সিদ্ধেশ্বরী কালী (ঠনঠনিয়া)
‘কালী’ নামটার মধ্যেই মিশে আছে ভয়-ভক্তি মিশ্রিত এত অনুভূতি। একাধারে তিনি ধ্বংস অন্যদিকে সৃষ্টি-স্থিতি ও সৌভাগ্যের দেবী। বাঙালির কালীভক্তি বহু যুগের। এক সময় কালী গৃহে পূজিতা হতেন না। পুজো হত শ্মশানে, রাস্তার তেমাথার মোড়ে কিংবা মন্দিরে। দেবী পূজিতা হতেন যন্ত্রে, ঘটে, পটে। শোনা যায়, ষোড়শ শতকে নবদ্বীপের প্রসিদ্ধ তন্ত্রসাধক কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ প্রথম কালীমূর্তি গড়ে কালীপুজোর প্রচলণ করেছিলেন। তার পরর্বতী কালে নদীয়ারাজ কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের আমলে কার্তিকী অমাবস্যায় কালীপুজোর ব্যাপক প্রসার ঘটেছিল। বাংলার নানা প্রান্তে গড়ে ওঠে কালীমন্দির। শুধু কালীঘাট কিংবা দক্ষিণেশ্বর নয়, কলকাতায় রয়েছে ছোট বড় বহু প্রাচীন কালীমন্দির। তার মধ্যে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য মন্দিরের সন্ধান রইল এখানে।
সিদ্ধেশ্বরী কালী (ঠনঠনিয়া)— সে কালে ডাকাতদের হাত থেকে বাঁচতে স্থানীয়েরা একটি ঘণ্টা বেঁধে দিয়েছিলেন। দূর থেকে ডাকাতদল আসছে দেখলেই ওই ঘণ্টা বাজিয়ে সতর্ক করে দেওয়া হত এলাকার মানুষকে। সেই অঞ্চল আজকের ঠনঠনে এলাকা। জনশ্রুতি ঠন ঠন করে সেই ঘণ্টা বাজত বলেই এলাকার নামকরণ হয়েছিল ঠনঠনে বা ঠনঠনিয়া।
বহু যুগ আগে সেখানেই উদয়নারায়ণ ব্রহ্মচারী নামে এক তান্ত্রিক সন্ন্যাসী একটি উঁচু মাটির ঢিবির উপর চালাঘরে পঞ্চমুণ্ডির আসন প্রতিষ্ঠা করে কালীসাধনা করতেন। কাছেই বাহির সিমলা অঞ্চলে থাকতেন রামশঙ্কর ঘোষ, যিনি পরবর্তী কালে শঙ্কর ঘোষ নামে পরিচিত হন। তিনি ছিলেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বেনিয়ান। শোনা যায়, তাঁর সঙ্গে উদয়নারায়ণ ব্রহ্মচারীর যোগাযোগ ছিল। পরে উদয়নারায়ণ কাশী যাওয়ার আগে শঙ্কর ঘোষকে দেবীর দায়িত্ব দিয়ে যান। শঙ্কর ঘোষ সেখানেই পঞ্চমুণ্ডির আসনের উপর কালীমূর্তি ও ঘট প্রতিষ্ঠা করে একটি মন্দির তৈরি করিয়েছিলেন, যা কিনা কালক্রমে হয়ে উঠল ঠনঠনের প্রসিদ্ধ সিদ্ধেশ্বরী কালীমন্দির।
মন্দিরের গায়ের ফলকে দেখা যায় বাংলার ১১১০ সনে মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা হয়েছিল, কিন্তু এ নিয়ে মতান্তর রয়েছে। উল্লেখযোগ্য বিষয় হল, শঙ্কর ঘোষ মন্দিরের প্রধান সেবায়েত হলেও পুজোর সঙ্কল্প হত উদয়নারায়ণ ব্রহ্মচারীর নামে। সাবেক রীতি মেনে এখনও তেমনটাই হয়ে আসছে।
মন্দির সূত্রে জানা গেল, দীপান্বিতা কালীপুজোর তোড়জোড় শুরু হয়ে যায় কৃষ্ণপক্ষের পঞ্চমী থেকেই। তখন দেবীর বিগ্রহের অঙ্গরাগ করা হয়। ত্রয়োদশীর দিন তাঁকে পঞ্চমুণ্ডির আসনে প্রতিষ্ঠা করা হয়। সে দিন স্নান করিয়ে রাতে পরানো হয় লালপেড়ে সাদা শাড়ি। একে বলে ‘কুমারী বেশ’। কালীপুজোর দিন পরানো হয় বেনারসি শাড়ি। এ ছাড়া বছরভর দেবীকে পরানো হয় ভক্তদের দেওয়া নানা ধরনের শাড়ি। ছাপা শাড়ি থেকে শুরু করে সেই তালিকায় থাকে ঢাকাই, কাঞ্জিভরম, তাঁতের শাড়ি— সবই।
আর একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হল, দেবীর বেশির ভাগ গয়না রুপোর, শুধু জিভটি সোনার তৈরি। দেবীর গলায় শোভা পায় রুপোর তৈরি ৪১টি মুণ্ডের মালা। মন্দিরে অন্নভোগ না হলেও কালীপুজোর বিশেষ ভোগে দেওয়া হয় লুচি, আলু-পটল ভাজা, আলুর দম, ধোঁকার ডালনা ও নানা ধরনের মিষ্টি। আজও ভক্তদের মানতের বলিদান হয় এখানে। কার্তিক মাসের অমাবস্যায় বিশেষ পুজো ছাড়াও মাঘ মাসে রটন্তী কালী ও জ্যৈষ্ঠ মাসে ফলহারিণী কালীপুজো হয়।
এই মন্দিরে এসেছেন শ্রীরামকৃষ্ণ, সাধক কবি রামপ্রসাদ সেন, কমলাকান্ত চক্রবর্তী প্রমুখ সাধক। শ্রীরামকৃষ্ণের মন্ত্রশিষ্য স্বামী সুবোধানন্দ, যিনি ‘খোকা মহারাজ’ নামে পরিচিত তিনি ছিলেন শঙ্কর ঘোষের পরিবারের সদস্য।অতীতের সেই ঘণ্টা আজ আর নেই। তবুও ভক্তি বিশ্বাস আর কিংবদন্তিতে উজ্জ্বল ঠনঠনে কালীবাড়ি।
সিদ্ধেশ্বরী কালী (বাগবাজার): কালীপুজোর রাতে আজও তন্ত্রোক্ত বিধিতে দেবীর পুজো হয়।
সিদ্ধেশ্বরী কালী (বাগবাজার) — ভাগীরথীর তীরে অতীতের কুমোরটুলি অঞ্চল ছিল ঘন জঙ্গলে ঢাকা। তখনও আশেপাশে গড়ে ওঠেনি জনবসতি। গঙ্গাতীরে হোগলা পাতার ছাউনির নীচে কালীবর তপস্বী নামের এক সন্ন্যাসী একটি মূর্তি তৈরি করে পুজো করতেন। পরে কুমোরটুলির গোবিন্দরাম মিত্রের পরিবার বর্তমান মন্দিরটি তৈরি করে দেন। শ্রীরামকৃষ্ণ এই মন্দিরে এসেছিলেন। শোনা যায়, নটসম্রাট গিরিশচন্দ্র ঘোষ এই মন্দিরের দেবীকে ‘উত্তর কলকাতার গিন্নি’ বলতেন। কালীপুজোর রাতে আজও তন্ত্রোক্ত বিধিতে দেবীর পুজো হয়। তাই পুরোহিত আদা, চানাচুর ও কারণ খেয়ে পুজোয় বসেন। জনশ্রুতি, আগে নরবলি হত। আজও এখানে পশু বলি হয়। কার্তিকী অমাবস্যা ছাড়াও বুদ্ধ পূর্ণিমায় ফুলদোল এবং জ্যৈষ্ঠ মাসের ফলহারিণী কালীপুজো সাড়ম্বরে পালিত হয়। রাজা নবকৃষ্ণ দেবের নির্দেশ অনুসারে সে কাল থেকে এ কাল শোভাবাজার বাজার থেকে সবজি আসে ভোগের জন্য। কালীপুজোর ভোগে থাকে খিচুড়ি, ভাজা, সাদা ভাত, ডাল, নানা ধরনের তরকারি, ডালনা, মাছ, চাটনি, পায়েস ইত্যাদি।
ফিরিঙ্গি কালী: ১৯৮৭ সালে কংক্রিটের মূর্তিটি তৈরি করা হয়।
ফিরিঙ্গি কালী (বৌবাজার)— এই মন্দিরের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে অ্যান্টনি কবিয়ালের নাম ও নানা কাহিনি। মন্দিরের প্রতিষ্ঠাকাল নিয়েও গবেষকদের মধ্যে রয়েছে মতান্তর। কারও কারওমতে, এক নমঃশূদ্র ব্যক্তি এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। পরে শ্রীমন্ত পণ্ডিত নামক এক ব্রাহ্মণ এই মন্দিরের দায়িত্ব পেয়েছিলেন। অন্য একটি মত অনুসারে, প্রথমে এখানে ছিল একটি শিবমন্দির। পরে শ্রীমন্ত পণ্ডিত এখানে কালীমন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। সেই সময় শ্রীমন্ত পণ্ডিত নাকি বসন্ত রোগের চিকিৎসা করতেন। অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান-ফিরিঙ্গি অধ্যুষিত বৌবাজার অঞ্চলে তিনি বহু মানুষকে চিকিৎসা করে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরিয়ে এনেছিলেন। কৃতজ্ঞতা স্বরূপ বহু ফিরিঙ্গি শ্রীমন্ত পণ্ডিতের মন্দিরে পুজো দিতে আসত। সেই কারণেই লোক মুখে ছড়িয়ে পড়ে ফিরিঙ্গি কালী নামটি। জনশ্রুতি, এই মন্দিরের পাশের গলিতে থাকতেন অ্যান্টনি সাহেবের মামা অ্যারাটুন সাহেব। সেখানে যাতায়াত থাকায় মাঝে মাঝে অ্যান্টনি সাহেব নাকি মন্দিরের চালায় বসে গান গাইতেন। মতান্তরে, তিনি নাকি একটি কালী মূর্তি গড়ে এই মন্দিরে বসিয়ে দিয়েছিলেন। শোনা যায়, মন্দিরের পুরনো মূর্তিটি ছিল মাটির। ১৯৪৬-এর দাঙ্গায় পুরনো মূর্তিটি ধ্বংস হয়ে যায়। পরে ১৯৮৭ সালে কংক্রিটের মূর্তিটি তৈরি করা হয়। কালীপুজোয় আজও বহু ভক্ত সমাগম হয় এখানে।
করুণাময়ী কালী: এখানে পুজো হয় ষোড়শোপচারে।
করুণাময়ী কালী (টালিগঞ্জ)— বড়িশা সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবারের জমিদার নন্দদুলাল রায়চৌধুরীর আদরের মেয়ে করুণা হঠাই মারা গেল। মেয়ের অকাল মৃত্যুতে নন্দদুলাল শোকে একেবারে দিশেহারা হয়ে পড়লেন। তাঁকে নিয়ে পরিবারের সকলেই চিন্তায় পড়লেন। এমনই একদিন নন্দদুলাল দেবী কালীর স্বপ্নাদেশ পেলেন, প্রয়াত মেয়ের স্মৃতিতে একটি মন্দির নির্মাণ করার। এর পরে আনুমানিক ১৭৬০ সালে তিনি পশ্চিম পুটিয়ারি অঞ্চলে দ্বাদশ শিবমন্দির-সহ একটি কালীমন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। মেয়ের নামেই বিগ্রহের নামকরণ করা হয় ‘করুণাময়ী’। একটি কষ্ঠিপাথর কেটে বিগ্রহটি তৈরি করা হয়েছিল, যা পঞ্চমুণ্ডির আসনের উপর প্রতিষ্ঠিত। কালীপুজোর সময় দেবীকে বিশেষ ভাবে সাজানো হয়। পুজো হয় ষোড়শোপচারে। হয় কুমারী পুজো। কালীপুজোর বিশেষ ভোগে থাকে খিচুড়ি, সাদা ভাত, মোচার ঘন্ট, এঁচোড়ের ডালনা, লুচি ছোলার ডাল, পোলাও, নানা রকমের তরকারি, দশ রকমের মাছ, চাটনি, পায়েস।
নিস্তারিণী কালী (বেথুন রো)— ‘নানেদের কালী মন্দির’ বলে পরিচিত হলেও এর নেপথ্যে রয়েছে একটি কাহিনি। সিমলা অঞ্চলে কৃষ্ণচন্দ্র সিংহ দক্ষিণেশ্বরের ভবতারিণী বিগ্রহের আদলে বারাণসী থেকে নিস্তারিণীর বিগ্রহ তৈরি করিয়ে আনলেও নানা কারণে শেষ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠা করতে পারেননি। এর পর তিনি তাঁর প্রতিবেশী ঈশ্বরচন্দ্র নানের কাছে বিগ্রহটি হস্তান্তর করেছিলেন। পরে ঈশ্বরচন্দ্র নবরত্ন মন্দির তৈরি করে ১৮৬৫ সালে রথযাত্রার দিনে মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। আজও প্রতি বছর সাড়ম্বরে এই মন্দিরে কালীপুজো হয়।
জয় মিত্র কালিবাড়ি :মন্দিরটি নবরত্ন শৈলীর হলেও প্রথাগত নবরত্ন শৈলীর থেকে কিছুটা আলাদা।
জয় মিত্র কালিবাড়ি— ১৮৫০ সালে শোভাবাজার অঞ্চলের বাসিন্দা জয়নারায়ণ মিত্র বরাহনগর-মালোপাড়ার কুঠিঘাট অঞ্চলে বারোটি আটচালা শিব মন্দির সহ কৃপাময়ী কালীমন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। মন্দিরটি নবরত্ন শৈলীর হলেও প্রথাগত নবরত্ন শৈলীর থেকে কিছুটা আলাদা। বাঁকানো চালের পরিবর্তে দেখা যায় দোতলা দালান মন্দিরের কোণে কোণে চূড়া রয়েছে। শোনা যায়, শ্রীরামকৃষ্ণ দক্ষিণেশ্বরের ভবতারিণীকে ‘মা’ বলে আর ‘কৃপাময়ী’ ও ‘ব্রহ্মময়ীকে’ মাসি বলে ডাকতেন।
পুঁটে কালী: কালীপুজোর পরের দিন হয় কুমারী পুজো ও অন্নকূট উৎসব।
পুঁটে কালী (কালীকৃষ্ণ টেগোর স্ট্রিট)— এখনও ঘোর তন্ত্রাচারে পুজো হয়। রয়েছে পশুবলি প্রথাও। প্রতি বছর কালীপুজোর দিনে হয় ভক্ত সমাগম। পুজোর ভোগে থাকে খিচুড়ি, লুচি পোলাও, নানা ধরনের তরকারি, পাঁচ রকমের মাছ, চাটনি, পায়েস। এ ছাড়াও থাকে খাস্তা কচুরি আর চানাচুর। কালীপুজোর পরের দিন হয় কুমারী পুজো ও অন্নকূট উৎসব।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy