Advertisement

Associate Partner

Style Partner

Associate Partner

Weddings Partner

Food Partner

History Of Laxmi Puja

কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোয় জড়িয়ে আছে কৃষি সমাজের সমৃদ্ধির কামনা

কোজাগরী শব্দটি ‘কে জাগরী’ বা ‘কে জেগে আছে’ থেকে এসেছে। কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোর সঙ্গে অঙ্গাঙ্গি ভাবে জড়িয়ে আছে আল্পনা।

বিভূতিসুন্দর ভট্টাচার্য
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৯ অক্টোবর ২০২০ ১৩:৩১
Share: Save:

সৌভাগ্য, সমৃদ্ধি আর ধনসম্পদের দেবী হিসেবে লক্ষ্মীর আরাধনা হয়ে আসছে সেই প্রাচীন কাল থেকে। আশ্বিনের কোজাগরী পূর্ণিমায় লক্ষ্মীপুজোর ঐতিহ্য বাংলার নিজস্ব সম্পদ। সে দিন বাংলার ঘরে ঘরে শঙ্খধ্বনি মুখরিত সন্ধ্যায় লক্ষ্মীর আরাধনা হলেও ভারতের অন্য প্রান্তে অবশ্য লক্ষ্মীপুজো হয় দীপাবলির সন্ধ্যায়। গবেষকদের মতে বাংলার কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোর সঙ্গে অঙ্গাঙ্গি ভাবে জড়িয়ে আছে কৃষি সমাজের প্রভাব।

ভারতে লক্ষ্মীপুজোর ইতিহাস বহু প্রাচীন। ঋগ্বেদে লক্ষ্মীর কোনও সরাসরি উল্লেখ না থাকলেও শ্রী শব্দের উল্লেখ রয়েছে বেশ কয়েক বার। এখানে শ্রী অর্থে সৌন্দর্যের আধার। যদিও পরবর্তী কালে শ্রীসুক্তে উল্লেখ রয়েছে শ্রী নামে এক দেবীর, যিনি পদ্মের উপর আসীন। সেই আদি যুগ থেকেই লক্ষ্মীর সঙ্গে অঙ্গাঙ্গি ভাবে জড়িয়ে পদ্ম। তাই তিনি পদ্মাসনা, পদ্মালয়া। যুগ যুগ ধরে লক্ষ্মীকে বিভিন্ন রূপে বর্ণনা করা হয়েছে। শুক্ল যজুর্বেদে শ্রী তথা লক্ষ্মীকে আদিত্যের দুই পত্নী রূপে উল্লেখ করা হয়েছে। অথর্ববেদে উল্লেখ মেলে পুণ্যালক্ষ্মী এবং পাপী লক্ষ্মীর। রামায়ণে সীতাকে লক্ষ্মী রূপে বর্ণনা করা হয়েছে। তবে সবচেয়ে প্রচলিত কাহিনি হল, সমুদ্রমন্থনের সময় লক্ষ্মীর আবির্ভাব।

তবে শুধু হিন্দু ধর্মে নয়, বৌদ্ধ এবং জৈন ধর্মেও উল্লেখ রয়েছে দেবী লক্ষ্মীর। যেমন বৌদ্ধ ‘অভিধানপ্পদীপিকা’-তে তিনি সৌন্দর্য ও সমৃদ্ধির দেবী। তেমনই ‘শালিকেদার’ এবং ‘সিরি-কালকন্নি’ জাতকে তাঁকে সৌভাগ্য ও জ্ঞানের দেবী বলে উল্লেখ করা হয়েছে। আবার বৌদ্ধতন্ত্রে তিনি বসুধারা নামে পূজিত হতেন। তিনি দেবী লক্ষ্মীর বৌদ্ধ প্রতিরূপ। অন্য দিকে জৈন ধর্মেও তাঁর উল্লেখ রয়েছে। মহাবীরের মাতা ত্রিশলা যে রাতে জিনকে স্বপ্নে ধারণ করেছিলেন, সে রাতেই গজলক্ষ্মীকে স্বপ্নে দেখেছিলেন তিনি।

প্রাচীন ভারতের শিল্পকলায় এমনকী মুদ্রাতেও দেবী লক্ষ্মীর অসংখ্য নিদর্শন পাওয়া যায়। প্রাচীন বৌদ্ধ শিল্পকলায় ভারহুত, সাঁচী কিংবা অমরাবতীর ভাস্কর্যে লক্ষ্মীর সন্ধান মেলে। ভারতীয় সংগ্রহালয়ে রক্ষিত খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতকের, বেসনগরের যে কল্পবৃক্ষ রয়েছে, তাতে প্রচুর ধনসম্পদের সঙ্গে শঙ্খ ও পদ্মের চিহ্ন দেখা যায়। গবেষকদের মতে এই কল্পবৃক্ষের সঙ্গে কুবের অথবা লক্ষ্মীর সম্পর্ক রয়েছে। প্রাচীন ভারতীয় মুদ্রায় গজলক্ষ্মী কিংবা অভিষেক রত লক্ষ্মীর অসংখ্য নিদর্শন পাওয়া যায়। লক্ষ্মী মূলত দ্বিভুজা অথবা চতুর্ভুজা হলেও বেশ কিছু ক্ষেত্রে তিনি বহুভুজাও।

কলাপাতায় টাকা, স্বর্ণ মুদ্রা, ধান, পান, কড়ি, হলুদ ও হরিতকী দিয়ে সাজানো হয় পুজো স্থানটিকে।

প্রচলিত বিশ্বাস অনুসারে কোজাগরী পূর্ণিমার রাতে দেবী মর্তে আবির্ভূতা হন। তাই সারা রাত জেগে তাঁর উপাসনা করার এই রেওয়াজ। অনেকেই মনে করেন কোজাগরী শব্দটি ‘কে জাগরী’ বা ‘কে জেগে আছে’ থেকে এসেছে। কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোর সঙ্গে অঙ্গাঙ্গি ভাবে জড়িয়ে আছে আল্পনা। পশ্চিমবাংলার বিভিন্ন প্রান্তে লক্ষ্মীপুজোর আল্পনায় দেখা যায় আঞ্চলিকতার প্রভাব। এখনও গ্রামাঞ্চলে ঘরের দরজা থেকে দেবীর আসন, সেখান থেকে ধানের গোলা পর্যন্ত আল্পনায় ছোট ছোট পায়ের ছাপ এঁকে দেওয়া হয়।

পুজো হয় মূলত প্রতিমা, সরা, নবপত্রিকা কিংবা কলার পেটোর তৈরি নৌকায়। কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোতে দেখা যায় জেলা ভিত্তিক আঞ্চলিক আচার অনুষ্ঠান। এখনও ঘরে ঘরে প্রতি বৃহস্পতিবার লক্ষ্মীর পাঁচালি পাঠ করে তাঁর আরাধনা করা হয়। উপচারে ফল মিষ্টি ছাড়াও থাকে মোয়া, নাড়ু ইত্যাদি। লক্ষ্মীর আচার অনুষ্ঠানেও দেখা যায় নানা ধরনের তাৎপর্য। কোনও কোনও পরিবারে পুজোয় মোট ১৪টি পাত্রে উপচার রাখা হয়। কলাপাতায় টাকা, স্বর্ণ মুদ্রা, ধান, পান, কড়ি, হলুদ ও হরিতকী দিয়ে সাজানো হয় পুজো স্থানটিকে। পুজোর উপকরণ এবং আচার অনুষ্ঠান দেখে অনুমান করা যায় এর নেপথ্যে থাকা কৃষি সমাজের প্রভাব। কিছু কিছু জায়গায় লক্ষ্মীপুজো উপলক্ষে মেলা বসে। কোথাও বা নৌকাবাইচও অনুষ্ঠিত হয়।

ময়মনসিংহ গীতিকায় লক্ষ্মীপূজার উল্লেখ দেখে বোঝা যায়, সেকালেও এই পূজো কতটা জনপ্রিয় ছিল। তেমনই নীহাররঞ্জন রায় ‘বাঙালীর ইতিহাস’-গ্রন্থে লিখেছেন, ‘…আমাদের লোকধর্মে লক্ষ্মীর আর একটি পরিচয় আমরা জানি এবং তাঁহার পূজা বাঙালী সমাজে নারীদের মধ্যে বহুল প্রচলিত। এই লক্ষ্মী কৃষি সমাজের মানস-কল্পনার সৃষ্টি; শস্য-প্রাচূর্যের এবং সমৃদ্ধির তিনি দেবী।’ তেমনই অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘বাংলার ব্রত’ বইতে এই লক্ষ্মীপূজা সম্পর্কে লিখেছেন দেবীর কাছে ভাল ফলনের কামনা করাই আসলে এই পূজার নৃতাত্ত্বিক কারণ। পূজা বা ব্রতকথার সঙ্গে আল্পনার একটি সম্পর্ক রয়েছে। আল্পনা আসলে ‘কামনার প্রতিচ্ছবি।’

অন্য বিষয়গুলি:

Laxmi Puja Festival Laxmi Puja Celebration
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE