বাঙালি মানেই রবীন্দ্রনাথ, বাঙালি মানেই ফুটবলে ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান, বাঙালি মানেই মাছ-ভাত আর বাঙালি মানেই দুর্গাপুজো। বাঙালির কাছে দুর্গাপুজো শুধু একটা উৎসব নয়। দুর্গাপুজো আমাদের আবেগ, আমাদের নস্ট্যালজিয়া, আমাদের কৈশোরপ্রেমের সাক্ষী। সারা বছর আমরা অপেক্ষা করে থাকি এই চারটে দিনের জন্যে। যতই ক্লিশে শোনাক, শরতের নীল আকাশে পেঁজা তুলোর মতো মেঘ দেখলেই ভুলে যাই রোজকার একঘেয়ে জীবন, আর সাত-সতেরো জটিলতার কথা। মেতে উঠি উমার বাপেরবাড়ি আসার আনন্দে।
আমার জন্ম, বড় হওয়া সব খাস উত্তর কলকাতার বাগবাজারে। যেখানে দুর্গাপুজো মানেই সার্বজনীনের ডাকের সাজের প্রতিমা। প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে ঘোরা, বন্ধুদের সঙ্গে চুটিয়ে আড্ডা, প্রথম বার মায়ের শাড়ি পরে অষ্টমীর অঞ্জলি দেওয়া, ভিড়ের মধ্যে কৈশোরের ভাললাগাকে দেখে আলতো হাসি, বিয়ের পরে সার্বজনীনে সিঁদুর খেলা। টুকরো টুকরো এ রকম কত স্মৃতিতে ভরে আছে কলকাতার পুজো!
কর্মসূত্রে ভারতের সিলিকন ভ্যালি বেঙ্গালুরুই এখন আমার ঠিকানা। কিন্তু অফিসের বহুতলের ফাঁক দিয়ে যখনই দেখি শরতের সাদা মেঘ, বাতাসে পুজো-পুজো গন্ধ পাই যেন। আর তখনই কলকাতার জন্য ভীষণ মন কেমন করে ওঠে। ইচ্ছে করে, একছুট্টে ঘরে ফিরে যাই।
ব্যস্ত এই শহরে পুজোর দিনগুলো সে ভাবে আলাদা করে বোঝা যায়না। বেঙ্গালুরুর ‘কুখ্যাত’ যানজট ঠেলে অফিস যেতে যেতে ভুলেই যাই যে মহালয়া চলে গিয়েছে, দিন কয়েকের মধ্যেই পুজো। রাস্তার মোড়ে মোড়ে বাঁশ পুঁতে প্যান্ডেল বানানো নেই, না আছে মাইক, না ঢাকের আওয়াজ। কিন্তু যেখানে বাঙালি সেখানেই তো বারো মাসে তেরো পার্বণ! আর সাড়ে পাঁচ লক্ষ বাঙালির বাস যে শহরে, সেখানে তো দুর্গাপুজো হবেই!
এই শহরে ছোট-বড়ো মিলিয়ে একশোরও বেশি পুজো হয়। সাউথ বেঙ্গালুরুর জেপি নগরেই প্রায় চল্লিশটা পুজো হয়।
পুজোর কয়েক মাস আগে আরটি নগর এবং আরও বেশ কিছু জায়গায় বাংলা থেকে মৃৎশিল্পীরা আসেন। সঙ্গে নিয়ে আসেন কুমোরটুলির মাটিও। আজকাল তো থিম পুজোর রমরমা। পিছিয়ে নেই বেঙ্গালুরুর বাঙালিরাও। কোথাও মহাকাশযান, কোথাও জঙ্গলের ভিতরে গুহা, আবার কোথাও বা পুরনো দিনের জমিদারবাড়ি— হরেক রকমের প্যান্ডেল। বাঙ্গালি অ্যাসোসিয়েশনগুলোর দৌলতে ঘরোয়া পরিবেশে পুজো দেখা, পুজোর নানা কাজে অংশ নেওয়া, অষ্টমীর অঞ্জলি, সন্ধিপুজো থেকে শুরু করে ঢাকের তালে ধুনুচি নাচ আর লাইন দিয়ে ভোগ খাওয়া, এ সব নিয়েই মেতে থাকি আমরা। এর সঙ্গে থাকে বাঙালি শিল্পীদের জমজমাট অনুষ্ঠান।
কলকাতার মতো পুজোকে ঘিরে সেই উন্মাদনা হয়তো নেই, নেই সার্বজনীনের সাবেকিয়ানা, কলেজ স্কোয়ারের আলোর জাদু বা ম্যাডক্স স্কোয়ারের আড্ডা। কিন্তু নিজেদের শহর থেকে অনেক দূরে এ ভাবেই আমরা আমাদের মতো করে মেতে উঠি পুজোর আনন্দে। আর শেষ বেলায় দশমীর সিঁদুরখেলা শেষে চোখের জলে মাকে বিদায় জানিয়ে বলি ‘আবার এসো মা’। ঘর ছেড়ে দূরে থাকে যারা, তারাই তো বোঝে ঘরে ফেরার আনন্দ!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy