' নীচে ছোড়েন বাড়ির বয়স্ক সদস্যরা। শ্রীনিবাস সরকারের সময় থেকেই তিন দিনের যাত্রাগানের আসর বসত। সে রেওয়াজ আজও অক্ষুণ্ণ।"
এ বাড়িতে সন্ধিপুজোর বলি প্রসঙ্গে স্মৃতিকবি বলেন, “সপ্তমীতে চালকুমড়ো, অষ্টমীতে একটি কালো ছাগ ও নবমীতে আখ এবং চালকুমড়ো বলি হয়। আমাদের পুজোয় অন্নভোগ হয় না। দেবীকে ফল, বিভিন্ন মিষ্টি এবং শুকনো প্রসাদ দেওয়া হয়। পুজোর চার দিন দু’বেলা ১০৮ রকমের থালায় দেবীকে এই নৈবেদ্য দেওয়া হয়।’’
বাড়ির বড় তরফের আর এক উত্তরসূরি নবনীতা সরকার জানান, “দুর্গাপুজো ছাড়াও আমাদের বাড়িতে লক্ষ্মী-জনার্দন এবং অন্যান্য দেবদেবীর নিত্যপুজো হয় প্রতিদিন। দেবীকে চার দিনই ডাকের সাজ ও সোনার অলঙ্কারে সাজানো হয়। পুজোর চার দিন মন্দিরের দালানে রেড়ির তেলে জ্বলে ওঠে বেলজিয়াম গ্লাসে নির্মিত প্রাচীন ঝাড়বাতি। তার আলোয় মায়ের মন্দির ঝলমল করে ওঠে। দশমীর সকাল থেকে অপরাজিতা গাছে তাগা বাঁধার রেওয়াজ আছে। প্রচুর মানুষ আসেন সেই তাগা বাঁধার জন্য। আগে কাহারদের কাঁধে দেবীর বিসর্জন হত। এখন সে রেওয়াজের পরিবর্তন ঘটেছে৷’’
এই প্রতিবেদনটি ‘আনন্দ উৎসব’ ফিচারের একটি অংশ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy