প্রতীকী ছবি
বছর ছয়েক আগের কথা। সদ্য বিবাহিতা আমি তখন সবে প্রিয় কলকাতার মায়া কাটিয়ে কর্তার হাত ধরে বিদেশে এসেছি। অবশ্য নামেই বিদেশ, আসলে পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ার এই ছোট্ট শহর পার্থ আমাদের মফস্সল শহরের থেকেও বেশি শান্ত। বিকেল পাঁচটার মধ্যে সব দোকান-পাট বন্ধ হয়ে যায়, রাস্তাতেও হাতে গোনা লোকজন দেখা যায়। এদিকে দেখতে দেখতে দুর্গাপুজা এগিয়ে আসে, কলকাতা যাবারও কোনো উপায় নেই। মন-মেজাজ ভীষণ খারাপ করে পুজোর আগের সপ্তাহান্তে বাড়িতে আছি, এমন সময় এক বন্ধু একরকম জোর করেই নিয়ে গেল স্থানীয় বেঙ্গলি এসোসিয়েশনের পুজো দেখতে। মুসলধারে বৃষ্টি মাথায় করে সেখানে পৌঁছাতেই ঢাকের শব্দ কানে এলো আর এলোমেলো মনটা একঝটকায় ভালো হয়ে গেলো। দেখলাম এখানকার সব বাঙালিরা মিলে একসাথে পুজোর জোগাড় করছে, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ভোগের খিচুড়ি রান্না হচ্ছে, চারদিকে গোল করে বসে সবাই আড্ডা দিচ্ছে। ঠিক যেন একটা বড় পরিবারের বাড়ির পুজো। মুহূর্তে আপন করে নিলো তারা আমায়, মিশে গেলাম সবার সাথে, হৈহৈ করে কাটালাম প্রবাসে আমার প্রথম দুর্গাপুজো।
প্রায় ২৪লাখ জনসংখ্যার শহর পার্থে নয় নয় করে বাঙালির সংখ্যা কিছু কম না। কথায় বলে ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভাঙে আর বাঙালি যেখানেই যাক দুর্গাপুজো তো হবেই। পার্থে দুর্গাপুজোর সূচনা এখানকার প্রধান বাঙালিদের সংগঠন ‘বেঙ্গলি এসোসিয়েশন অফ ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়া’ বা ‘বাওয়ার’ হাত ধরে। ১৯৯০-এ শুরু হওয়া এই পুজো এই বছর ৩০ বছরে পা দিলো। অবশ্য এখন ‘বাওয়া’ ছাড়াও আরো বেশ কিছু সংগঠন পুজোর আয়োজন করে যেমন 'প্রবাসী বেঙ্গলি অফ পার্থ,’ বাংলাদেশ অস্ট্রেলিয়া এসোসিয়েশন অব এসোসিয়েশন অফ ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়া (‘বাওওয়া’) ইত্যাদি। যেহুতু সারা সপ্তাহ সবাই যে যার কর্মজীবনে ভীষণ ব্যস্ত থাকে, তাই এখানে পুজো সব সময় দিনক্ষণ মেনে পাঁজি ধরে করা সম্ভব হয় না। মোটামুটি পুজোর আগের বা পরের শনি-রবিবারকে বেছে নেওয়া হয়। শুক্রবারের বিকেলে দুর্গোৎসব শুরু হয় দেবীর বোধন দিয়ে, তারপর শনিবার সপ্তমী-অষ্টমীর পুজো, আর রবিবার নবমী-দশমীর পুজো হয়। গাঁদা বা গোলাপি পদ্মের জায়গায় গোলাপ বা রংবাহারি অর্কিডে এখানে ঠাকুর সেজে ওঠে। অষ্টমীর সন্ধিপুজোয় থাকে ১০৮টি জ্বলন্ত প্রদীপের বদলে ব্যাটারির টুনি বাল্ব। সেদিক দিয়ে দেখতে গেলে হয়তো কলকাতার মতো পুজোর আয়োজনে অল্প-বিস্তর বদল থাকলেও, ফাঁক থাকে না মার্ আরাধনায়, কম পড়ে না পুজোর আনন্দ। এতদিন যত্ন করে তুলে রাখা শাড়ি পাঞ্জাবি পরে পার্থের বাঙালিরা হাজির হয় কোনো এক কমিউনিটি হলে। ছোট্ট খুদেরাও নতুন পাঞ্জাবি পরে অঞ্জলি দেয় মায়ের পায়ে, আলাপ করে নেয় দুগ্গা, সরস্বতী, গনেশ ঠাকুরদের সাথে।
বাঙালি পুজোর একটা বড় অংশ খাওয়া-দাওয়া। এ-কদিন এখানকার বাঙালিরা বাড়ির রান্নার পাট তুলে ছেলে-মেয়ে নির্বিশেষে কোমর বেঁধে নেমে পড়ে ভোগ রান্না করতে। খিচুড়ি, লাবড়া থেকে শুরু করে লুচি, আলুরদম, মিষ্টি, দই, চাটনি কত কিছুই না থাকে পুজোর ভুড়িভোজে! তারপর দশমীর সন্ধেয় থাকে বিশেষ আয়োজনে থাকে ভাত আর পাঁঠার মাংস! শারদীয়ার সন্ধ্যেটা আরও উৎসবমুখর করে তুলতে আয়োজিত হয় কচিকাঁচাদের সাংস্মৃতিক অনুষ্ঠান, বড়দের শাঁখ বাজানোর প্রতিযোগিতা, ধুনুচি নাচের কম্পেটিশন। রবিবার সকালে মহিলারা লাল পেরে সাদা শাড়ি পরে মাকে বরণ করে নেয়, সিঁদুর খেলার পর ঢাকের তালে নাচে মেতে ওঠে সকলে। আমাদের প্রবাসের দুর্গা ঠাকুর তারপর আবার যত্ন করে তুলে রাখা হয় কাঠের বাক্সে পরের বছরের জন্য। এত আনন্দের মধ্যেও চোখের কোনটা জলে চিক চিক করে ওঠে।
আসলে দুর্গাপূজা শুধুমাত্র তো একটা ধর্মীয় অনুষ্ঠান না, এ এক মানবতার উৎসব, আমাদের নিত্যদিনের একঘেয়ে জীবনের মধ্যে একটুকরো আলোর বেনু। তাই নাই বা বাতাসে ভাসুক শিউলি ছাতিমের গন্ধ, নাই বা সার দিয়ে ফুটুক কাশফুলের দল, নাই বা থাকুক থিম পুজোর রমরমা, তবু সারা বছর অপেক্ষা করে শারোদৎসবের এই আনন্দ পার্থের বাঙালিরা চেটেপুটে নেয় এই প্রবাসের পুজোর মাধ্যমে। পুজো সবার ভালো কাটুক, শুভ শারদীয়া।
এই প্রতিবেদনটি 'আনন্দ উৎসব' ফিচারের একটি অংশ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy