প্রকৃতির সঙ্গে সমন্বয় রেখেই তো মানুষের জীবন। ঋতুর পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের জীবন ধারার পরিবর্তন ঘটে। পৃথিবীর সব প্রান্তের মানুষই প্রকৃতি নির্ভর।
বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণ। প্রতি পার্বণের সময়ক্ষণ নির্ধারিত হয় ঋতুর সঙ্গে সমন্বয় রেখে। গ্রীষ্মের দহন জ্বালায় যখন মানুষ জর্জরিত, প্রকৃতি দেবী নিয়ে আসেন তখন বর্ষা ঋতুকে। বর্ষণসিক্ত ধরিত্রী মিষ্টি সূর্যালোকের স্পর্শে যখন গাছে গাছে ফুলের সম্ভারে ভরিয়ে দেন, স্বচ্ছ নীল আকাশে তখন ভেসে আসতে থাকে সাদা মেঘরাশি, শরতের আগমন। শিউলি ফুলের প্রাণ মাতানো গন্ধে, বাংলাদেশের মাঠেঘাটে ফুটে থাকা কাশফুলের হিল্লোলে মন মাতোয়ারা হয়। মন ছুটে যায় চণ্ডীমণ্ডপের আটচালাতে, যেখানে কুমোর ঠাকুর গড়ার কাজে মগ্ন। দুর্গাপূজার আগমন বার্তা পৌঁছে যায় দিক-দিগন্তে।
বাঙালির সব উৎসবের মহোৎসব দুর্গাপূজা হয় শরৎ ঋতুতে, তাই তো শারদীয়া উৎসব। আবালবৃদ্ধবনিতা সারা বছর প্রতীক্ষা করে থাকে এই শরতের আগমনের। প্রকৃতি দেবী যেন নিজেই সেজে ওঠেন এই শারদীয়া উৎসবকে উপলক্ষ করে। শহর থেকে গ্রামগঞ্জে সাজসাজ রব। ঢাকে কাঠি পড়তেই শুরু হয়ে যায় দুর্গাপূজার আগমনী।
আরও পড়ুন : অর্পিংটনে উৎসব: বিভুঁই বিদেশ ছোট্ট পাড়া, শুনছি মায়ের কড়া নাড়া
এমন এক সময়েই, প্রত্যুষের আলো ফোটার আগেই রেডিওতে বেজে ওঠে মহালয়ার মহিষাসুরমর্দিনী, শঙ্খধ্বনিতে শুরু হয় সমবেত কণ্ঠে আনন্দময়ীর গান। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের তেজোদীপ্ত কন্ঠে শুরু হয় মহালয়ার ভাষ্যপাঠ। একাত্ম হয়ে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনতে হয়। রোমাঞ্চিত হতে হয় ক্ষণে ক্ষণে। মহালয়া দিয়েই শুরু হয়ে যায় শারদীয় উৎসব দুর্গাপূজা।
মহালয়ার দিনটি সমস্ত বাঙালির কাছে পুণ্যের দিন। পৃথিবীর উত্তর গোলার্ধের প্রান্তিক দেশ নরওয়ের অসলো শহর ও শহরতলির স্থায়ী ও অস্থায়ী ভাবে বসবাসকারী বাঙালিরা ভোরের আলো ফোটার আগেই শুনতে বসে যান। কেউ ইন্টারনেট মারফত, আবার কেউ রেকর্ড চালিয়ে! কাশফুল এ দেশে না থাকলেও, মহালয়ার চণ্ডী পাঠ শুনতে শুনতে দুর্গাপূজার আগমন বার্তায় মনের কাশফুল হিল্লোলিত হয়।
২০০৯ সালের গ্রীষ্মের এক দুপুরে অসলো শহরের কাছাকাছির এক দ্বীপে, পাঁচ-ছ’টি বাঙালি পরিবার একত্রিত হয়েছিল বনভোজন উপলক্ষে। আনন্দ উদ্দীপনার সঙ্গে নানা বিষয় নিয়ে আলাপ আলোচনা চলছিল। তখনই প্রসঙ্গ আসে— বাঙালি হয়ে, নিজের দেশ থেকে এত দূরে, পৃথিবীর উত্তর গোলার্ধের এই অসলো শহরে দুর্গাপূজার ব্যবস্থা করলে কেমন হয়! শুরু হল আলোচনা, আলোচনা থেকে আয়োজনের প্রস্তুতি। করে ফেলা হল দুর্গাপূজার সম্পূর্ণ আয়োজন। তৈরি হল সংগঠন।
ঠিক হল, পরিচালনা ও তা সুসম্পন্ন করার দায়িত্বে থাকবে শুধুমাত্র মহিলারা। সেই থেকে আজ পর্যন্ত অসলো দুর্গাপূজা মহিলাদের দ্বারা সংগঠিত ও পরিচালিত। তবে সাহায্যকারী হিসেবে পুরুষেরাও কাজ ভাগ করে নেন। ২০০৯ সালে শুরু হয়ে, এ বছর ২০১৯ পর্যন্ত সেই ট্রাডিশন সমানে চলেছে। সমস্ত বাঙালি মিলে ৪০-৫০ জন সভ্য। এদের সঙ্গে একাত্ম হয়ে পুজোর যাবতীয় ব্যবস্থাদিতে ভাগ নেওয়া আমার মনের অনাবিল আনন্দের এক নতুন সংযোজন।
অসলো শহরে দুর্গাপূজা আয়োজনের প্রধান উদ্দেশ্য— আধ্যাত্মিকতার সাথে সাথে দুর্গাপূজার মাহাত্ম্য, বাঙালি সংস্কৃতি, আচার-ব্যবহার এবং ভারতীয় সভ্যতার বুনিয়াদ ছোটদের মধ্যে শক্ত করা, যাতে ভারতীয় সভ্যতা-সংস্কৃতি শিশুদের মধ্যে সুদৃঢ় ভিত তৈরি করতে পারে। বাঙালি ছাড়াও, অসলোর অন্যান্য ভারতীয় পরিবারবর্গের সঙ্গেও এই পুজো বন্ধুত্ব, মেলামেশা, সংস্কৃতির আদান প্রদানের সুযোগ করে দেয়। সর্বোপরি, মাতৃভূমি থেকে দূরে থেকেও দুর্গাপূজার মাধ্যমে অনাবিল আনন্দে একাত্ম হওয়া।
দুর্গাপূজাকে সর্বাঙ্গসুন্দর করতে, ঠিক হয় কলকাতার কুমোরটুলি থেকে প্রতিমা এনে পূজা করা হবে। ২০০৯ সালেই। সেই থেকে এই বছর, অর্থাত্ ২০১৯ পর্যন্ত কুমারটুলি থেকে আনানো দুর্গা প্রতিমাই পুজো হয়ে আসছে। ২০১৬ সালে অপেক্ষাকৃত বড় প্রতিমা বানানো হয়েছিল। দশকর্মার যাবতীয় উপকরণ প্রতি বছরই নিয়ে আসা হয়ে থাকে কলকাতা থেকে। এখন অসলো শহর থেকে কিছুটা দূরে ফুরুসেত ভেলহুস হলে দুর্গাপূজা করা হয়।
দুর্গাপূজার নির্ঘণ্ট মেনে, অর্থাৎ ষষ্ঠী-সপ্তমী-অষ্টমী-নবমী-দশমীতে প্রথা অনুযায়ী যে ভাবে পূজা হওয়া উচিত, সেই ভাবে বিদেশে পূজা করা একটু অসুবিধাজনক। বিদেশে সাধারণত দুর্গাপূজা উদযাপিত হয় সপ্তাহ শেষে অর্থাৎ শুক্র-শনি-রবিবার— যাতে সমস্ত ভারতীয় ছুটির দিনগুলোতে দুর্গাপূজার আনন্দ সর্বতোভাবে উপভোগ করতে পারেন। তবে এ বছর তো শুক্রতেই ষষ্ঠী পড়েছে। ফলে অনেকটাই তিথিসম্মত পুজো করা যাবে এ বার।
আরও পড়ুন: মণিকোন্ডায় গত বছরই আমরা দুর্গাপুজো শুরু করলাম
আমাদের দেশে ছয়টা ঋতুর হলেও, নরওয়েতে ঋতু চারটে। শরৎকাল না থাকায় নীল আকাশে সাদা মেঘের আনাগোনা দেখার আনন্দ পাওয়া যায় না। নরওয়ে এমনিতেই ভারী সুন্দর দেশ। এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে মন প্রাণ ভরে ওঠে। শুক্রবার সন্ধ্যায় ষষ্ঠী সপ্তমী পূজোর দিন যখন পূজামণ্ডপে পৌঁছই, হেমন্তের হিমের পরশ সারা শরীরে ছুঁয়ে যায়। পূজার দুদিন আগে থেকেই শুরু হয়ে যায় মণ্ডপসজ্জা। প্রবেশদ্বারের দুই পাশেই মাটির ঘটের উপরে ডাবের স্থাপনা। পুরোহিত মশাই সিঁদুর বর্ণে স্বস্তিকা এঁকে দিয়েছেন ডাবের উপরিভাগে। মৃদু ঢাকের আওয়াজ, কাঁসর ঘন্টার আওয়াজে মনের সঙ্গে সঙ্গে নেচে ওঠে পা দুটোও। পূজামণ্ডপে প্রবেশ করলেই এক স্বর্গীয় পরিবেশে মন মাতোয়ারা হয়ে যায়। এত সুন্দর দুর্গা প্রতিমা— মনে হয় যেন সাক্ষাৎ জ্যোতির্ময়ী জগন্মাতা। কুমারটুলির স্বনামধন্য শ্রী কৌশিক ঘোষ একচালার এই মৃন্ময়ী মূর্তি গড়েছেন। গণেশ ঠাকুরের ডান পাশে কলা বউ-এর স্থাপনায় প্রতিমা সর্বাঙ্গসুন্দর। প্রতিমার পিছনের দিকে রক্তিম বর্ণের শালু। তার উপরে আমাদেরই সভ্যদের করা অঙ্কন শিল্পের সুন্দর ব্যবহার। উপরে ইংরেজিতে ‘অসলো দুর্গাপূজা সন ২০১৯’ লেখা। প্রতিমার দুই পাশে প্রদীপের সমারোহ। বেদির নিম্নভাগের সামনে দণ্ডী সমেত ঘটস্থাপন। পুরোহিত সযত্নে সম্পূর্ণ বৈদিক মতে সমস্ত ব্যবস্থা করেন। পূজামণ্ডপের দেওয়ালে লাগানো হয় সভ্যদের অঙ্কন শিল্পের নানান সৃষ্টি, যা প্রত্যেককে দেয় আলাদা আনন্দ ও তৃপ্তি।
শুক্রবার সন্ধ্যায় শুরু পূজার বোধন, আমন্ত্রণ, অধিবাস, সন্ধ্যারতি, পুষ্পাঞ্জলি ও প্রসাদ বিতরণ— এমনই সূচিতালিকা। পূজামণ্ডপ সভ্যগণ ও তাদের পরিবারবর্গের আগমনে জমজমাট। ঢাক ও কাঁসর ঘন্টা বেজে চলেছে, নতুন পোশাকে শিশুদের কলরব, ধুতি পাঞ্জাবি পাজামা ও ঝলমল শাড়িতে পুজোমণ্ডপ খুশিতে মাতোয়ারা। দুর্গাপূজায় প্রথম বর্ষে অল্পসংখ্যক যোগদান থাকলেও, উত্তরোত্তর নরওয়ের বিভিন্ন শহর থেকে আসা বাঙালি ও অবাঙালির যোগদানে এই সংখ্যা উল্লেখযোগ্য ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। পূজায় অংশ নিতে আসেন অনেক নরওয়েজিয়ানরাও, যাঁদের মধ্যে মহিলাদের সংখ্যা বেশি।
পরের দিন শনিবারে নির্ধারিত থাকে সপ্তমী, অষ্টমী পূজা, সন্ধিপূজা। হেমন্তের ঝিরঝিরে বৃষ্টির বিড়ম্বনা উপেক্ষা করে ভক্তগণ দলে দলে আসেন পূজামণ্ডপে। অষ্টমী পূজার পর দুর্গাপূজার বিশেষ আকর্ষণ সন্ধিপূজা, যা দেখার জন্য সকলেই অত্যুৎসাহে অপেক্ষা করেন। একশত আটটা প্রদীপের আলোয় ঝলমল করে মণ্ডপ। কী অপরূপ শোভা! সন্ধিপূজাতে একশত আটটা পদ্মফুল চাই। নরওয়েতে পদ্মফুল পাওয়া যায় না। ফলে অবিকল পদ্মফুলের মত দেখতে ভেলভেট-এর পাপড়ির মত যারমিনী ফুল দিয়ে মায়ের পূজা হয়। ধুনুচিতে ধুপ পড়তেই পূজামণ্ডপ স্বর্গীয় মাত্রা পায়। জ্বলন্ত একশত আটটা প্রদীপের আলোয় ও একশত আটটা যারমিনী ফুলের শোভায় সন্ধিপূজা হয়ে ওঠে নয়নাভিরাম। কাঁসর ঘন্টা ঢাক শঙ্খ ও উলুধ্বনিতে মুখরিত হয়ে ওঠে সন্ধিপূজা। এই স্বর্গীয় পরিবেশ সকলের সঙ্গে পুষ্পাঞ্জলি দিতে আসেন বহুসংখ্যক নরওয়েজিয়ানও, যাঁরা পুষ্পাঞ্জলি দেন অন্তরের অন্তস্থল থেকে। অসলো দুর্গাপূজার বৈশিষ্টের মধ্যে এ এক বিশেষ সাফল্যের সংযোজন। অসলো দুর্গাপূজা হয়ে ওঠে সকল মানুষের মিলন ভূমি।
অষ্টমী পূজা ও সন্ধিপূজার জন্য ভোগ রান্নার ভার মহিলারাই নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেন। এ ছাড়া এই তিন দিনের পুজোয় সমস্ত ভক্তের জন্য রোজই ভোগ খিচুড়ি তরকারি ও অন্যান্য খাবার রান্নার ভার পুরুষেরা ভাগ করে নেন। এই বিপুল আয়োজনে পুরুষদের আন্তরিক সহযোগিতা বিশেষও তাৎপর্যপূর্ণ।
মানুষের জীবনে ফুল ও সঙ্গীতের মাহাত্ম অপরিসীম। ফুল ও সঙ্গীতের প্রভাবে মানুষের জীবনে ভেসে আসে অনাবিল আনন্দ। সামাজিক সংস্কৃতির পটভূমি এই দুই-এ নিবন্ধ।
অসলো দুর্গাপূজায় প্রতি বছরই অষ্টমীর সন্ধ্যায় বিশেষ সংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা থাকে। প্রথম বর্ষের দুর্গাপূজার জন্মলগ্নে সমস্ত মায়েদের যে উদ্দেশ্য ছিল, তাকে স্মরণ করে শিশুদের ও কিশোর-কিশোরীদের নাচ-গান, কবিতা আবৃত্তিতে উৎসাহ দেওয়া হয় যা সকলকে মুগ্ধ করে। বিদেশে থেকে ইংরেজি ও নরওয়েজিয়ান ভাষায় পড়াশোনা করেও, বাংলা ভাষা শিখে কত সুন্দর ভাবে পরিবেশন করা যায় তার বিশেষ উদাহরণ এই সমস্ত শিশুরা ও কিশোর-কিশোরীরা। তাদের পারদর্শিতার অন্তরালে মায়েদের নিরলস প্রচেষ্টা ও তালিম সর্বতোভাবে তারিফ করার মতো।
রবিবার, শেষ দিনের অনুষ্ঠানের সূচি নবমী ও দশমী পূজা, ধুনুচি নাচ, ঠাকুর বরণ, সিঁদুর খেলা ও দধিমঙ্গল। পরিশেষে ঘটের দণ্ডী কেটে পূজার সমাপ্তি ঘটানো হয়। প্রতিমা বিসর্জন হয় না, কারণ এই প্রতিমাই পরের বছর পূজা করা হয়।
এই বছর ২০১৯ সাল অসলো দুর্গাপূজারএকাদশ বর্ষ। দেখতে দেখতে পার হয়ে গেছে দশটা বছর। যে নিষ্ঠা ভক্তি শ্রদ্ধা আন্তরিকতা সুপরিচালনা ও সুসংগঠনার সাথে অসলো দুর্গাপূজা করা হয়, তার সম্পূর্ণ প্রতিফলন এ বছরের পূজাতেও প্রতিফলিত হবে।
পাদপ্রদীপের অন্তরালে অসলো পুজোর সকল সভ্যদের সুপরিকল্পিত ও সুপরিচালিত দুর্গাপূজা সর্বতোভাবে সাফল্যমন্ডিত উত্তরোত্তর আরও শ্রীবৃদ্ধি লাভ করুক, করুণাময়ের কাছে এই প্রার্থনা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy