এ বারের পুজো কার, চট করে বলা মুশকিল। সবার উপরে কোভিড সত্য, তাহার উপর নাই। ছোটদের ঘ্যানঘ্যান, ঢাকের শব্দ সব এক সুরে বাজছে। আপাতত শ্যাম রাখি না কূল, সেই হিসেবে ব্যস্ত আম পাবলিক। জামা-জুতোর মতো মাছ-মাংস-সব্জি অনলাইনে মিলছে শহরে, এমনকি শহরতলিতেও। সে সব সুন্দর করে কাটা-ধোয়া, একেবারে রেডি-টু-কুক। কেউ কেউ আবার অর্গ্যানিক তকমা লাগিয়ে বাজারে চওড়া টুইস্ট এনে দিয়ে দিয়েছে। ব্যাঁকা পটল, চিমসে সিম আর পোকায় কাটা শাক আপাতত সুপারহিট! ‘জগৎসভায় শ্রেষ্ঠ আসন লবে’ বলে দৌড়চ্ছে কোভিড চক্করে ইমিউনিটির রাজাধিরাজ লেবু।
চাহিদা তুঙ্গে, তাই বাজারে হরেক লেবুর ছড়াছড়ি। যে যেটা পারছে সাপ্লাই দিচ্ছে। কেউ ‘ছোটোদের ছবি’র মতো চোখে পড়ে না, কেউ বা পেল্লায়। আমরা ছাপোষা মানুষ লাইম আর লেমনই সারা জীবন ধরে বুঝলাম না। লাইম আমাদের পাতিলেবু। আকারে গোল, রঙ বেশির ভাগ সময়েই সবুজ, সামান্য হলুদ পাকলে। লেমন আকারে অনেকটাই বড়, ডিম্বাকৃতি, গাঢ় হলুদ বর্ণ। দু’টিই স্বাদে টক। আবার অনেক লেবু মিষ্টিও হয়। জানি, আপনারা এ বার সকলে লাফালাফি শুরু করবেন- কমলা, মুসম্বি, বাতাবি এই করোনাকালে আপনাদের নিত্যকার ডায়েট। এই সব লেবু যে কেবল মিষ্টি তা নয়, টক আছে, স্বাদে কটুও আছে। লাইম ও লেবুর স্বাদের তারতম্য অনুসারে ব্যবহার করা হয় নানা রান্নায়। ভিনিগারের বিকল্প হিসেবে তো বটেই, এর জারকগুণের পাশাপাশি চনমনে স্বাদ ও গন্ধেই সে মাত করে রাখতে পারে আপনাদের গৃহবন্দি পুজোর দিনগুলো। হরেক রান্নায় ও স্বাদে। আবার কোনও রান্নায় হয়তো টক চাই না, কিন্তু লেবুর স্বাদ বা গন্ধ চাই। তখন আমরা ব্যবহার করি লেবুর খোসা বা লেবুর পাতা।
আরও পড়ুন: লবস্টার থার্মিডোর থেকে ল্যাম্ব চপস, ‘চ্যাপ্টার-২’-এর এলাহি আয়োজনে স্বাগত
ইদানীং বাজারে বেশ ছেয়ে গেছে এক লেবু, তার পোশাকি নাম রংপুর। দেখতে মুসম্বির মতো বড়, ও গাঢ় সবুজ, ভিতরে কমলা। এটি এক ধরনের লাইম, হাইব্রিড লেবু অবশ্যই। হাফ লেবু, হাফ কমলা, ভিটামিন সি-তে ভরপুর। পাতি লেবুকে গুনে গুনে দশ গোল দেবে। এই লেবুকে শরবতি লেবু বা সিলেট লাইম বলেন অনেকে। দক্ষিণ চায়নায় ফলে প্রচুর এই ক্যান্টনি লেবু, যা ক্যান্টনিজ রান্নায় ব্যবহার হয় আকছার। জাপানি রান্নায় এই লেবুর ব্যবহার আছে হাইম নামে। এর সিরাপ বা স্কোয়াশ বানিয়ে রাখতে পারেন। রংপুর মার্মালেড বেশ জনপ্রিয় হয়েছে ইদানীং। পাউরুটির সঙ্গে পুরু করে মাখিয়ে সকাল সকাল করোনা টেস্ট করে ফেলতে পারেন ঘরে বসেই। এর স্বাদ ও গন্ধ দুটোই প্রবল। যাঁরা মার্মালেড বানাতে জানেন, তাঁরা ট্রাই করুন। সকাল সকাল ভিটামিন সি একরাশ তরতাজা অনুভুতি জুগিয়ে আপনাকে চনমনে করে তুলবে সারা দিনের জন্য। রংপুর লেবুর মার্মালেড বানানোর উপকরণ ও অনুপাত এক বার বলে দিই- ১২টি রংপুর লাইম, ৫টি পাতি লেবু আর চার কাপ চিনি। বানানোর পদ্ধতি ইউটিউবে সহজলভ্য। প্রথম করলে এক বার দেখে নেবেন।
রংপুর লেবুর মার্মালেড
আপনারা নানা দোকানের লেমন চিকেন বা লেমন ফিশ খেয়ে থাকেন। তাও ট্রাই করতে পারেন এই বাহারি লেবু দিয়ে। এমনকি বিরিয়ানিও। পাকিস্তানের জনপ্রিয় ফুড ইউটিউবার, ‘ফুড সায়েন্টিস্ট’ নানা রকম স্বাদের বিরিয়ানি নিয়ে পরীক্ষা করতে অভ্যস্ত। এই বিরিয়ানি কাচ্চি, অর্থাৎ রান্না হয় কাঁচা মাংস দিয়ে। কাঁচা মাংস ম্যারিনেট করা হয় কাঁচা পেঁপে বাটা দিয়ে। তার মধ্যে স্বাদ ও গন্ধ প্রবেশ করাতে বাটার সময় পুদিনা ও লেবু চাকা চাকা করে কেটে দিতে দেখেছি। আমি খেয়েছি এই বিরিয়ানি খাস কলকাতায়। লকডাউনের মধ্যে ‘স্বাদ সঞ্চয়িতা’র লেখক সামরান হুদার হাতে তৈরি। স্বাদে গন্ধে এই বিরিয়ানি একেবারেই ভিন্ন মাত্রার। বিরিয়ানির দমে বসানোর আগে যখন সাজাবেন, এক একটি লেয়ারে চাকা চাকা করে কাটা রংপুর লাইম যোগ করুন। খোসাসুদ্ধ লেবু স্লাইস করবেন। বীজগুলো আলগা করে ফেলে দেবেন। দেখতেও চমৎকার লাগে, বেশ রথের চাকার মতো। পরিবেশনের সময়ে প্রতি প্লেটের উপরে দিন এক ফালি লেবু। এই বিরিয়ানি খেতেও খুব প্রাণবন্ত। এ বার পুজোয় এক দিন অবশ্যই ট্রাই করুন। চিকেন-লেমন বিরিয়ানি করলে মারিনেট করতে পেঁপেও লাগে না। লেবুই তার একমাত্র প্রণয়ী।
আরও পড়ুন: রেস্তরাঁর মতো ডেজার্ট বানান বাড়িতেই
কলকাতায় শিয়ালদহ ফ্লাইওভারের নীচে পাশাপাশি দুটি চপের দোকান খুবই বিখ্যাত। সুরুচি ও অভিরুচি। যখনই যান, দেখবেন এঁটো শালপাতা ড্রাম উজিয়ে আপনার দিকে এগিয়ে আসছে। এদের বিখ্যাত চপটি আমের আচারের চপ। ভাজা জোয়ানের গুঁড়ো ও বিট নুন মাখিয়ে পরিবেশন করে। এক বার যদি খেয়ে থাকেন, তা হলে নিশ্চয় ভোলেননি। সেই কায়দায় ঘরেই বানিয়ে ফেলুন লেবুর আচারের চপ। কারণ এ বার পুজোয় আপনি যাচ্ছেন না সন্তোষ মিত্র স্কোয়ার বা কলেজ স্কোয়ারের লাইনে, অর্থাৎ অভিরুচি অভিমুখে। গ্যারান্টি দিচ্ছি এক বার খেলে মনে হবে, এই পুজো যদি না শেষ হয়, তবে কেমন হত? তুমি বল তো! কায়দার চপ। এতে ব্যবহার করা হবে কেবল নুনে ডুবিয়ে রেখে বানানো লেবুর আচারের খোসার অংশ। এর সঙ্গে তৈরি করবেন আলুর চপের মতো পুর, আলু সেদ্ধ করে জিরে ও শুকনো লঙ্কার গুড়ো দিয়ে মেখে নিন। চপের এক পাশে কাপড় শুকোতে দেওয়ার মতো মেলে দিন লেবুর আচারের খোসা। বেসনের ব্যাটারে ডুবিয়ে ভাজুন। রেডি আপনার ভিটামিন সি-দুরুস্ত জলখাবার!
প্রণালী: ডিনারে খাওয়া যাক লেমন রাইস আর ট্যাঞ্জারিন ফিশ। ট্যাঞ্জারিন যে কোনও বড় ফলের দোকানে পাবেন। আমাদের দার্জিলিং বা নাগপুরের কমলা নয়, এর গা চকচকে মসৃণ। স্বাদে টক ভাব একদম নেই। জনা চার মানুষের জন্য দুটো ট্যাঞ্জারিন নিন। জুস করে নিন ১/২ কাপ। গ্যালাংগ্যাল জোগাড় করুন। এখন সব বড় সবজি বাজারেই পাওয়া যায়। আমি কিনি যদুবাবুর বাজার থেকে। এতে আপনারা অন্য সব্জিও দিতে পারেন। দিলে দেখতে কালারফুল হয়। চৌকো করে কাটা গাজর, মাশরুম, ব্রকোলি দিয়ে শেড আনা সম্ভব। এই রান্নার কুকিং টাইম ১৫-২০ মিনিট। কাজেই সব্জি দিলে তা ভাপিয়ে নেবেন আলাদা। একটা পাত্রে ট্যাঞ্জারিন জুস, সয় সস, কর্নফ্লাওয়ার দিয়ে ভাল করে মেশান। মাছ ও পরিমাণ মতো নুন দিয়ে স্যস মাখিয়ে রাখুন। প্যান গরম করে সাদা তেল দিন। মাছের পিস জুস-সহ তেলে দিয়ে দ্রুত নাড়তে থাকুন। ভিজে বাদাম খোসা ছাড়িয়ে দেবেন। একদম ঘন হয়ে গেলে গ্যালাংগ্যাল ছড়িয়ে নামিয়ে নিন। পরিবেশনের সময়ে খেয়াল রাখুন প্রত্যেক মাছের টুকরোর উপর যেন দু’চারটি নৃত্যরত গ্যালাংগ্যাল বর্তমান থাকে। আজি খাবার প্লেটে রৌদ্রছায়ায় ভিটামিন সি-র খেলা রে ভাই, ভিটামিন সি-র মেলা!
ছবি সৌজন্য: লেখক।
গ্রাফিক চিত্র: তিয়াসা দাস।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy