বাতাসে চাউর হয়ে গেল তিনি আসছেন। পিলপিল করে লোক ভিড় করে ফেলল গোটা রাস্তায়। ধীর লয়ে আলোকিত আমহার্স্ট স্ট্রিট দিয়ে ঢুকল এসি র্জাম্বালা গাড়িটা। কী আশ্চর্য! এত ভিড় সত্ত্বেও গাড়ি এসে দাঁড়াল প্যান্ডেলের বেশ খানিকটা দূরে। খালি পায়েই নামলেন তিনি। চার দিকে তুমুল হইহই! তিনি হাত তুলে থামালেন। মায়ের পুজোয় এসেছেন, শুধু মায়েরই জয়জয়কার হবে। প্যান্ডেলে ঢুকে মায়ের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে এগিয়ে গেলেন মঞ্চের দিকে। সঙ্গে এক মানুষ, কুখ্যাতই তাঁর তকমা, আর গালে-পিঠে-হাতে অজস্র আঁকিবুকি...
নব যুবক সঙ্ঘের কালীপুজো। আর ওই যে এসি র্যাম্বালা গাড়ি! তাতে চড়ে যিনি মণ্ডপে পা রাখলেন, তিনি আর কেউ নন। স্বয়ং উত্তম কুমার!
আর তাঁর সঙ্গী? ফাটাকেষ্ট। আসল নাম কৃষ্ণচন্দ্র। পড়াশোনা বিশেষ শিখতে পারেননি। বাবা সামান্য পানদোকানি। রোজ গুমটি খোলার আগে ঠনঠনিয়ার মোড়ে মায়ের কাছে মাথা ঠুকতে যেতেন। একের পর এক ছুরি, চপার, বোমা-পেটোর আঘাত সয়ে, দিনের পর দিন কলকাতা মে়ডিক্যাল কলেজের বেডে শুয়ে থেকে, যমে-মানুষে টানাটানির পর যখন মানুষটা ফিরে এল, তখন সব কিছু ছেড়েছুড়ে নিরীহ, নিপাট ভালমানুষটি হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু উল্টে বাড়ি ফিরে এসেই হয়ে কৃষ্ণচন্দ্র গেলেন কলকাতার স্বঘোষিত রাজা, মস্তান ফাটাকেষ্ট!
হবে নাই বা কেন, শরীরে অজস্র কাটাকুটি দাগ থাকলেও মস্তান ফাটাকেষ্টর মনে কিন্তু কাটাকুটি ছিল না। মায়ের পুজো করতেন। আর তাই নারীদের যথেষ্ট সম্মানও করতেন।
১৯৫৫ সালে গুরু প্রসাদ চৌধুরী লেনে প্রথম কালীপুজো শুরু করলেন কৃষ্ণচন্দ্র। সেখানে কিছু মনোমালিন্য ঘটায় সরে আসেন সীতারাম ঘোষ স্ট্রিটে। সেখানে প্রথম একটি বাড়িতে, তার পরে পথের উপরেই মণ্ডপ গড়ে শুরু করেন পুজো। সেই পুজোই আস্তে আস্তে ফাটাকেষ্টর কালীপুজো বলে বিখ্যাত হয়।
যোগীগুরু ওঙ্কারনাথ কাশী থেকে কলকাতা এসেছেন। সে সময়ে দীপান্বিতার মুহূর্ত। তিনি এক বার মায়ের দর্শন করতে চান। এমন কথা শুনে যদুনাথ বোস লেন থেকে নিজের কাঁধে করে গুরুদেবকে মায়ের মণ্ডপে নিয়ে গিয়েছিলেন ফাটাকেষ্ট! নকশাল আমলের সেই কলকাতা শহর অমন হইহই বহুকাল করেনি। ফুলে ফুলে ঢাকা পড়েছিল রাজপথ থেকে গলি…
বারোয়ারি পুজো হলেও মা নাকি এখানে ভীষণ জাগ্রত। সে কালের বহু মানুষের মুখে মুখে ফেরে এ কথা। এক বার অঞ্জলি দেওয়ার সময়ে এক নারীর ভর হয়। তিনি বলেন, মা নাকি লালপাড় শাড়ি পরতে চাইছেন। আর এক বার আর একটু ছোট গ্লাসে মাকে জল দেওয়া হয়েছে। মা নাকি ভরের মাধ্যমে জানিয়েছিলেন, তাঁকে বড় গ্লাসে জল দেওয়ার কথা। বিশ্বাস-অবিশ্বাসের গণ্ডি পেরিয়ে এ কথার মান্যতা ছিল বহুদূর। আজ থেকে পাঁচ সাত বছর আগেও সে সমস্ত মানুষেরা জীবিত ছিলেন। তাঁদের মুখে মুখে ফিরত সে গল্প। এমনকি মায়ের পুজোয় খোদ অমিতাভ বচ্চন এসে হিরের নাকছাবি মানত করে গিয়েছিলেন! এমনই ছিল সে মায়ের মহিমা।
ফাটাকেষ্ট-র পুজোয় যাঁরা আসতেন, তাঁদের সবাইকে আনার ক্ষমতা তাঁর ছিল না। তবুও অমিতাভ বচ্চন থেকে রাজেশ খন্না, বিনোদ খন্না, আশা ভোঁসলে- সবাই এসেছেন। জলসা করে গিয়েছেন খোলা মঞ্চে! উত্তম কুমার প্রতি বছরই আসতেন। কিছু কথা বলে চলে যেতেন। এমনই ছিল মায়ের মহিমা। মা এখানে পনেরো দিন ধরে বিরাজ করতেন। তাঁর টানে ছুটে আসতেন অগণিত ভক্ত। শোনা যায়, অঞ্জলির সময়ে পনেরো হাজার লোকের সমাগম হতো এই পুজোয়। মায়ের বিসর্জনও হত রাজকীয়।
স্রেফ উচ্ছাস বা দেখনদারির পুজো নয়। ভক্তিও ছিল ঠিক সমপরিমাণেই। নিয়মনিষ্ঠা রক্ষা করে পূর্ণ আকুতিতেই পুজো সমাধা করতেন ফাটাকেষ্ট। তাঁর অনুপস্থিতিতে আজ এত বছর পরেও তা-ই করা হয়।
আগের দিন কুমোরটুলির পটুয়াঘরে সমস্ত গয়না পরিয়ে মোমবাতি জ্বেলে, আরতি করে, হাতে পান দিয়ে মাকে আবাহন করা হয়। পরদিন ভোর ভোর মাকে নিয়ে মণ্ডপে রওনা। মায়ের মূর্তি যাত্রা করলে তার পরে কুমোরটুলি থেকে বাকি মূর্তিগুলি রওনা হয়। আজও কেবলমাত্র পুরোহিতই নিজে শুদ্ধ বস্ত্রে মায়ের ভোগ রাঁধেন। বারোয়ারি পুজোয় এতখানি নিয়ম এবং নিষ্ঠা তেমন দেখা যায় না। তাই তো বলা হয়, মা এখানে জাগ্রত। মানসিক করলে সবটুকু পূরণ করেন।
১৯৯২ সালে প্রয়াত হয়েছেন ফাটাকেষ্ট। আজও সীতারাম ঘোষ স্ট্রিটের দশ ফুটের গলি জুড়ে ঘননীল বরণ শ্যামা মা আসেন দীপান্বিতা তিথিতে। বাংলার প্রথম সার্থকনামা ডনের পুজো আজও ফাটাকেষ্টর পুজো নামেই চলে। তার গরিমা কোথাও এতটুকু ম্লান হয়নি। বলা ভাল, হতে দেননি মা নিজেই!
এই প্রতিবেদনটি ‘আনন্দ উৎসব’ ফিচারের একটি অংশ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy