সত্যজিৎ রায় এক দিন ঘুরতে ঘুরতে হাজির শ্রীরামপুর রাজবাড়িতে। 'ঘরে বাইরে' ছবির শ্যুটিং সাইট দেখতে। খবর ছড়াতেই উপচে পড়ল ভিড়। বেগতিক দেখে শ্যুটিংয়ের পরিকল্পনার সেখানেই ইতি! এ বাড়িতে বিভিন্ন সময়ে এসেছেন রুপোলি জগতের বহু তারকা। উত্তম কুমার, সুপ্রিয়া দেবী-- কে নেই সেই তালিকায়!
এ বাড়িতে অতিথি হয়ে এসেছেন বহু বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বই। শোনা যায়, ত্রিবেণী সম্মেলন উপলক্ষে এসেছিলেন মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধী। এসেছেন ডাক্তার বিধান রায়। যোগসূত্র এ বাড়িরই বলাইচন্দ্র গোস্বামী, যিনি ছিলেন শ্রীরামপুর পুরসভার চেয়ারম্যান। এই বাড়ির আর এক সদস্য তুলসীচন্দ্র গোস্বামী ছিলেন চিত্তরঞ্জন দাশের কাছের মানুষ। চিত্তরঞ্জনের স্ত্রী বাসন্তী দেবী অত্যন্ত স্নেহ করতেন তাঁকে। এই বৃত্তেরই আর এক বিপ্লবী সুভাষচন্দ্র বসুর সঙ্গেও ছিল তুলসীচন্দ্রের বিশেষ হৃদ্যতা। সেই সূত্রে সুভাষও এসেছেন এবাড়িতে।
এক নিঃশ্বাসে এত দূর বলে থামলেন শ্রীরামপুর গোস্বামী বাড়ির উত্তর পুরুষ শিবাশিস গোস্বামী। বললেন, "এ বাড়ির অতীত ঐতিহ্য জুড়ে রয়েছেন বহু দিকপাল ব্যক্তিত্ব। যার মধ্যে রামজয় গোস্বামী অন্যতম। জোড়াসাঁকোর দ্বারকানাথ ঠাকুরের সঙ্গে তিনি যৌথ ভাবে ইউনিয়ন ব্যাঙ্ক স্থাপন করেন। যদিও সে ব্যাঙ্ক পরে ফেল করে। এ বাড়ির আর এক সফল ব্যবসায়ী রঘুরাম গোস্বামীর লোকমুখে নাম হয় 'প্রিন্স অফ মার্চেন্ট'। শোনা যায়, যখন ডাচরা শ্রীরামপুর ছেড়ে চলে গেলেন, তখন এই রঘুরাম পুরো শ্রীরামপুর কিনে নিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ইংরেজদের বাধাদানের কারণে তিনি তা পারেননি।"
গোস্বামী বাড়ির আর এক শরিক দেবাশিস গোস্বামী জানালেন এ বাড়ির আদি পুরুষের কাহিনি। চৈতন্য পার্ষদ অদ্বৈত আচার্যের পুত্র অচ্যুতানন্দের কন্যার বংশধরের সাথে বিয়ে হয় পাটুলির পণ্ডিত লক্ষ্মণ ভট্টাচার্যের। যিনি নবাব আলিবর্দির কাছ থেকে চক্রবর্তী উপাধি পান। তাঁর পুত্র রামগোবিন্দ টোলে অধ্যাপনা করতেন। এই রামগোবিন্দ গোস্বামী শ্রীরামপুর গোস্বামী পরিবারের আদিপুরুষ।
নবাব আলিবর্দি খাঁয়ের শাসনকালে রামগোবিন্দ স্ত্রী মনোরমাকে নিয়ে জলপথে পাটুলি থেকে গঙ্গাসাগরের উদ্দেশে যাত্রা করেছিলেন। কলকাতার কাছাকাছি মনোরমার হঠাৎ প্রসবযন্ত্রণা ওঠে। রামগোবিন্দকে তাই শ্রীরামপুরে থামতে হয়। শেওড়াফুলির রাজা মনোহর রায় তা জানতে পেরে তাঁদের থাকার ব্যবস্থা করেন। সেই সূত্রে জমিদারি পান রামগোবিন্দ। তাঁর নাতি হরিনারায়ণ গোস্বামীর আমলে দুর্গাপুজোর সূচনা। পরে মূল বসতবাড়ির অনুকরণে প্রাসাদ সংলগ্ন ঠাকুরদালানে জাঁকজমক করে পুজো শুরু করেন রঘুরাম। যে পুজো এ বছর ৩৪০-এ পড়ল।
এ বাড়ির দুর্গাপুজোয় আসর জমিয়ে গিয়েছেন অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি, ভোলা ময়রা থেকে রূপচাঁদ পক্ষী।
সেই রাজবাড়ির দেওয়ালে ঘুণ ধরেছে আজ। আর সেই আসর বসে না । যেটুকু হইহুল্লোড় হয়, তা শুধু পরিবারের লোকজনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ।
শিবাশিস একটু আক্ষেপের সুরে বলেন, "জানি না এর পর কী হবে! এখন শুধু সেলফি আর ছবি তোলার ভিড়। ঐতিহ্য নিয়ে কেউই বিশেষ আগ্রহী নয়। পুজোর সময়ে হেরিটেজ ট্যুর করতে কিছু মানুষ আসেন। সরকারি সাহায্য ছাড়া এই বিরাট বাড়ি রক্ষণাবেক্ষণ করা বেশ কঠিন কাজ। আমি আসলে এই রাজবাড়ি নিয়ে বিশেষ ভাবে আগ্রহী হয়েছিলাম ২০১০ সালে। যখন এলাহাবাদে মতিলাল নেহরুর বাসভবন আনন্দ ভবনে চিত্তরঞ্জন দাশ, জওহরলাল নেহরু, সুভাষ বসুর সঙ্গে আমার জ্যাঠামশাই তুলসী গোস্বামীর ছবি দেখেছিলাম। শ্রীরামপুর ফিরে এসে পরিবারের ইতিহাস চর্চা ও রাজবাড়ি রক্ষণাবেক্ষণে মনোযোগ দিই। জানি না আমাদের পরের প্রজন্ম কী করবে!"
এই প্রতিবেদনটি 'আনন্দ উৎসব' ফিচারের একটি অংশ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy