কলকাতার হাল আমলের চোরেদের কথা আমি বলতে পারব না। কিন্তু গ্রামবাংলা বা মফস্সলের চোরেদের মধ্যে যে এখনও লক্ষ্মীপুজো নিয়ে একটা রোমাঞ্চকর উন্মাদনা আছে, এ আমি একপ্রকার হলফ করেই বলতে পারি। বিষয়টা জানেন না বুঝি? তবে শুনুন। কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোর রাতটা হল দুই বাংলার সব ধরনের চোরেদের হালখাতা করার রাত। মানে এই রাতটিতে কোথাও না কোথাও চুরি করে চোরেরা তাদের নতুন ‘চৌর্যাব্দ’ শুরু করে।
ওমা! কী হল! চৌর্যাব্দ শুনে ঘাবড়ে গেলেন নাকি? বঙ্গাব্দ শুনেছেন, খ্রিস্টাব্দ শুনেছেন, শকাব্দ শুনেছেন আর চৌর্যাব্দ শোনেননি, এ আবার কেমন কথা! তো, এই চৌর্যাব্দের প্রথম রাতে বউনি হিসেবে একখানা অন্তত চুরি করতে না পারলে, সারা বছর রোজগারপাতি খারাপ যাবে— চোরেদের জগতে এমন একটি প্রবাদ খুবই চালু আছে।
সরলমতি পাঠকদের মনে এই প্রশ্ন জাগতেই পারে, এত দিন থাকতে চোরেদের হালখাতা কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোর রাতেই বা হয় কেন! আসলে এর উত্তর কেউই খুব পরিষ্কার করে জানে না। আমার দিদিমার মুখে এবং পরে মায়ের কাছে যেটুকু শুনেছি তার নির্যাস হল, এ দিন লক্ষ্মীদেবীর পুজো করে গেরস্তরা সারা রাত জেগে থাকে। কারণ, কোজাগরী শব্দটির অর্থই হল, ‘কে জেগে আছ?’ আর এই প্রশ্নটিই সেই রাত্তিরে যে কোনও সময় গেরস্তর বাড়িতে সারপ্রাইজ ভিজিট দিতে গিয়ে, লক্ষ্মীদেবী নাকি জিগ্যেস করেন তার দরজার সামনে দাঁড়িয়ে। এই সময় গেরস্ত যদি জেগে থাকে তবে তো কেল্লা ফতে। দেবী অমনি হাসিহাসি মুখে তার বাড়িতে ঢুকে, প্রফুল্ল মনে তার নিবেদন করা ভোগ খেয়ে, তাকে প্রচুর সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য এবং ধনসম্পত্তির মালিক হওয়ার আশীর্বাদ করেন। আর সে যদি তখন হাঁ করে নাক ডাকিয়ে ঘুমোয়, তবে তিনি পা টিপে টিপে চলে যান আশপাশে জেগে থাকা অন্য কোনও সেবায়েতের বাড়িতে। সে বাড়িতে ঢোকবার সময় এই পৃথিবীর ধুলোমাখা মাটিতে, তাঁর সুললিত দুটি পায়ের যে ছাপগুলি পড়ে, তাকেই মূর্খ মানুষের দল লক্ষ্মীর পায়ের ছাপ আঁকা আল্পনার সঙ্গে গুলিয়ে ফ্যালে। নকলের সঙ্গে আসলের কোনও তফাতই তখন আর তাদের পোড়া চোখে ধরা পড়ে না।
সত্যি বলতে কি, এ দিন ঘুমিয়ে পড়ার টেনশন কাটাতেই গেরস্তরা রাত জেগে, শাঁখ বাজিয়ে, প্রদীপ জ্বেলে পুজো করে। দেবীকে যত্ন করে ভোগ নিবেদন করে। নিজেদের মধ্যে গল্প করে, তাস-পাশা খেলে কিংবা গানবাজনা করে থাকে। পূর্ণিমা তিথি বলে এ দিন সন্ধে থেকেই চরাচর চাঁদের আলোয় ভেসে যায়। সুতরাং সেই আলো আর জেগে থাকা অত মানুষের চোখ এড়িয়ে যে-চোর কোনও গেরস্তবাড়ি থেকে কিছু চুরি করে আনতে পারে, বোঝা যায়, সত্যিই তার এলেম আছে। আর এই ধারণাটি থেকেই সম্ভবত এই দিন রাতে কিছু না কিছু চুরি করে চোরেদের নতুন বছরের কর্মজীবন শুরু করতে হয়।
আরও পড়ুন: পুজোর বৃষ্টিতে ভেজা পিঠ, মুখে অন্য এক নক্ষত্রের হাসি
তবে এই প্রসঙ্গে একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা জানাই। চোরেরা কিন্তু এ দিন সবসময় চেষ্টা করে কোনও না কোনও ঘুমিয়ে থাকা গেরস্তর বাড়ি থেকে কিছু চুরি করে আনতে। হয় জানলা দিয়ে হাত বাড়িয়ে, নয়তো আঁকশি দিয়ে টেনে এনে, নিদেন দেওয়াল বেয়ে ছাদে উঠে সেখান থেকে কোনও কিছু তুলে নিয়ে। একান্ত নিরুপায় হলে বাগানের কলাটা-মুলোটা নিঃশব্দে পেড়ে এনে তারা তাদের জীবিকার এই সংস্কার বজায় রাখে। আগেকার দিনে কোজাগরীর রাতে অবস্থাপন্ন গৃহস্থ বা কৃষকের বাড়ির গোলাঘর থেকে চালের বস্তা চুরি করতে পারলে সেই চোরকে একটা আলাদা বাহবা দেওয়া হত। তবে একমাত্র ঘুঘু প্রকৃতির চোরেরাই এ দিন রাতে বাড়ির দেওয়ালে সিঁদ কেটে, টাকাপয়সা বা কাঁসা-পেতলের বাসনকোসন সাফ করে দেওয়ার মতো সাহস এবং হিম্মত রাখত। কারণ এক বার ধরা পড়লে তো কেউ আর শুনবে না যে, এ নিজের ধর্ম রক্ষার জন্যই শুধু চুরি করতে এসেছে। নইলে অন্যান্য গেরস্তর মতো সে-ও সে দিন রাতে ঘরে বসে রেডিয়ো শুনে অফ-ডে পালন করত। তাই ওকে মোলায়েম করে ক’ঘা দিয়ে মানে-মানে ছেড়ে দাও বাপু! বেশি ঠেঙিয়ো না!
আরও পড়ুন: পরের বছর দুর্গাষষ্ঠী ২২ অক্টোবর, মহালয়া পড়েছে ১৭ সেপ্টেম্বর
কোনও কোনও বিচক্ষণ বাঙালি আবার এটাও বলে থাকেন যে চোরেদের সারারাত নিজেদের বাড়ির কাছ থেকে দূরে রাখার জন্যই গেরস্তরা কোজাগরী পূর্ণিমায় রাত জাগে। আর সে দিন রাতে চোরের হাতে ধনসম্পত্তি চুরি না যাওয়াটাই হল তাদের সৌভাগ্য। চোরেরা শঙ্খের আওয়াজে, পাঁচালি পাঠ করার শব্দে কিংবা বাড়ির দরজার সামনে করা আল্পনার কারুকাজ দেখেই বুঝতে পারে, এই বাড়িতে লক্ষ্মীপুজো হয়েছে। মানে, গেরস্ত জেগে আছে। তাই তখন তারা সেই বাড়িটিকে এড়িয়ে যেত। আর আশপাশের কোনও পুজো না হওয়া বাড়িকে ঠান্ডা মাথায় টার্গেট করত।
সবাই জানে, মা লক্ষ্মীর বাহন হল পেঁচা। তারা এটাও জানে, দুনিয়ার সব পেঁচাই বারো মাস ইনসমনিয়ায় ভোগে। মানে, সারারাত জেগে থাকে। রাত্তিরে ধানের খেতে মেঠো ইঁদুরেরা যখন ধান চুরি করে খায়, তখন পেঁচা তাদের খপাখপ ধরে এবং নিজেদের পবিত্র ‘সাপার’ সমাধা করে। এই জন্যই পেঁচা মা লক্ষ্মীর বাহন। ওরা গেরস্তর সংসারের চুরি আটকায় এবং তারা ঘুমিয়ে থাকলেও তাদের সম্পদ রক্ষা করে। কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোর রাতে, প্যাঁচাকে প্রতীক ধরে নিয়ে ভক্ত গেরস্তরাও তাই জেগেই রাত কাটান এবং নিজেদের ধনসম্পত্তি চোরেদের হাত থেকে রক্ষা করার প্রাণপণ চেষ্টা করেন। তাই চোরেরা যেমন কোজাগরীর রাতে চুরি করার বিষয়টা পাবলিকের কাছে চেপে যায়, গেরস্তও তেমনই সে দিন সারারাত জেগে থাকার আসল কারণটা জনসমক্ষে ফাঁস করতে চায় না। কারণ করলেই তো সেটা সবার আগে চোরেদের কানে পৌঁছে যাবে!
কার্টুন: দেবাশীষ দেব
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy