কলকাতায় আমাদের ঠিক বাড়ির সামনেই রাস্তা জুড়ে দুর্গাপুজোর প্যান্ডেল বাধা হয়। ছোটবেলা থেকেই প্যান্ডেলের প্রথম বাঁশটা পড়া থেকে ঠায় বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকতাম। দেখতাম, একটা একটা করে বাঁশ গেঁথে গেঁথে কী ভাবে গড়ে ওঠে কাঠামোটা। নাওয়া-খাওয়া ভুলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতাম। আর ভাবতাম, কখন মূর্তি আনা হবে। আজ এত বছর পরে, কলকাতা থেকে এত দূরে থেকেও পুজো নিয়ে সেই উচ্ছ্বাস কিন্তু কমেনি।
এত বছর জাপানে থাকতে থাকতে দেখেছি, কলকাতার শরৎকালের সঙ্গে এখানকার শরতের আবহাওয়ার বেশ মিল। বেশ একটা ঠান্ডা ঠান্ডা ভাব। এই সময়ে আকাশ সাধারণত রৌদ্রোজ্জ্বল নীল। তবে কাশফুল দেখতে পাই না।
টোকিয়ো শহর ও তার আশপাশে দু’-তিনটি দুর্গাপুজো হয়। তার দু’টির আয়োজন করেন এখানকার প্রবাসী ভারতীয়েরা। একটির বয়স এ বার ৩০ বছর হবে। অন্যটি অবশ্য খুবই নবীন। এ বারে সে আট বছরে পড়ল। এ ছাড়া, প্রবাসী বাংলাদেশিরা একটি দুর্গাপুজো করেন বলেও শুনেছি।
আরও পড়ুন: ঐতিহ্যপূর্ণ সাবেকিয়ানাই নাগপুরের পুজোর বিশেষত্ব
ভারতীয়দের আয়োজন করা দু’টি পুজোতেই কিন্তু শুধু বাঙালিরা নন—ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা নানা জাতের লোকজন যোগদান করেন। জাপানিরা যে হেতু বেশি হই-হট্টগোল পছন্দ করেন না, তাই এই পুজোগুলো হয় সাধারণত কোনও বড় অডিটোরিয়াম ভাড়া করে। কাজ-পাগল এই দেশে চার-পাঁচ দিন টানা ছুটি পাওয়া মুশকিল বলে পুজো হয় সপ্তাহান্তে এক দিনেই। কিন্তু তাই বলে সকলের আবেগ, ভক্তি, উদ্যম—কিছুই কিন্তু কম নয়। মূর্তি আনা হয় কুমোরটুলি থেকে প্রতি চার বছর অন্তর। তবে কলকাতা থেকে দশকর্মা ও নানা রকম পুজোর সামগ্রী আনা হয় প্রতি বছরই। আর পুরোহিত মশাইয়ের দায়িত্ব পালন করেন টোকিয়ো বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অধ্যাপক।
যে পুজোর বয়স ৩০ হতে চলল, সেই পুজোতে দেখেছি, এখানকার রামকৃষ্ণ মিশনের মহারাজ এসে পুজো করছেন। এখানকার পুজোগুলোয় ভারতীয় দূতাবাসের লোকজনদের বিশেষ ভাবে আমন্ত্রণ জানানো হয়। সাধারণত রাষ্ট্রদূত হন বিশিষ্ট অতিথি, যাঁকে দিয়ে পুজোর উদ্বোধন করানো হয়। সেই সঙ্গে প্রচুর জাপানিও অংশগ্রহণ করেন। প্রত্যেকেই চাঁদা দেন। এ ছাড়া, ভারতীয় নানা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানও অর্থসাহায্য করে। সকলের সাহায্যে খুব সুন্দর ভাবেই পুজো, অঞ্জলি, খাওয়াদাওয়া, সন্ধ্যারতি, ধুনুচি নাচ এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন হয়। পুজো উপলক্ষে প্রকাশিত হয় স্যুভেনির। খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা করা হয় এখানকার ভারতীয় রেস্তরাঁ থেকে। রীতিমতো খিচুড়ি, লাবড়া, বেগুনি, চাটনি, মিষ্টি, পায়েস ইত্যাদি থাকে মেনুতে। সদস্যরাই পরিবেশন করেন।
আরও পড়ুন: ঘরছাড়ারাই বোঝে, ঘরে ফেরার কী যে আনন্দ!
খাওয়াদাওয়ার পরে থাকে বর্ণাঢ্য সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। এতে যেমন কচি-কাঁচা, নবীন-প্রবীণরা অংশগ্রহণ করেন, তেমন জাপানিরাও অংশগ্রহণ করেন। জাপানি মেয়েদের দ্বারা পরিবেশিত ভারতীয় ধ্রুপদী নৃত্য বা বলিউডি ডান্স, বা জাপানিদের হাতে নানা ভারতীয় ধ্রুপদী বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার দেখলে ও শুনলে রীতিমতো চমকে উঠতে হয়। এ ছাড়াও থাকে র্যাফেল ড্র-এর মতো খেলার ব্যবস্থা। যার প্রথম পুরস্কার খুবই চমকপ্রদ—এক জনের জন্য ভারতে যাতায়াতের বিমানখরচ। এই পুরস্কার ‘স্পনসর’ করে এয়ার ইন্ডিয়া!
এ ভাবেই হই-হট্টগোলের মধ্যে কী ভাবে কেটে যায় সপ্তাহান্তের ওই একটি দিন। তার পরেই তো আবার সবারই ব্যস্ত কর্মজীবনে ফিরে যাওয়া। আবার নতুন করে তাকিয়ে থাকা সামনের বছরের দিকে।
কয়েক দিন আগে পুজোর এক সদস্যের মুখে শুনলাম, এ বছর নাকি কলাবৌ জোগাড় করা নিয়ে খুব সমস্যা দেখা দিয়েছে, কারণ জাপানে কলাগাছ খুব একটা দেখা যায় না। এ বার পুজোতে গিয়ে প্রথমেই খবর নেব, গণেশের বৌ পাওয়া গেল কি না!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy