Advertisement

Associate Partner

Style Partner

Associate Partner

Weddings Partner

Food Partner

Ananda Utsav 2019

মা কালীর ডাকিনী-যোগিনী সব গেল কোথায়?

অসুরদের সঙ্গে লড়াই করার সময়, দুর্গা মোট আট জন যোগিনীর সৃষ্টি করেছিলেন।

রজতেন্দ্র মুখোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৫ অক্টোবর ২০১৯ ১১:৩৭
Share: Save:

ভূতপেত্নিদের ওপর আমার টান সেই ছোটবেলা থেকে। আমি দেখেছি, অল্প বয়সে ভূতের গল্প, ভূতের ছড়া ও ছবি আমাদের মনের মধ্যে যে আকর্ষণ তৈরি করে, সারা জীবনেও সেটা নষ্ট হয় না। ছোটবেলায় দুর্গাপুজোর প্যান্ডেলে গিয়ে যাকে সবার আগে চোখে পড়ত, সে হল অসুর। আর কালীপুজোর দিন প্যান্ডেলে গিয়ে যাদের দেখে চোখ আটকে যেত, তারা হল ডাকিনী আর যোগিনী। এদের দু’জনকে হয় দেখা যেত মণ্ডপের পাটাতনের ওপর মা কালীর দু’পাশে পোজ দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে, আর তা নইলে প্যান্ডেলে ঢোকার মুখে দু’ধারে দাঁড়িয়ে, আমাদের মতো ছোটদের দিকে হাড়হিম করা চোখে তাকিয়ে থাকতে। ওদের দু’জনের, প্যান্ডেল থেকে আমাদের বাড়িতে চলে আসার সম্ভাবনা দেখিয়ে, কত বার ভাত খাওয়ানোর সময় তাড়াতাড়ি গাল নাড়াতেও বলা হত! এক বার হরিশ পার্কে চামুণ্ডার মণ্ডপে, মাটির হাঁড়ি দিয়ে মাথা বানানো ডাকিনী যোগিনীদের, চোখের ফুটোর মধ্যে লাল জ্বলজ্বলে টুনিবাল্ব দেখে আমার নাকি এমন জ্বর এসে গিয়েছিল, যা ভাইফোঁটার দিনেও নামেনি।

পুরাণে বলা আছে মা দুর্গার দুই সঙ্গিনী জয়া-বিজয়া। তেমনই ডাকিনী-যোগিনী হল মা কালীর দুই সহচরী। হিন্দুধর্মে কিন্তু ডাকিনী আর যোগিনীকে সে ভাবে আলাদা করে দেখা হয় না, যে ভাবে দেখা হয় বৌদ্ধ বা তন্ত্রমতে। যদিও এটা বলা আছে, যোগিনীদের সৃষ্টি মা দুর্গারই শরীর থেকে। অসুরদের সঙ্গে লড়াই করার সময়, দুর্গা মোট আট জন যোগিনীর সৃষ্টি করেছিলেন। এই আট জনের প্রত্যেকের শরীর থেকে আবার নাকি সৃষ্টি হয়েছিল আরও আট জন করে যোগিনী। মানে, যোগিনীদের মোট সংখ্যা দাঁড়িয়েছিল চৌষট্টিতে। ভুবনেশ্বর, খাজুরাহো, বারাণসী, জব্বলপুর— এই সব জায়গায় এখনও চৌষট্টি যোগিনীর মন্দির রয়েছে। তার মধ্যে ভুবনেশ্বর এবং বারাণসীর মন্দির দু’টি আমি নিজেও বেড়াতে গিয়ে দেখেছি। এখনও যা রয়েছে তা এক কথায় অপূর্ব। এখন, এটা তো অনেকেরই জানা যে, ডাকিনীরা হল সেই সব মহিলা ভূত যারা আকাশপথে ইচ্ছেমতো ঘুরে বেড়াতে পারে। আবার কোথাও কোথাও এদের শাঁখিনী অর্থাৎ শাঁখচুন্নিও বলা হয়েছে। লোককথায় বলে, ডাকিনীদের নাকি নানা রকম অলৌকিক শক্তি থাকে, যা মানুষের সাধনা এবং মুক্তিলাভের পথে বাধা দেয়। কখনও আবার তারা তাতে সাহায্যও করে।

দুর্গাপুজোর ভাসান হয়ে গেলে দুপুরবেলার দিকে, পোটোপাড়ার বস্তি থেকে আসা অল্পবয়সি ছেলেপিলের দল, ভবানীপুরের মুখার্জিঘাটের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া আদি গঙ্গার বুকে হাফপ্যান্ট পরে ঝাঁপিয়ে পড়ত। তার অগভীর পেট থেকে তুলে আনত ভাসান দেওয়া লক্ষ্মী-সরস্বতী-কার্তিক-গণেশের মাটি-গদগদে কাঠামোগুলোকে। তারপর ভিজে গায়ে, সেগুলোকে ঠেলায় চাপিয়ে, হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিটের ভেতর দিয়ে ছুটতে ছুটতে সোজা পোটোপাড়ায় নিয়ে গিয়ে তুলত। এর বেশ কয়েকখানা সঙ্গে সঙ্গেই বেচে দিত ওখানকার ছোটোখাটো পোটোদের কাছে। আর কিছু রেখে দিত নিজেরাই ডাকিনী-যোগিনী বানিয়ে কালীপুজোয় বিক্রি করবে বলে। চোখের সামনে প্রতিমা তৈরি হতে দেখার ফলে যেটুকু কাজ শেখা, তার ওপর নির্ভর করেই ওরা ডাকিনী-যোগিনীগুলো বানাত। ওদের মধ্যে এমন অনেকেই ছিল, যারা দিনের বেলা ওই মূর্তিগুলো বানাত, আর সন্ধের পর ঘটিগরম বা ঘুগনি বিক্রি করত কিংবা কোনও কচুরির দোকানে হেল্পারের কাজও করত।

এই ভাবে যারা ডাকিনী-যোগিনী বানায়, তারা জল থেকে তুলে আনা ওই ভেজা কাঠামোয় লেগে থাকা মাটির ওপর কিছু বাড়তি মাটি চাপিয়ে সেটা শুকিয়ে নেয়। গেরস্তর ফেলে দেওয়া ছেঁড়াখোড়া জামাকাপড় ওদের যত্ন করে পরায়। শনের নুটি দিয়ে মাথার চুল বানিয়ে, সারা গায়ে কুচকুচে কালো রং করে দেয়। বড় বড় কান বানায়। ঠেলে বেরিয়ে আসা চোখ আঁকে। লম্বা লম্বা দাঁতে সাদা রং করে আর জিভে করে টকটকে লাল রং। কচি কচি অসুর ধরে খায় বলে এদের ঠোঁট আর কষ দিয়ে লাল রক্ত ঝরে ঝরে পড়ে।

আমি দেখেছি, এই সব মূর্তি বানানোর সময় এদের আশপাশে বিড়ি বা খৈনি হাতে প্রচুর সমঝদার এসে জুটত। যারা থেকে থেকে, ‘আরে পাগলা, দাঁতটা টেনে আর একটু বের করে দে! চোখের ভ্যাঁটরাটা আর একটু বড় কর, তবে না জমবে!’ এমন সব মূল্যবান পরামর্শ ঘাড় নেড়ে নেড়ে সমানে দিয়ে যেত।

নতুন কলেবরে ডাকনী-যোগিনী বানালে তার মুখের জন্য আলাদা ছাঁচও কিন্তু পাওয়া যায়। তবে এগুলো ব্যবহার করেন পেশাদার প্রতিমাশিল্পীরা। এই মূর্তিগুলোর গড়ন এবং ফিনিশিং খুবই ভাল হয়, কিন্তু ক্রেতাদের তাদের পছন্দ না-ও হতে পারে। দেখা যায়, পুজো উদ্যোক্তারা বেশির ভাগ সময়েই ওই ন্যাতাকানি জড়ানো, এবড়োখেবড়ো গায়ের, ছাপকা-ছোপকা রং করা ডাকিনী-যোগিনীদেরই পছন্দ করে থাকেন। বিদঘুটে আর ভয়ঙ্কর চেহারা বলে যারা চিরকাল মানুষকে বেশি আকর্ষণ করে এসেছে।

ডাকিনী-যোগিনীরা চিরকাল জোড়ায়-জোড়ায় বিক্রি হয়। একখানা ডাকিনী বা একখানা যোগিনী কেউই কোনও দিন বিক্রি করে না। গত বছর পোটোপাড়ায় অপেশাদার হাতের এমন একজোড়া চার ফুটের ডাকিনী-যোগিনী দু’হাজারের নীচে পাওয়া যায়নি। অবিশ্যি স্পেশাল অর্ডারে দিলে তার দাম এর তুলনায় তো কিছুটা বেশি হবেই। কিন্তু তা হলেও ইদানীং প্রতিমাশিল্পীরা এদের বানাতে খুব একটা উৎসাহ দেখান না। কারণ, পরিশ্রম বা কাঁচামালের খরচ প্রতিমা তৈরির প্রায় কাছাকাছি হলেও, এদের বেচে ঠিকঠাক দাম কখনওই পাওয়া যায় না।

এখন পুরসভা নিজের দায়িত্বে দূষণ আটকানোর জন্য, ভাসানের পর স্থানীয় পুকুর বা নদী থেকে কাঠামো সমেত গলে আসা মূর্তিগুলোকে তুলে নিয়ে গিয়ে শহর থেকে বহু দূরের কোনও জায়গায় ফেলে দিয়ে আসে কিংবা নষ্ট করে ফেলে। ফলে বছর তিন-চার আগেও পুজোর পরে যত কাঠামো জোগাড় করা যেত, এখন তার পঞ্চাশ শতাংশও পাওয়া যায় না। ফলে চামুণ্ডা, শ্যামা, শ্মশানকালী— এমন যে সব মূর্তির সঙ্গে ডাকিনী-যোগিনীদের উপস্থিতি একদম বাঁধাধরা ছিল, বেশ কিছু উদ্যোক্তা দামের কারণে এদের আর আগাম বায়না করছেন না। প্রতিমা ডেলিভারি নিতে এসে হাতের কাছে সস্তা-গণ্ডায় যে ডাকিনী-যোগিনী পাওয়া যাচ্ছে, তাদেরই তাঁরা চোখ বন্ধ করে ম্যাটাডরে তুলে নিচ্ছেন। আর সত্যি কথা বলতে কি, আজকাল দুর্গাঠাকুর ভাসানের পর প্রচুর অসুর আর কালীঠাকুর ভাসানের পর প্রচুর ডাকিনী-যোগিনীকে রক্তমাংসের শরীরেই তো আমরা পাড়ায়-বেপাড়ায় ঘুরে বেড়াতে দেখি। তাদের সঙ্গে একটু আগে থেকে কথা বলে রাখলেই তো পরের বছরের সব ঝামেলা মিটে যায়! তাই না!

কার্টুন: দেবাশীষ দেব

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy